গোলাম কিবরিয়া জীবন :
আজ ৭ এপ্রিল চাঁদপুর হানাদার দখল দিবস। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের এই দিনে মেজর ইফতেখারের নেতৃত্বে ৯৬টি গাড়ীর একটি বিশাল বহর পাক বাহিনী চাঁদপুর শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তারা কুমিল্লা ক্যান্টেনমেন্ট থেকে যাত্রা শুরু করে চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে আসার পথে হাজীগঞ্জে মুক্তি বাহিনীর সাথে বাঁধাগ্রস্থ হয়। পরে বিকেলের দিকে তারা চাঁদপুর টেকনিক্যাল হাই স্কুলে এসে আস্তানা গাড়ে। এ সময় তারা রাতের খাবার জোগাড় করার জন্য স্কুলের উত্তর পূর্ব কর্ণারের এক বৃদ্ধা মহিলা তার গরু নিয়ে বাড়ী যাওয়ার সময় বৃদ্ধা মহিলাটিকে গুলি করে হত্যা করে এবং গরু দুটি জবাই করে রাতের খাবার জোগাড় করে। সকাল বেলা কোন প্রকার পুর্ব ঘোষণা ছাড়াই সারা শহরে কার্পিউর নামে বাস স্ট্যান্ডের নিকট ইসমাইল হোসেন বলান্টিয়ার নামে এক ব্যাক্তিকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর শহরের দিকে এসে তারা সাইকেলে চলা অবস্থায় আপাক ও মাখনকে গুলি করে হত্যা করে। ৭ তারিখে পাক সেনারা চাঁদপুর দখল করার পূর্বে ৪তারিখ দুপুর থেকে ২টি বিমান যোগে পুরাণ বাজার ও নতুন বাজারে ব্যাপক আকারে সেলিং করে। এতে জনমণে আতংক ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেকেই বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। পাক সেনারা চাঁদপুর নতুন বাজার ও পুরাণ বাজারের ওয়াবদা রেস্ট হাউজ, চাঁদপুর বড় স্টেশন, আক্কাছ আলী হাই স্কুল, রেলওয়ে রেষ্ট হাউজ, নুরিয়া হাইস্কুল, পুরাণ বাজার পুলিশ ফাঁড়ি, জিআরপি থানা, পুরাণ বাজার দাতব্য চিকিৎসালয়ে টর্চারসেল তৈরী করে। হানাদার বাহিনীর অফিসাররা রেষ্ট হাউজ গুলোতে অবস্থান করে। দীর্ঘ ৯মাস যুদ্ধা চলাকালীন সময় পাক হানাদার বাহিনীরা লাকসাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং চাঁদপুর এলাকা থেকে মুক্তিবাহিনী সন্দেহে যাদের ধরে নিয়েছে, তাদের প্রত্যেককে এ টর্চারসেলগুলোতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্মমভাবে নির্যাতন করার পর হত্যা করে। একই সাথে তারা নারীদের ধর্ষণ করে এবং তাদের হত্যা করার পর হাত-পা বেধে লাশগুলো মেঘনা-পদ্মা নদীতে ফেলে দেয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন জানান, দীর্ঘ ৯মাসে চাঁদপুর এসব টর্চারসেলগুলোতে প্রায় ২৫হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছে এবং সহ¯্রাধিক নারীকে ধর্ষণ করার পর হত্যা করে মেঘনা-পদ্মায় ফেলে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পাক হানাদার বাহিনী ওয়ানমিনিট থেকে শুরু করে সোনা আখনের ভবন পর্যন্ত যতগুলো ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠানছিলো (প্রায় ২৫টি টিনের ঘর) সবগুলোতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তারা প্রতিটি দোকানে লুটপাট চালায় এবং মুসলমানদের লুট করে মালামাল নিয়ে যাওয়ার জন্য বলে অন্য দিকে নিজেরাই লুটেরাদের ছবি তোলে। এ ভাবেই চলতে থাকে ৯মাস ব্যাপী তাদের অত্যাচার। আওয়ামীলীগের নেতা, চাঁদপুর পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম আঃ করিম পাটওয়ারী সাহেবের বাড়ি মনে করে তারই ভাই মতিন পাটওয়ারী সাহেবের বসতবাড়ীর পাকা ভবনটি পাক বাহিনীরা ডিনামেট দিয়ে গুড়িয়ে দেয়। একই সাথে গণি স্কুলের পিছনে পোদ্দার বাড়ী ও সাহা বাড়ীর যতগুলো ঘর-বাড়ি ছিলো প্রতিটিতে অগ্নি সংযোগ ও লুটপাট চালায়। এ সময় তারা শান্তি কমিটি গঠন করে ওই শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের নির্দেশেই রাজাকার আল-বদর বাহিনী গঠন করা হয়। তাদের অত্যাচারও চলতে থাকে নির্মমভাবে। তবে এ সময়ে আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধারাও থেমে থাকেনি। তাদের সুযোগ বুঝে আক্রমনের মুখে পাক হানাদার বাহিনীও অনেক সময় হিমশীম খেতে হয়েছে। অনেক স্থানে তারে পালিয়ে গেছে অথবা আত্মসমর্পন করেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের স্মরণে চাঁদপুর শহরে নির্মাণ করা হয়েছে রক্তধারা, অঙ্গীকার, শপথ ও মুক্তিসৌধ নামে স্মৃতি ভাস্কর্য। আগামী প্রজন্মকে এ স্মৃতি ভাস্কর্যগুলো স্মরণ করিয়ে দিবে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার ইতিহাস।