জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চাঁদপুর-৫ (শাহরাস্তি-হাজীগঞ্জ) আসন থেকে নির্বাচিত সরকার দলীয় এমপি মেজর (অবঃ) রফিকুল ইসলাম (বীর উত্তম) এর জনপ্রিয়তায় যেন ধস নেমেছে। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঈশ্বর্নীয় জনপ্রিয়তা নিয়ে বিপুল ভোটে জয় লাভ করেন তিনি। ২০১০ সাল পর্যন্ত তাঁর ওই জনপ্রিয়তার রেশ ধরে রাখতে পারলেও পরের বছর থেকে খুঁইয়ে যেতে শুরু করে।
বর্তমানে তাঁর জনপ্রিয়তার যে অবস্থা তা গত ২৬ এপ্রিল শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৪টায় শাহরাস্তি উপজেলার চিতোষী পূর্ব ইউনিয়নের বড়তুলা বাজারের ঘটনাই প্রমাণ করে ধসের নমূনা। ওই দিন বিকেলে বিদ্যুতের দাবীতে বড়তুলা গ্রামের দেড়-দুইশ লোক মেজর রফিকের গাড়ি বহর আগলে দাঁড়ায়। এ সময় কেউ রাস্তার উপর শুয়ে-বসে, কেউ কেউ দাঁড়িয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মিছিল, বিভিন্ন শ্লোগান দিতে দেখা গেছে। এ ভাবে প্রায় দেড় ঘন্টা স্থানীয় দলীয় নেতা কর্মী সহ মেজর রফিককে অবরোধ করে রাখে ওই গ্রামবাসী। গ্রামবাসীর সাথে আলাপে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে নির্বাচনী ওয়াদা করেছিলেন- তিনি যদি নির্বাচিত হন- তাহলে এই বড়তুলায় বিদ্যুতের আলো জ্বলবে। কিন্তু ওই আমলে নির্বাচিত হয়েও তিনি তাঁর ওয়াদা পূরণ করেননি। তাই আমরা আমাদের এই প্রাণের দাবী আদায়ের লক্ষ্যে ওনাকে অবরুদ্ধ করেছি। অতি সম্প্রতি উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়।
ওই সম্মেলনে সভাপতি পদে জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা, প্রবীন আওয়ামী লীগ নেতা হুমায়ুন কবির মজুমদার, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আলহাজ্ব আবদুল লতিফ মিয়াজী ও ফরিদ উল্লাহ চৌধুরী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক পদে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পৌর মেয়র মোশারফ হোসেন পাটোয়ারী ও কামরুজ্জামান মিন্টু মুখোমুখি হন। এতে সভাপতি পদে ফরিদ উল্লাহ চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক পদে কামরুজ্জামান মিন্টু নির্বাচিত হয়।
ওই দিন বিকেলে ফলাফল ঘোষণার পরে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে চরম উত্তেজনা দেখা দেয়। এ সময় মেজর রফিককে বাঁচাতে গিয়ে ৩/৪জন পুলিশ গুরুতর আহত এবং পুলিশের গাড়ি ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, ফলাফল ঘোষণার পর মেজর রফিক উপজেলা পরিষদ থেকে পায়ে হেটে ডাক বাংলোতে যাওয়ার পথে ক্ষিপ্ত জনতা পায়ের জুতো-সেন্ডেল ছুঁড়ে মারে। অল্পের জন্য জুতোর ছোঁয়া থেকে রেহাই পান তিনি।
আড়াল থেকে উঠে আসা যে সকল কারণে মেজর রফিকের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে তৃণমূল নেতা কর্মীদের মতে এর অন্যতম হচ্ছে, উপজেলা আওয়ামী লীগের অবৈধ আহবায়ক ফরিদ উল্লাহ চৌধুরীকে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক নিযুক্ত করা। নেতা কর্মীরা প্রশ্ন রাখেন- যিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক, তিনিই আবার সভাপতি পদ প্রার্থী- ফলে শাহরাস্তি উপজেলা আওয়ামী লীগের ২০১২ সালের সম্মেলন একতরফা এবং পক্ষপাতদুষ্ট বলে মনে করছেন তারা। অন্যদিকে যিনি ওই সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন, তিনিই আবার সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচন করেন। মোট কথা- ফরিদ উল্লাহ চৌধুরী ও কামরুজ্জামান মিন্টু ওই সম্মেলনে ওয়ার্ড এবং ইউনিয়ন গুলোতে নিজেদের পছন্দের ভোটার তৈরী করেছেন। যে জন্য নিরেট ও প্রবীন আওয়ামী লীগাররা পরাজিত হয়েছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে শাহরাস্তি উপজেলা কেন্দ্রিক শক্তিশালী করতে হলে যে সকল নেতা কর্মীদের দরকার তারা আজ প্রয়োজন মূহুর্তে অবহেলিত। শাহরাস্তি উপজেলা আওয়ামী লীগের বিজিত ও পরাজিত শক্তিকে দু’ভাগে বিভক্ত করলে এখনও পরাজিত শক্তিই অনেক শক্তিশালী।
ফরিদ উল্লাহ ও কামরুজ্জামান মিন্টুর কুট-কৌশলে প্রকৃত শক্তিশালী গ্রুপটি পরাজিত হলেও এই দু’ব্যক্তির কারণে মেজর রফিকের জনপ্রিয়তা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে-তৃণমূলের নেতা কর্মীরা এমনটাই মনে করেন। এ দু’ব্যক্তির কারণে তিনি বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময় সমলোচিত হচ্ছেন। যে কারণে তাঁর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন ইউনিয়ন পর্যায়ের অনেক বর্ষীয়ান নেতা। শাহরাস্তি উপজেলায় ১০টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার মধ্যে মেজর রফিকের ছত্রছায়ায় লালিত কিছু সংখ্যক তৃণমূল নেতার প্রস্তাব ও অনুরোধে ওই নেতাদের ইউনিয়ন গুলোতেই তিনি বহুবার অবস্থান করেন এবং বিভিন্ন অনুদানের পাল্লাটাও ওই দিকেই ভারী।
অন্যদিকে কিছু সংখ্যক ইউনিয়ন ও একমাত্র পৌরসভায় ওনার আগমন ও অনুদান তুলনায় ক্ষীন। যে কারণে ওই সকল ইউনিয়নের দলীয় নেতা কর্মি ও সমর্থকদের কাছে ক্রমশঃ মেজর রফিকের জনপ্রিয়তা কমছে। শাহরাস্তি উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রবীন নেতা ও জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির মজুমদার এবং আরেক জনপ্রিয় নেতা উপজেলা আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক মেয়র মোশারফ হোসেন পাটোয়ারীকে অন্ধকারে ঠেলে শাহরাস্তি উপজেলা আওয়ামী লীগের গলায় শনির তাবিজ বেঁধে দিয়ে মেজর রফিক ছিটকে পড়েছেন মূল আওয়ামী শক্তির কাছ থেকে।
বিগত দিনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনের সময় ফরিদ উল্লাহ চৌধুরী ছিলেন- শাহরাস্তি উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক। ওই নির্বাচনে একমাত্র বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী দেলোয়ার হোসেন মিয়াজীর সাথে তিন আওয়ামী লীগার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। যেখানে ফরিদ উল্লাহ চৌধুরী হুমায়ুন কবির মজুমদার ও অহিদ বাঙালির মধ্যে দলীয় স্বার্থে সমন্বয় ঘটিয়ে একজনকে নির্বাচনে পাঠাবেন।
কিন্তু তিনি সেটা না করে নিজেই প্রার্থী হয়ে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করেন। এর পরবর্তী পৌর নির্বাচনে ১০ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ২ জন বিএনপি সমর্থিত হলেও বাকি ৮জন ছিলেন আওয়ামী সমর্থিত প্রার্থী। এ সময়ও ফরিদ উল্লাহ চৌধুরী উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ছিলেন। দলের স্বার্থে ওই সকল আওয়ামী প্রার্থীদের মাঝে সমন্বয় ঘটাতে কিঞ্চিৎমাত্র ভূমিকা পালন করেননি তিনি।
যে কারণে আওয়ামী লীগের ভোট গুলো ৮ ধারায় বিভক্ত হলে মাঝখানে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করে। সর্বশেষ ইউপি নির্বাচনে ১০টি ইউনিয়নে ৬জন বিএনপি সমর্থিত এবং ৪জন আওয়ামী সমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করে শাহরাস্তি উপজেলা আওয়ামী লীগের করুণ অবস্থার জানান দেয়। এখানেও ফরিদ উল্লাহ চৌধুরী ও কামরুজ্জামান মিন্টুর ব্যর্থতা প্রকাশ পায় আওয়ামী সমর্থকদের কাছে।
উল্লেখ্য, ফরিদ উল্লাহ চৌধুরী রায়শ্রী উত্তর ইউনিয়নের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও সেখানে আওয়ামী লীগ বা তার অঙ্গ সংগঠনের তেমন কোন ছিটা ফোটা দেখা যায়নি ইউপি নির্বাচনে। ওই আসনে জামায়াতের ওবায়েদুল হক ও বিএনপির সেলিম পাটোয়ারী লিটনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। অন্যদিকে মেহার উত্তর ইউনিয়ন সংলগ্ন বাসিন্দা কামরুজ্জামান মিন্টু আওয়ামী দলীয় ব্যনার ব্যবহার করলেও ওই ইউনিয়ন নির্বাচনে ২ বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এই পরিসংখ্যানে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে- ফরিদ উল্লাহ চৌধুরী ও কামরুজ্জামান মিন্টুর দলীয় প্রকৃত অবস্থান।
আর যাদের উপর আস্থা রেখে মেজর রফিক সামনে এগুতে চান তাদের কারণেই তাঁর এ ঈশ্বর্নীয় জনপ্রিয়তায় পড়ছে ভাটা। মাল্টি মিডিয়ার যুগে কচ্ছপ গতির এগুনো কী মেজর রফিকের আগামী সংসদীয় নির্বাচনে ইতিবাচক সাড়া দিবে? এমন প্রশ্ন উপজেলা আওয়ামী পরিবারের।
নির্বাচনী হাওয়া বইবার পূর্বেই নানা প্রশ্ন সাধারণ ভোটারদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। এতো সবের পরেও কী থাকবে আওয়ামী লীগের এ আসনটি তাঁর-নাকি অন্য কেউ হবে এ আসনের কান্ডারী………..?