প্রতিনিধি
বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বাবা বিল্লাল গাজী। আয় রোজগার নেই তার। শারীরিক প্রতিবন্ধী মা শাহিদা বেগম। সকাল-সন্ধ্যা এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঘুরেছেন। স্বামী-সন্তানের খাবার জোগাড় করেছেন। তাদের মেধাবী সন্তান শাহীন গাজী। অন্ধকার মেঘাচ্ছন্ন আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র যেনো। উপজেলার প্রত্যাশী আর এ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র সে। এবারের ২০১৪ সালের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। এর আগে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে ৫ম ও ৮ম শ্রেণীতে।
সন্তানের শিক্ষা জীবনের সাফল্যে মা-বাবার কোনো অনুভূতি নেই। এসএসসিতে ভাল ফলাফল অর্জন করেও আনন্দ নেই শাহীনের। শাহীন জানায়, সবার সহযোগিতায় গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছি। এখন শহরে ভাল কলেজে পড়ার সামর্থ্য জুটবে কিভাবে জানি না!
উপজেলার ৯নং গোবিন্দপুর ইউনিয়নের হরিণা গ্রামের ছেলে শাহিন গাজী। চরম অভাব-অনটনের সংসারে জন্ম তার। আজন্ম শারীরিক প্রতিবন্ধী মা শাহিনা বেগম। পাশের বাড়ির বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিল্লাল গাজীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বসতভিটা নেই বিল্লালের। তাই শাশুড়ি তাকে ৫ শতক জমি দান করেন। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিল্লালকে কেউ তেমন কাজে নেয় না। মাঝে-মধ্যে নিলেও সারাদিন খেটে মজুরি পায় ৫০-১০০ টাকা। তাই দু�বেলা আহার জোগাতে মা শাহিদা প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা ঘোরেন এ বাড়ি-ও বাড়ি। এসব কথা হাসিমুখে প্রকাশ করে শাহীন গাজী।
তার মুখে শোনা গেলো তার শিক্ষা জীবনের সাফল্যের কথা। সে জানায়, তার পাথেয় উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা তার ফুফু ফাতেমা বেগম। তিনিও প্রতিটি ক্লাসে ছিলেন প্রথম স্থানে। ফুফুই তাকে প্রত্যাশী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করান। সাধ্যমতো সহযোগিতা করেন। উৎসাহ জুগিয়েছেন চাচা মনির হোসেন। প্রথম শ্রেণী থেকে রোল নং ১ পেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ওঠে শাহীন। এরপর প্রতিটি ক্লাসেই এই সাফল্য ধরে রাখে সে। অভাব-অনটনের সঙ্গে যুদ্ধ আর পড়ালেখায় সাফল্য। দুটোই চলে সমান তালে। কিন্তু বাবা খেতে পরাতে না পেরে মাঝে-মধ্যেই শাহীনকে নিয়ে যেত দিনমজুরির কাজে। এতে পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটে তার। তাই ৪র্থ শ্রেণী থেকেই প্রাইভেট পড়াতে শুরু করে সে। স্কুল কর্তৃপক্ষ তার নাম লেখায় উপবৃত্তির তালিকায়। প্রাইভেট পড়ানোর আয় আর উপবৃত্তি থেকে প্রাপ্ত টাকা বাবা মা�র হাতে তুলে দেয়। মাঝে-মধ্যে হাসি মুখে ফরমায়েশি খাটে প্রতিবেশী সবার। এতে স্কুল আঙ্গিনাসহ সবার আদরের পাত্র হয়ে উঠে সে। সবার মন যোগাতে গিয়ে প্রাথমিক থেকে এসএসসি পর্যন্ত দিনে ৩ ঘণ্টার বেশি পড়তে পারেনি। তবুও পড়ালেখায় গভীর আগ্রহ আর মনোযোগ তাকে সাফল্য এনে দেয়। ৫ম ও ৮ম শ্রেণীতেও ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায় সে। বৃত্তির টাকাও তুলে দেয় বাবা-মা�র হাতে।
মা শাহীদা বেগম একে তো প্রতিবন্ধী, তার ওপর স্বামী-সন্তানের খাবার যোগাতে সকাল-সন্ধ্যা ঘোরেন এ বাড়ি ও বাড়ি। তাই শিশুকাল থেকে দাদী সাজেদা বেগম (৭৫) তাকে দেখাশোনা করেন। গ্রামে নেই বিদ্যুৎ। পড়ালেখা চলে দোচালা একটি ছাপড়া ঘরে। কেরোসিনের টাকার জোগাড় হয় না। তাই চাচার মোবাইল ফোন দিনের বেলায় চার্জ দিয়ে রাখতো সে। রাতে ঘরের আড়ার সঙ্গে ঝুলিয়ে ওই ফোনের আলোতে চলেছে লেখাপড়া।
এভাবে কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে যুদ্ধ করে লেখাপড়ায় সাফল্য ধরে রেখেছে শাহীন। সে জানায়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সব শিক্ষক তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু বাবার স্নেহে যত� নিয়েছেন সহ-প্রধান শিক্ষক (ইংরেজি) মাহবুবুল আলম বাশার। তিনি তাকে বাসায় পড়িয়েছেন, খেতে দিয়েছেন এবং মাঝে মধ্যে আর্থিক সহযোগিতাও করেছেন। গণিতের শিক্ষক আলাউদ্দিনও ক্লাসের বাইরে পড়িয়েছেন তাকে।
১৬ বছর জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে এখন আনন্দাশ্রু তার চোখে। সামনে অজানা ভবিষ্যৎ। তাকে পাড়ি দিতে হবে আরও অনেক পথ। ভর্তি হতে হবে শহরের কোনো ভালো কলেজে। গ্রামে সবাই তাকে সহযোগিতা করেছে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জ্যোতি প্রকাশ দাস ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ইউপি চেয়ারম্যান কায়েম পারভেজ লাভলু বলেন, ভবিষ্যতে শাহীন যে কলেজেই ভর্তি হোক, সে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাখতে পারবে। তাই তার প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ানোর জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন তারা। তাকে সহযোগিতা করতে যোগাযোগ করুন দৈনিক চাঁদপুর নিউজ কার্যালয়ে। মোবাইলঃ ০১৭১১-৯৪৩৪৩৫