আলম শামস
এক.
কিছুক্ষণ আগেও ঝকঝকে রোদ ছিল। হঠাৎ করেই অন্ধকার নেমে এলো। শুরু হলো আকাশ জুড়ে কালো মেঘের দৌড়ঝাঁপ, চোখ ধাঁধানো বিজলীর ঝটকা আর পিলে চমকানো গর্জন। আমরা তখন নদীর মাঝখানে। চাঁদপুর থেকে শরীয়তপুরের নড়িয়া যাচ্ছি। ইঞ্জিনচালিত নৌকা তীব্র বেগে ছুটছে। যেন বৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা। তবে শেষ রক্ষা হল না। তুমুল ঝড়-বৃষ্টি আমাদের পেয়ে বসলো। আমার পাশের মেয়েটিও ভিজে একাকার। বেরসিক বৃষ্টি!
নৌকায় এতো লোকের মাঝে বৃষ্টিভেজা শরীর প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠায় লজ্জায় লাল হয়ে উঠছে তার মায়াবী মুখ। পাশে বসা বৃদ্ধ বাবার শরীরের সঙ্গে মিশে আছে। যেন নিজেকে আড়াল করতে চাইছে। বাবা এক হাতে মেয়ের কাঁধ চেপে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে । তার ঠোঁট নড়ছে। দোয়া পড়ছেন নীরবে।
‘সবাই আল্লাহ-খোদার নাম স্মরণ করেন।’ নৌকা কুলে ভেড়ানোর চেষ্টা করতে করতে আর্তকণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠলো মাঝি। সবার মধ্যে একটা সাড়া পড়ে গেল। অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছিল। ঝড়ের ঝাপটায় নৌকা দুলে ওঠতেই আৎকে ওঠেছিল কেউ কেউ।
ঘণ্টাখানেক পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলো। বৃষ্টির ফোঁটা ছোট থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি হয়ে মিলিয়ে গেল। আকাশ আবার পরিষ্কার হয়ে এলো।
সদ্যস্নাত তরুণীর মতো ঝক-ঝকে উজ্জ্বল হয়ে ওঠলো চারদিক। মাঝি ইঞ্জিনের গতি বাড়িয়ে দিলো। বাতাস আর রোদে গায়ের ভেজা কাপড় অনেকটাই শুকিয়ে যাওয়ায় অস্বস্তি কেটে যেতে লাগলো। সময়ের সঙ্গে প্রকৃতির পালাবদল দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো। আলো আঁধারীর সন্ধিক্ষণে প্রকৃতি হয়ে ওঠলো রহস্যময়।
চাঁদ এসে যখন রাতের আকাশ দখল করলো ঠিক সেই সময় আমরা পৌঁছলাম নড়িয়ায়। যাত্রীরা লাইন ধরে ধীরে ধীরে ঘাটে নামতে লাগলো। আমিও লাইনে দাঁড়ালাম। আমার পেছনে বৃদ্ধ বাবার হাত চেপে ধরে সেই মেয়েটি।
ঘাটে নেমে চারপাশটা একবার দেখে নিলাম। সবকিছুতেই পরির্তনের ছোঁয়া; ভালো লাগলো। বাপ-মেয়ে রিকশা স্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছে। বাবা চোখে কম দেখেন বলে মেয়ের হাত ধরে আছেন। স্ট্যান্ডে গিয়ে তারা রিকশা পেল না। এদিক ওদিক তাকিয়ে আমিও কোনো রিকশা দেখলাম না। সম্ভবত আধাবেলা বৃষ্টিতে ভিজে রিকশাচালকরা সবাই বাড়ি চলে গেছে। এখন কী করি? এতো দূরের পথ অন্ধকার পাড়ি দিয়ে কীভাবে গন্তব্যে পৌঁছবো?
তুমি কোথায় যাবে বাবা? মেয়েটির চোখে চোখ পড়তেই তার বাবা আমাকে প্রশ্ন করলেন। তার কণ্ঠে ক্লান্তি আর অনিশ্চয়তার ছাপ।
আমি দ্রুত চোখ সরিয়ে নিয়ে বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বললাম ‘মুলফৎগঞ্জ’। ‘চাচা আপনারা কোথায় যাবেন?’— আমরা ও সেদিকেই যাবো। এখন কি করে যে যাই? ‘আসুন সামনে এগিয়ে যাই। দেখি কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না।’
আমরা তিনজন ভেজা মাটির নরম পথে এগিয়ে চললাম। কিছুদূর যেতেই দূরে একটা রিকশা দেখতে পেলাম। অন্যদিকে চলে যাচ্ছে দেখে ডাকতে ডাকতে ছুটে গেলাম। এগিয়ে না এলে ফসকে যেত।
গন্তব্যের কথা শুনে রিকশাচালক বেঁকে বসল। ‘বৃষ্টি-বাদলার দিনে এত দূর যাব না।’ বৃদ্ধ আর মেয়েটার অসহায়তার কথা বুঝিয়ে বলার পর অনেক গাইগুই করে শেষ পর্যন্ত রাজি হলো।
রিকশা নিয়ে স্ট্যান্ডে ফিরে এলাম। বৃদ্ধ চাচার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনারা চলে যান, আমি দেখছি নিশ্চয়ই আরেকটা রিকশা পাওয়া যাবে।’ তিনি আপত্তি জানিয়ে বললেন, তা কি করে হয় বাবা। এখন আর কোনো রিকশা পাবে না তো। তোমাকে একা ফেলে আমরা যেতে পারবো না। চলো এক সঙ্গেই যাই।
অগত্যা তিনজন এক রিকশায় চেপে বসলাম। আমি ওপরে আর আমার পায়ের মাঝে বৃদ্ধ চাচা। তার পাশে মেয়েটি। চাচাজির জায়গায় যদি মেয়েটি বসতো। ব্যাচেলর মনে দুষ্টু চিন্তাটা আসতেই নিজেকে বকুনি দিলাম। ছিঃ।
পাকা, আধপাকা, আবার কোথাও কাঁচা পথে এগিয়ে চলছিল তিন চাকার গাড়ি। চালক বেচারার খুব কষ্ট হচ্ছিল।
‘জালাল মিয়া চিন্তা কইরো না, তুমি যে আমাদের উপকার করতেছ এই জন্য অনেক ছওয়াব পাবা। বিপদে মানুষ যদি মানুষের উপকার না করে তাহলে ইবলিশের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য রইলো কই, কি বলো?’
-ঠিকই কইছেন স্যার। প্যাডেলে জোরে চাপ দিয়ে সায় দেয় জালাল মিয়া। বাঁশঝাড়, খালপাড়, আঁকাবাঁকা সরু পথ পেরিয়ে আমরা যখন বৃদ্ধের বাড়ি পৌঁছলাম তখন এশার আযান শোনা যাচ্ছে।
বাড়ির লোকজন আমাদের ঘিরে ধরলো। বাবা-মেয়ে দুজনের মুখেই আমার প্রশংসা। মেয়েটির বাবা আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, একজন উপকারী মানুষ, একজন ফেরেশতার মতো। আজ এই ফেরেশতা আমাদের উদ্ধার করেছে। সবার মধ্যে আনন্দ উচ্ছ্বাস দেখে আমার ভালো লাগছিল। যাই হোক এবার আমার বিদায়ের পালা। এ কথা জানাতেই সবাই ‘না, না’ করে ওঠলো।
মেয়েটির কৃতজ্ঞ চোখমুখের নীরব আকুতি উপেক্ষা করতে পারলাম না। রাস্তার পাশে ছোট একটি বাড়ি। পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। সাজানো-গোছানো ঘর। কিছুক্ষণ পরেই মেয়েটি আমার জন্য শুকনো কাপড় নিয়ে এলো। নিজেও আধভেজা কাপড় পাল্টে এসেছে।
এই নিন তাড়াতাড়ি ভেজা কাপড় ছেড়ে এগুলো পরে নিন। হাত বাড়িয়ে কাপড় নিতে নিতে বললাম, থ্যাঙ্ক ইউ। কি নাম আপনার? সুমনা। সানজিদা হক সুমনা।
—কী পড়ছেন?
—এবার এইচএসসি দেবো। আপনার নাম কিন্তু এখনো বলেননি। -ওহ, হো সরি সরি। আমি আহমেদ ইফতিয়াক।
—নামটা ছোট করে ডাকা যায় না?
—কেন যাবে না? আপনি কীভাবে ডাকতে চান, শুনি,
—ইফতি, মানে, আমি শুধু ইফতি ভাই বলে ডাকবো। আপত্তি নেই তো?
—না একদম না, মেদ ভুঁড়ি কারইবা ভালো লাগে। স্লিম ইজ সুইট।
—ঠিক তাই।
সুমনার চোখে চোখ রেখে বললাম। গভীর মায়াবী চোখে তখন জোছনার মায়াজাল। পলাশ কলি ঠোঁটের কোণে প্রশ্রয়ের মৃদু হাসি; এতো সুন্দর!
—কি দেখছেন?
জলতরঙ্গের মতো সুমনার প্রশ্নটা কানে বাজতেই ঘোর কেটে গেল। মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, আগে কখনো দেখিনি তো
—কি?
—নরম পৃথিবীতে স্বর্গের অপ্সরা।
উজ্জ্বল হাসি ছড়িয়ে সুমনা ঘরের বাইরে পা বাড়ালো। দরজার কাছে গিয়ে থ মেরে দাঁড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে তাকালো আমার দিকে। —এক্ষুণি ড্রেস চেঞ্জ করে নিন। না হলে সর্দিজ্বর লেগে যেতে পারে। আমি একটু পরেই আসছি।
কিছুক্ষণ পর আমার জন্য শরবত ও নাস্তা নিয়ে এলো সুমনা, বসলো সামনের চেয়ারে। হালকা গোলাপি রঙের থ্রি-পিসে তাকে মনে হচ্ছিল টবে সাজানো গোলাপ যেন। ওহ্ মানুষ এত সুন্দর হয়!
নাস্তা খাওয়ার ফাঁকে কথায় কথায় জানলাম সুমনার বাবার কথা। তিনি জীবনের সব সঞ্চয় ঢেলে এলাকার স্কুল-মাদ্রাসা-মসজিদ নির্মাণ করেছেন।
খানিক পরে একজন আগন্তুকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। সচকিত সুমনা বললো, বাবা আসছেন।
সুমনার বাবা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি কর?
‘মাত্র মাস্টার্স শেষ করেছি’— বললাম উত্তরে। ‘এখনো কোন কিছুতে জয়েন করিনি। চেষ্টা করছি।’
সুমনার বাবা বললেন, ‘ভালো। কিন্তু সমস্যা কি জানো, চারদিকে এত সব মানুষ এতো প্রতিযোগিতা যে নামকাওয়াস্তে চেষ্টা করে কিছু করা কঠিন। এ জন্য অনেকেই অধৈর্য হয়ে শর্টকাট রাস্তায় টাকা কামানোর ধান্ধায় নামে।’
আমি বললাম, ‘পরিস্থিতি বাধ্য করলে তো কিছু করার থাকে না চাচা। এ পরিস্থিতিতো আমাদেরই অন্ধ দলবাজি, অনৈক্য, অদূরদর্শিতা ও খামখেয়ালির ফসল। এ ধারা না বদলালে দেশটা গোল্লায় যাবে।’
দুই.
জ্বরে আমি বেহুশ। মাথায় জল-পট্টি দেওয়া হয়েছে।
খানিক পরে ডাক্তার এলেন। চেকআপের পর তার দেওয়া ওষুধ খেলাম। জ্বর কমছিল না দেখে আমাদের বাড়িতে খবর দেওয়া হলো। ছোট ভাইকে নিয়ে মা ছুটে এলেন। তিন দিন যমে মানুষে লড়াই চললো। মনে হচ্ছিলো, আমি যেন মরে যাচ্ছি। কে যেন আমাকে মৃত্যুর অতল গহ্বরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সুমনা আমার হাত জাপটে ধরে আছে। কিছুতেই আমাকে যেতে দেবে না। মা ও সুমনার অক্লান্ত সেবায় সুস্থ হয়ে ওঠলাম।
সুস্থ হওয়ার পর মাকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম। সুমনাকে ছেড়ে আসতে মন চাচ্ছিল না। আমার মন যার কাছে— তাকে ছেড়ে কী করে আসি। বিদায় নিতে গিয়ে শুধু বলে এলাম আবার হবে দেখা, সুমনা।
শিরোনাম:
শনিবার , ১৫ মার্চ, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ১ চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।