রেখার এই উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে। ১৮ মাস বা দেড় বছর হলো তার বড় ছেলে রাফি স্থানীয় একটি কাঁচের কারখানায় কাজ নিয়েছে। একাধিকবার তার শরীর থেঁতলে গেছে। রক্তাক্ত হয়েছে। এক বিকালে তার ধারালো ব্লেডে তার হাতের তালুর চামড়া উঠে গেছে। সেখান থেকে রক্ত ছিটকে লেগেছে রাফির টি-শার্টে। তাকে সঙ্গে সঙ্গে কারখানার ইমার্জেন্সি রুমে নেয়া হয়েছে। কিন্তু ছেলের এ বিষয় সম্পর্কে মা রেখাকে কেউ জানাননি। রেখা বলেন, এটা জেনে আমার ভেতরে মনে হতে থাকে আমি খুব খারাপ একজন মা। আমি জানি রাফি কাজে যেতে চায় না। সে স্কুলে যেতে চায়।
২০২০ সালের মার্চে লকডাউন দেয়ার সময় ঢাকায় শান্তিপুর হাইস্কুলে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী কমপক্ষে ১১০০ শিক্ষার্থী ছিল। তার মধ্যে রাফি অন্যতম। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে স্কুলের স্টাফরা ধাতব গেট খুলে অপেক্ষায় থাকলেন। গেট খুললেই মধ্য ঢাকায় ব্যস্ত সড়ক। তারা শার্ট-ব্লেজার পরে অপেক্ষায় থাকলেন। কিন্তু ১১০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে সেদিন ক্লাসে ফিরলো মাত্র ৭০০। তারপর থেকে কয়েক মাস কেটে গেছে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়নি। এমন অবস্থায় ডিসেম্বরে এসে ক্লাসরুমের বেঞ্চ এবং টেবিল ফাঁকা পড়ে থাকে। তাই দেখে ভাঙারি হিসেবে সেগুলো বিক্রি করে দেয়া শুরু করে স্কুল কর্তৃপক্ষ। শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিতদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই হলো কিশোর বয়সী বালক। স্কুলটির প্রধান শিক্ষক বিপ্লব কুমার সাহা বলেছেন, এসব শিশু এখন তাদের পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস।
বাংলাদেশে করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে কি পরিমাণ শিশুর স্কুলে ফেরা সম্ভব হয়নি তা অনুসন্ধানে দেশজুড়ে ২০টি স্কুলের ওপর তথ্য সংগ্রহ করে টাইম ম্যাগাজিন। তাতে দেখা যায়, শতকরা কমপক্ষে ৫৯ ভাগ ঝরে পড়ারা হলো বালক। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের ডাটায়ও একই কথা বলা হয়েছে।
ক্রমবর্ধমান এই সংকট বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে ভাবিয়ে তোলে। ফলে তারা মার্চে শিশু শ্রম বিষয়ক ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের (আইএলও) কনভেনশন ১৩৮ অনুমোদন করে। তারা ঘোষণা করে, ১৪ বছরের কম বয়সী কোনো শিশুকে কোনো শিল্প-কারখানায় কাজ দেয়া যাবে না। আগামী তিন বছরের মধ্যে শিশুশ্রম পুরোপুরি নির্মূল করার প্রতিশ্রুতিও দেয় তারা। কিন্তু করোনা মহামারির প্রথম দেড় বছরে সারা দেশে গড়ে বাড়িপ্রতি আয় কমে গেছে শতকরা ২৩ ভাগ। অনেক অভিভাবক বলেছেন, তাদের হাতে কোনো বিকল্প নেই। তাই তারা ছেলেকে কাজে পাঠাতে বাধ্য হয়েছেন। তা নাহলে তার ভাইবোনরা অনাহারে থাকবে। কিন্তু এখন থেকে দুই বছর আগে পরিস্থিতি এমন ছিল না। প্রথম যখন স্কুল বন্ধ হয়, তখন রাফির অভিভাবকরা তার শিক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। রাফির ছোট ভাইয়ের বয়স মাত্র ৮ বছর। এরই মধ্যে অন্য পরিবারগুলোর সঙ্গে একজন প্রাইভেট শিক্ষক খুঁজতে বের হয়, যিনি ডজনখানেক শিশুকে প্রতিদিন এক ঘণ্টার জন্য পড়াবেন। এভাবে কয়েক সপ্তাহ যেতে থাকে। বাংলাদেশ থেকে যায় লকডাউনে। ফলে পরিবারগুলোর আর্থিক অবস্থা দ্রুত অবনতি হতে থাকে।
রেখার স্বামী তাজুল একজন সফল উদ্যোক্তা। তিনি একই সঙ্গে দুটি কাজ করতেন। দিনের বেলা রাস্তার পাশে একটি ছোট্ট দোকান চালাতেন। রাতের বেলা নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে একটি মার্কেটে টহল দিতেন। এসবই ২০২০ সালের গ্রীষ্মের কথা। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে দুটি কাজই হারান তিনি। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যেতে থাকে। তিনি যা আয় করতে থাকেন তা দিয়ে ক্ষুদ্রঋণ পরিশোধ এবং বাসা ভাড়া দেয়া সম্ভব হয় না। ঋণ উত্তোলনকারীরা নিয়মিত তার দরজার কড়া নাড়তে থাকেন। রেখাকে হুমকি দেন। অসহায় হয়ে রাফিকে অনুরোধ করেন তাজুল। তাকে কাজে লাগানোর চিন্তা আসে মাথায়। রেখা বলেন, এটা আমাদের পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়েছে যে, আমরা এটা করতে বাধ্য হয়েছি। রেখা কখনো ভাবেননি তার ছেলেকে দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করতে হয় এমন একটি গ্লাস কারখানায় কাজে পাঠাবেন।
করোনা মহামারি যখন প্রথম আঘাত হানে, তখন বালিকাদের নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছিল। বলা হয়েছিল, এর ফলে তাদেরকে জোর করে বিয়ে দেয়ার ঘটনা বৃদ্ধি পাবে। কারণ, পরিবারগুলো মেয়েদের বিয়ে দিয়ে খরচ কমানোর লড়াই করছে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের বয়সের দ্বিগুণ বয়সী পুরুষের কাছে বিয়ে দেয়া হয়। অলাভজনক সংগঠন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক জরিপে দেখা গেছে, লকডাউনের প্রথম ৬ মাসে দেশে যত মেয়ের বিয়ে হয়েছে তার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই অপ্রাপ্ত বয়স্ক। তাদের সংখ্যা ১৪ হাজার। বিয়ে হওয়া এসব বালিকার বয়স ১৩ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। রাফি যে শান্তিপুর হাইস্কুলে পড়তো, সেখানকার শিক্ষকরা মেয়ে শিক্ষার্থীদের বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল রেখেছেন। তারা জানতে পেরেছেন যে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যারা স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে, তাদের বেশির ভাগই প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে গেছে এবং শহরের বাইরে কোনো স্কুলে পড়ছে। কমপক্ষে ১৫টি মেয়েকে বেআইনিভাবে অপ্রাপ্ত বয়সে জোর করে বিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রধান শিক্ষক সাহা বলেন, ১৫ অনেক বেশি। তবে এই সংখ্যা কম বলে তার মনে হয়। করোনার প্রভাব ছেলেদের ওপর কীভাবে পড়েছে, সে বিষয়ে তিনি বলেন- এটা আমাদের প্রত্যাশা এবং কল্পনার অতীত।
বাংলাদেশে মাধ্যমিক শিক্ষা ফ্রি নয়। গড়ে বছরে টিউশন ফি ৩ হাজার টাকা (৩৫ ডলার)। এমন একটি দেশ, যেখানে প্রতি ৫ জনের মধ্যে একজন মানুষকে করোনার আগে ১.৯০ ডলারেরও কম উপার্জনের ওপর বেঁচে থাকতে হয়েছে, সেখানে স্টেশনারি, খাতাকলম, পোশাক তাদের ওপর বড় চাপ সৃষ্টি করে। ১১ থেকে ১৬ বছর বয়সী মেয়েরা সবাই অল্প পরিমাণ বৃত্তি এবং টিউশন সাবসিডিয়ারি হিসেবে বছরে সরকারের তরফ থেকে ৩৫০০ টাকা পায়। দেশে বাল্যবিবাহের হুমকি মোকাবিলায় এবং তাদের পরিবারকে কন্যা শিশুকে স্কুলে রাখার প্রণোদনা হিসেবে এই অর্থ দিয়ে থাকে সরকার। ব্র্যাকের শিক্ষা বিষয়ক পরিচালক শাফি খান বলেন, যে পরিবারে ছেলে আছে তাদের জন্য পড়াশোনার খরচ বড়। অনেক ক্ষেত্রে তা অসম্ভব এবং এক্ষেত্রে সমর্থন নেই বললেই চলে।
আইএলও’র বাংলাদেশ বিষয়ক পরিচালক তুওমো পুতিয়াইনেন বলেছেন, স্কুলগুলো যখন বন্ধ হলো, তখন বেশির ভাগ পরিবার তাদের কন্যা শিশুকে কাজে পাঠাননি। কারণ, এক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি। কিন্তু ছেলেরা আয়ের একটি জরুরি উৎস হয়ে ওঠে। কন্যা শিশুদের শিক্ষায় লাখ লাখ ডলার বিদেশি সমর্থন আসা সত্ত্বেও বাংলাদেশে শিশু অধিকারের পরামর্শকরা টাইম’কে বলেছেন, করোনা মহামারি শুরুর থেকে যে হাজার হাজার বালক স্কুল থেকে ঝরে গেছে তাদের জন্যও একই রকম সমর্থন দেয়ার জন্য তারা লড়াই করছেন। ওই রিপোর্টে এমনতরো অনেক তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।
মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির পাশাপাশি অনেক পরিবার দারিদ্র্যে নিপতিত হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশি শিশুরা কর্মক্ষেত্রে ঢুকে পড়েছে। এ অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে হলে অনেক সময় লাগবে।