নূরে আলম জিকু
করোনার থাবায় নাজেহাল বিশ্ব। ইতিমধ্যে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে করোনা। প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর তালিকা। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। কিন্তু দেশে করোনার পাশাপাশি এখন ডেঙ্গু হানা দিয়েছে। দিন দিন এর ব্যাপকতা ছড়িয়ে পড়ছে। এডিস মশা থেকে ছড়িয়ে পড়া ডেঙ্গু প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে মানুষের। ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে ৪০ শতাংশই ১৪ বছরের কম বয়সী।
এ নিয়ে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। সম্প্রতি এটিএন নিউজের এসাইনমেন্ট এডিটর সারোয়ার হোসেনের দশ বছরের শিশুপুত্র ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এ ঘটনায় সামাজিক মাধ্যমে শোক প্রকাশ করেন বহু মানুষ। এমনিতেই হাসপাতালগুলো করোনা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এর ওপর ডেঙ্গুর চিকিৎসা নতুন করে চাপ তৈরি করেছে। কয়েকটি হাসপাতালে করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গুর চিকিৎসা দেয়া হলেও তার সংখ্যা অনেক কম। তাছাড়া করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে অনেকেই হাসপাতালে আসছেন না।
ওদিকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় এডিসের বিস্তার বেড়েছে। করপোরেশন থেকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নেয়া হলেও পরিস্থিতি এখনো অনিয়ন্ত্রিত। চলমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য ও কিট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। ঢাকা মহানগরীতে ডেঙ্গু আক্রান্তদের একটি বড় অংশ শিশু। মো. সালাহউদ্দিন তার ৪ বছর বয়সী মেয়ে আবিরাকে নিয়ে বৃহস্পতিবার হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে আসেন। মেয়েকে ডেঙ্গু বিভাগে ভর্তি করান। তিনি বলেন, ৩/৪ দিন ধরে মেয়ে জ্বরে ভুগছে। শরীরে র্যাশ উঠেছে। টেস্টে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি করতে এনেছি। তিনি বলেন, গত কয়েক মাস ধরে মশার প্রকোপ অনেক বেড়েছে। সিটি করপোরেশন নাকি মশা মারতে তৎপর। অথচ মশার কিটনাশক ছিটাতে দেখছি না। আমরা না হয় মশা থেকে একটু সাবধান হতে পারি। শিশু কিংবা বাচ্চা এরা কীভাবে সচেতন হবে। সব সময়তো তাদের মশারির মধ্য রাখা যায় না। মশায় কামড় দিলেও বলতে পারছে না। হাসপাতালে দেখলাম ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যারা আসছেন তাদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেল্থ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ডেঙ্গু সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাজধানীতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য সরকারি-বেসরকারি ৪১ টি হাসপাতাল নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতাল রয়েছে ১২টি। কয়েকটি হাসপাতাল করোনার কারণে ডেডিকেটেড ডেঙ্গু চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল ও নিটোরে চলতি বছরে কোনো ডেঙ্গু রোগী ভর্তি করা হয়নি। বাস্তবে ৮টি সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি করা হয়। একই সঙ্গে এসব হাসপাতালে করোনা রোগীও ভর্তি রয়েছেন। চলতি বছরে ঢাকায় সরকারি হাসপাতালে ১২৫৮ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি করা হয়েছে। একই সময়ে বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুরোগী ভর্তি হয়েছেন ৩৯১৬ জন। সরকার নির্ধারিত ঢাকা মহানগরীর ২৯টি বেসরকারি হাসপাতালে রোগী বেড়েছে প্রায় ৩ গুণ। করোনার পাশাপাশি এসব হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা দেয়া হয়। চলতি মাসের শুরু থেকেই ঢাকা শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বেড়েছে। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে বেশির ভাগই শিশু। একই চিত্র বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও।
বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩৯ জন, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ৩৩১ জন, বারডেম হাসপাতালে ৯৪ জন, ইব্নে সিনা হাসপাতালে ১৯৯ জন, স্কয়ার হসপিটালে ২৫১ জন, কমফোর্ট নার্সিং হাসপাতালে ৬ জন, শমরিতা হাসপাতালে ২৫ জন, ডেল্টা মেডিকেল কলেজে ৯২ জন, ল্যাব এইড হাসপাতালে ৪৩ জন, সেন্ট্রাল হাসপাতালে ৩৫১ জন, হাই কেয়ার হাসপাতাল লিমিটেডে ১৩ জন, হেল্থ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে ১৭ জন, গ্রীন লাইফ মেডিকেল হাসপাতালে ১৩৪ জন, ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে ৪৬৩ জন, ইউনাইটেড হাসপাতাল লিমিটেডে ১২৩ জন, খিদমাহ্ হাসপাতালে ২১৩ জন, শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩৪ জন, সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১২৬ জন, এভার কেয়ার হাসপাতালে ৯৩ জন, আদ্-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৪৮১ জন, ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ৮৪ জন, বিআরবি হসপিটাল্স লিমিটেডে ৮০ জন, আজগর আলী হাসপাতালে ১১৩ জন, বাংলাদেশ স্পেশলাইজ্ড হাসপাতালে ৭৫ জন, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯৪ জন, সালাহ্উদ্দিন হাসপাতালে ১৮৫ জন, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৬৯ জন, উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ২৬ জন, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৬২ জন।
সরকারি হাসপাতালের মধ্যে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭৫৭ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ২৩১ জন, শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৭ জন, বিএসএমএমইউতে ৫৯ জন, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ১ জন, পিলখানা বিজিবি হাসপাতালে ৭ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ১৯১ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৫ জন।
চলতি বছরের ১লা জানুয়ারি থেকে ১২ই আগস্ট পর্যন্ত ৫৪৩৪ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আগস্ট মাসের প্রথম ১২ দিনে ২ হাজার ৭৭৬ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। জুলাই মাসেই ভর্তি হয়েছিলেন ২ হাজার ২৮৬ জন ডেঙ্গু রোগী।
এ পর্যন্ত রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর) ডেঙ্গু সন্দেহে ২২টি মৃত্যুর তথ্য পাঠানো হয়েছে। প্রতিদিনই ডেঙ্গুজনিত মৃত্যুর ঘটনা আসছে আইইডিসিআর-এ। কিন্তু এ বছর এখনও আইইডিসিআর ডেঙ্গুজনিত মৃত্যুর একটি ঘটনাও পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি। এরমধ্যে শিশু হাসপাতালেই ৫ জন মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। এছাড়া বেসরকারি হাসপাতালে মারা গেছেন আরও ১৪ জন। অন্য ৩ জনের মধ্যে ২ জন চট্টগ্রাম বিভাগ ও ১ জন খুলনা বিভাগের।
কীটতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুর আহমেদ মানবজমিনকে বলেছেন, নগরীতে ১০০ ডেঙ্গু রোগী থাকলেও আমাদের জন্য বিপদ। কয়েকদনি ধরে যে হারে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে তাতে ২০১৮ সালকে ছাড়িয়ে যাবে। দুই সিটিতে ব্যাপক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু। অথচ সিটি করপোরেশন নিয়ন্ত্রণের কথা বলে যাচ্ছে। যা বাস্তবতার সঙ্গে কোনো মিল নেই। প্রতিদিন ডেঙ্গু রোগী নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ৪১ টি হাসাপাতালের তথ্য দিচ্ছে। অথচ এই ৪১ হাসপাতালের বাহিরেও অনেক হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছে, সেই তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে যাচ্ছে না। তিনি বলেন, সরকারি হাসপাতালে এখন করোনা রোগী বেশি, তাই সেখানে ডেঙ্গু রোগী তেমন একটা ভর্তি হচ্ছে না। করোনার ভয়ে সবাই প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ঝুঁকছেন। ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে শিশুদের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে ব্যক্তিগত সুরক্ষার প্রতি জোর দিতে হবে। যেহেতু শিশুরা ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে সবচেয়ে বেশি, তাই শিশুদের ওপর বেশি যত্ন নিতে হবে। শিশুদের মশারি ছাড়া ঘুমাতে দেওয়া যাবে না। শরীর ঢেকে রাখে এমন পোশাক পরাতে হবে।