মোস্তফা জব্বার : ঝড় ঝঞ্ঝা, বৃষ্টি, বাতাস আর আকাশে ওড়ার টেলিটকের বিজ্ঞাপনটি যদিও এ কথা বলে না যে সেটি তৃতীয় প্রজন্মের মোবাইল ফোনের জন্য প্রচারিত, তবুও হাঁটি হাঁটি পা পা করে থ্রিজির সিম বিক্রি হতে শুরু করেছে। ১৮ অক্টোবর ১২ রাতে বিজয় নগরের একটি মোবাইল সিমের দোকানের সামনে থ্রিজির লগো দেখে থেমে জিজ্ঞেস করে জানলাম যে, তার প্রথম চালানের থ্রিজি সিমগুলো সব বিক্রি হয়ে গেছে। পরের চালান আসবে শনিবারে। পত্রিকার খবরে জানা গেছে যে, টেলিটকের গ্র্যাভিটি ক্লাবের গ্রাহকেরা থ্রিজি সিম পাচ্ছে আর ঢাকার প্রায় ৪ হাজার আউটলেট থেকে থ্রিজি সিম বিক্রি হচ্ছে। এমনকি এমন খবরও পাওয়া গেছে যে টেলিটকের ২জি সিম ব্যবহারকারীরাও থ্রিজিতে আপগ্রেড করতে পারবেন। তবে টেলিটকের এমডি থ্রিজির দারম্নণ চাহিদার জন্য প্রথমে কর্পোরেট গ্রাহকদেরকে সিম দিয়ে পরে সাধারণ গ্রাহকদেরকে সিম দেয়ার যে পরিকল্পনার কথা আমাকে জানিয়েছিলেন সেটি হয়ে ওঠেনি। থ্রিজি নিয়ে যতোটা উচ্ছলতা বা মাতামাতি থাকার কথা ছিল সেটি পাওয়া য়ায়নি। অবশ্য থ্রিজির সঙ্গে যুক্ত সংকটগুলো অতিক্রম করতে পারলে দেশের বিপুল সংখ্যক মোবাইল ব্যবহারকারী ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা থ্রিজির দিকে ঝুঁকবেন এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
থ্রিজি চালু হওয়ার ফলে শেষ পর্যন্ত্ম বাংলাদেশের মানুষ কেবলমাত্র নতুন প্রজন্মের মোবাইল ফোনের যুগেই পা দিচ্ছে না বরং দ্রম্নতগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের যুগেও পা দিয়েছে। মূলত এই কাজটি পরীÿামূলক একটি কাজ। টেলিটককে দিয়ে সরকার মূলত থ্রিজির কার্যকারিতা দেখার কাজটি সম্পন্ন করেছে। আমরা পুরো দেশের মানুষ থ্রিজির অগ্রযাত্রার প্রথম সিঁড়িতে পা দিয়ে খুশি হলেও আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে এটি লাইসেন্সের আওতায় দেশের অন্য সকল মোবাইল অপারেটেরদের দ্বারাও যেন চালু হয়। টেলিটকের সহায়তায় আমরা থ্রিজি কেমন সেটি হয়তো দেখতে পাবো। কিন্তু দেশটি ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্ত্মর করার জন্য কার্যত দেশের সকল প্রান্ত্মের সকল মানুষের জন্য অবারিত হতে হবে থ্রিজি ও তার পরের প্রজন্মের প্রযুক্তি।
এখানে এটি উলেস্নখ করা প্রয়োজন যে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে লাইসেন্স সহকারে থ্রিজি চালু করার সরকারি উদ্যোগটি যথাযথ দÿতায় সঠিক সময়ে সামনে আসেনি। ২০০৯ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে যে সরকার ÿমতায় আসে সেই সরকারের প্রায় ৪ বছর সময় কেবলমাত্র পরীÿামূলকভাবে থ্রিজি চালু করতে লেগে যাওয়ার কথা ছিল না। এই কাজটি করতে গিয়ে আমাদের টিএন্ডটি মন্ত্রণালয় অহেতুক গড়িমসি করেছে এবং প্রযুক্তিবান্ধব প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছাকে শস্নথ করিয়ে দিয়েছে। থ্রিজি লাইসেন্সিং গাইডলাইন যদি এই সরকার ২০০৯ বা ১০ সালে দিতে পারতো তবে সরকারের সংশিস্নষ্ট মন্ত্রণালয়কে দÿ বলা যেতো। দুনিয়ার সর্বত্র, এমনকি দÿিণ এশিয়ার আফগানিস্ত্মান ছাড়া সকল দেশে এই প্রযুক্তি চালু হবার পরে কেবলমাত্র গাইডলাইন প্রস্তুত করতে ২০১২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত্ম সময় নেয়াটা কোনোভাবেই প্রশংসা করার মতো কাজ নয়। অন্যদিকে মার্চ মাসে গাইডলাইন হাতে পাওয়ার পর কেবলমাত্র একটি সভা করতে অক্টোবর মাস পর্যন্ত্ম সময় নেয়া মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়।
যাহোক, আমরা স্মরণ করতে পারি, বাংলাদেশ সরকারের টেলি যোগাযোগ বিষয়ক সাবেক মন্ত্রী রাজিউদ্দিন রাজু ২০১২ সালের মাঝেই থ্রিজির লাইসেন্স প্রদান সম্পন্ন করার অঙ্গীকার করেন। গত ২৪ জুন ১২ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে তিনি এই অঙ্গীকার করেন। ২৪ জুন রাতে প্রচারিত বাংলাদেশ টেলিভিশনের খবরে বলা হয়, সংসদে প্রদত্ত প্রশ্নোত্তর পর্বের জবাবে রাজিউদ্দিন রাজু জানান যে, এখন তার মন্ত্রণালয় বিটিআরসি প্রদত্ত গাইডলাইন পরীÿা-নিরীÿা করছে। খুব শিগগিরই এই গাইডলাইনটি নিয়ে সংশিস্নষ্ট স্ট্যাক হোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে এবং এরপর সেই গাইডলাইনটি বিটিআরসির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। এই গাইডলাইনটি অনুসরণ করে ২০১২ সালের মাঝেই থ্রিজি প্রযুক্তির লাইসেন্স প্রদানের কাজ সম্পন্ন করা হবে বলে তিনি জাতীয় সংসদের স্পিকারের সামনে সদস্যদের কাছে প্রতিশ্রম্নতি প্রদান করেন। যদিও তার সেই প্রতিশ্রম্নতি সরকারের আরেকটি প্রতিষ্ঠান বিটিআরসির সময়সীমার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
এর আগে বিটিআরসি থ্রিজি লাইসেন্স প্রদানের গাইডলাইন প্রস্তুত করে সেটি অনুমোদনের জন্য টিএন্ডটি মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সেই পরিকল্পনা মতে চলতি বছরের নভেম্বর মাসে ৫টি মোবাইল অপারেটরকে থ্রিজি, ৪জি এবং এলটিই লাইসেন্স প্রদান করার কথা ছিল। কিন্তু টিএন্ডটি মন্ত্রণালয় যথাসময়ে উদ্যোগ না নেয়ার ফলে এটি নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, নভেম্বর নিলামটি অনুষ্ঠিত হবে না। ইতোমধ্যে তারা সেটি জানিয়েও দিয়েছে।
এই সরকার যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠান ঘোষণা দেয় তখন আমরা থ্রিজি ২০০৯ সালে পাবো বলে আশায় বুক বেঁধেছিলাম। সেটি ২০১০ বা ‘১১ সালেও পাইনি। সর্বশেষ ২০১২ সালের স্বাধীনতা দিবসে বিটিসিএলের থ্রিজির উদ্বোধন হবে বলে ঘোষণা পেয়েছিলাম। অবশেষে স্বাধীনতা দিবসের পর ৫টি মাস লাগলো থ্রিজির যুগে প্রবেশ করতে।
একটি অতি গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয়ে আমি টিএন্ডটি ও বিটিআরসির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি। তারা ২০১২ সালে যে কাজটি করেছে সেটি যদি ২০০৯ সালে করতো তবে ৫টি অপারেটর থেকে ৫০ কোটি টাকা লাইসেন্স ফিস এবং অন্ত্মত ৫ কোটি টাকা করে বছরে ২৫ কোটি হিসেবে তিন বছরে আরো ৭৫ কোটি টাকার বাড়তি লাইসেন্স নবায়ন ফিস পেতো। এই খাতে সহজ হিসেবে ১২৫ কোটি টাকার রাজস্ব আসতো। একই সঙ্গে সরকার রেভেনিউ শেয়ারিং পেতো ৩ বছরের। এই অঙ্কের পরিমাণটা আমি জানি না। তবে এতে হাজার কোটি টাকারও বেশি হতে পারতো। এ ছাড়াও দেশের জনগণ শতকরা ১ ভাগ সামাজিক দায়বদ্ধতার টাকায় প্রযুক্তির উৎকর্ষতা দেখতে পেতো। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই এটি তাদের কাছে জানতে চাওয়া যায় না যে, থ্রিজি লাইসেন্স দিতে বিলম্ব করার ফলে জাতির প্রযুক্তিগত ÿতির পাশাপাশি যে আর্থিক ÿতি হলো তার দায় কার?
পত্রিকার খবর অনুসারে ২জিতে গতি হলো ৫৬ থেকে ১১৫ কিলোবিট। ৩জিতে গতি হতে পারে ২১ এমবিপিএস এবং ৪ জিতে এই গতি হতে পারে ১২৮ এমবিপিএস। খুব সহজেই এটি উপলব্ধি করা যায় যে, মূলত গতিটাই থ্রিজি বা ৪ জির প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই গতির জন্য প্রযুক্তির উন্নততর স্ত্মরে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে।
আসুন আমরা আলোচনা করি থ্রিজির প্রয়োজনীয়তা কি? আমি সংÿেপে অতি প্রয়োজনীয় কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারি।
ক) ভয়েস কলের পরিপক্বতা : থ্রিজির প্রাথমিক যে সুফল মোবাইল ব্যবহারকারীরা পাবেন সেটি হলো বিদ্যমান মোবাইল প্রযুক্তির উন্নয়ন। আমরা এখন যে ২.৫ জির মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করছি থ্রিজি তার চাইতে উন্নত মানের ভয়েস কল দেবে। কল ড্রপ ও নেটওয়ার্কের শক্তিও বাড়বে।
খ) ভিডিও কল : থ্রিজির সহায়তায় ভিডিও কল করা যাবে। এর ফলে বস্তুত ভিডিও কনফারেন্স ছাড়া ভিডিও সারভাইলেন্স, নিরাপত্তা এসব অনেক বিষয়ে অগ্রগতি হলো।
গ) টিভি : থ্রিজি নেটওয়ার্কে মোবাইল ফোনে টিভি দেখার বিষয়টি যুক্ত হচ্ছে। ফলে যে কেউ যেখানে থ্রিজি নেটওয়ার্ক আছে সেখানে তার মোবাইল ফোনে টিভি দেখতে পাবেন।
ঘ) থ্রিজির সবচেয়ে বড় সুযোগটি হলো ইন্টারনেট বিষয়ক। এই নেটওয়ার্ক যেমন মোবাইল ইন্টারনেটে ব্যবহার করা যায় তেমনি এর মডেম দিয়ে কম্পিউটারে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায়। বাংলাদেশে প্রায় তিন কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর পৌনে তিন কোটিই ইন্টাররনেট মোবাইলের সহায়তায় ব্যবহার করে থাকে। এদের সবচেয়ে বড় সমস্যার নাম স্পিড। বস্তুত জিএসএম নেটওয়ার্ক দিয়ে কোনোমতে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায়। কিন্তু অডিও ভিজুয়াল ডাটা বা গ্রাফিক্স আপলোড ডাউনলোড করার ÿেত্রে বিদ্যমান জিএসএম নেটওয়ার্ক মোটেই কার্যকর নয়। থ্রিজি দ্রম্নতগতির ইন্টারনেট প্রদান করতে পারে বলে ব্যবহারকারী একে তার মতো করে ব্যবহার করতে পারে।
সার্বিকভাবে এই কথাটি খুব সহজেই বলা যায় যে, প্রচলিত মোবাইল যুগ থেকে থ্রিজি আমাদেরকে তথ্য মহাসরণির একটি প্রশস্ত্ম সড়কে স্থাপন করেছে। এই প্রশস্ত্ম সড়কটি আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্ত্মর্জাতিক সকল ÿেত্রেই অতি গুরম্নত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনবে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিÿা, স্বাস্থ্য, সামাজিকতা, প্রশাসন, শিল্পসহ এমন কোনো খাত পাওয়া যাবে না যাতে এই প্রযুক্তির প্রভাব পড়বে না।
আরেকটি বিষয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকদেরকে সতর্ক হওয়ার অনুরোধ করছি। থ্রিজির প্রসারের অন্যতম একটি বাধা হলো কনটেন্ট। বাংলাদেশের ২জি মোবাইল গ্রাহকরা নিজেরা কথা বলতে পারে বলে কনটেন্ট নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু থ্রিজির গ্রাহকরা কেবলমাত্র কথা বলাতেই তুষ্ট থাকবেন না। তাদের জন্য বাংলা ভাষার কনটেন্ট দরকার-বাংলাদেশের কনটেন্ট দরকার। কেবলমাত্র থ্রিজি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হলেই সেটির প্রতি মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়বে তেমনটি প্রমাণিত হয়নি। সামনের বছর যখন থ্রিজির প্রকৃত স্বাদ আমরা পেতে যাবো তখন যেন পর্যাপ্ত বাংলা ও বাংলাদেশী কনটেন্ট পাওয়া যায় তার দিকে এখনই নজর দিতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশটি গরিব বলে প্রযুক্তিতে আমাদের পিছিয়ে থাকাটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ হতে পারে না। বরং এটিই স্বাভাবিক যে গরিব দেশের জন্য উন্নততর প্রযুক্তির বেশি প্রয়োজন।
আমাদের স্মরণ থাকতে পারে, ১৯৯২ সালের সাবমেরিন ক্যাবল যখন আমরা ২০০৬ সালে পেলাম তখন সেই ক্যাবল ব্যবহার করার মানুষ পাওয়া গেলো না। ২০০৯ সালে শুরম্ন হয় সেই ক্যাবল ব্যবহারের প্রবৃদ্ধি। এর প্রধান কারণ ছিল ক্যাবল পাওয়ার সময়ে সেটি ব্যবহারের জন্য উপযোগিতা সৃষ্টি করা হয়নি। ২০০৬ সালে ক্যাবল লাইন উদ্বোধনের সময়ও তখনকার সরকার জানতো না যে এটি দিয়ে কী করা যায়। তাছাড়া তখন তার দামও নির্ধারণ করা হয় অনেক বেশি।
এবার আমরা যখন থ্রিজি-৪জির যুগে যাত্রা শুরম্ন করেছি তখনো আমাদের প্রস্তুতি তেমন নেই। অবিলম্বে থ্রিজির উপযোগী কনটেন্ট দিতে না পারলে থ্রিজি কেবল চেহারা দেখার কাজেই লাগবে, জাতীয় অগ্রগতিতে অবদান রাখবে না।
অক্টোবর ২০১২
মোস্তফা জব্বার : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও কলামিস্ট।