জাতিসংঘের অন্তর্বর্তী প্যানেল বা (আইপিসিসি) সম্প্রতি জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে একটি রিপোর্ট পেশ করেছে যা সত্যিই উদ্বেগের। এই রিপোর্টকে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস “code red for humanity” বা মানবতার জন্য লাল সতর্কবার্তা বলে উল্লেখ করেছেন। আইপিসিসি তাদের রিপোর্টে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি উদ্বেগজনক পূর্বাভাস সামনে এনেছে, তারা বলছে যে আগামী দুই দশকে গোটা বিশ্বের তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে, যার জেরে অত্যধিক গরম আবহাওয়া, দীর্ঘস্থায়ী বর্ষা এবং খরার প্রকোপ বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণ এশিয়ার জলবায়ু পরিবর্তনের লক্ষণ দীর্ঘদিন ধরেই স্পষ্ট। সমুদ্র স্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং বন্যা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার মত উপকূলীয় দেশগুলিকে হুমকির মুখে ফেলেছে। নেপালে তাপমাত্রা বাড়ার জেরে হিমবাহ গলে যাচ্ছে। আফগানিস্তান, ভূটানে দেখা দিচ্ছে খরার প্রকোপ। শুধু তাই নয় সেই দিন বেশি দূরে নয় যখন মালদ্বীপের মত ঘনবসতিপূর্ণ দ্বীপরাষ্ট্র তলিয়ে যাবে সমুদ্রের গহ্বরে, এমনটাই ইঙ্গিত দিচ্ছেন আইপিসিসি-র বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্বব্যাংকের মতে, গত দশকে জলবায়ু সংক্রান্ত দুর্যোগে কমপক্ষে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন যা দক্ষিণ এশিয়ার জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। জার্মানওয়াচের ২০২০ গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সে ২১ শতকে জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ২০ টি দেশের মধ্যে স্থান পেয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। সাম্প্রতিককালে ম্যাককিন্সি গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, ২০৫০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির জিডিপির ওপর জলবায়ুর প্রভাব ব্যাপকহারে পড়তে চলেছে। আইপিসিসি রিপোর্ট ভারতের ভূমি বিজ্ঞান মন্ত্রকের ২০২০ সালের গবেষণার মতো একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, যা পূর্বাভাস দিয়েছিল যে আগামী দশকগুলিতে ভারত শুষ্ক এবং গরম হয়ে উঠবে, শতাব্দীর শেষের দিকে গড় তাপমাত্রা প্রায় ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে। ভারত মহাসাগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং সেই সঙ্গে সমুদ্রের জলস্তর প্রায় ১ ফুট বেড়ে যেতে পারে বলে বলেও পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। পানির সংকটের কারণে ভারত, পাকিস্তান এবং চীনের মধ্যে সিন্ধু নদ নিয়ে টানাপোড়েন বাড়ছে। কারণ পাকিস্তানের প্রধান পানির উৎস হল সিন্ধু নদ, যা ভারতের কাশ্মীর থেকে প্রবাহিত হয়েছে । এখানেই শেষ নয়, জলবায়ুর প্রভাব পড়তে পারে পরিযায়ীদের ওপর। ২০১৮ সালে বিশ্ব ব্যাংকের একটি সমীক্ষা বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার ৪০ মিলিয়ন পরিযায়ী, যাদের মধ্যে বাংলাদেশেরই শুধু ১৩ মিলিয়ন, তাঁরা একটি নির্দিষ্ট জলবায়ু নীতির সমস্যায় ভুগবেন। গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসনের ফলে শহরে সম্পদের সংকট দেখা দিতে পারে, যা মানুষের মৌলিক প্রয়োজনীয়তার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে। আইপিসিসি রিপোর্টে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে নগরায়ণ তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং বন্যাকে আরও ত্বরান্বিত করবে। তথাকথিত দুর্বল জনগোষ্ঠী যেমন পাকিস্তানের বন্যায় গৃহচ্যুত পশতুন, ভারতে খরার জেরে বাস্তুচ্যুত মুসলমান, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে বন্যাকবলিত শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনায় গণআন্দোলন, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও সহিংসতা বাড়তে পারে। আইপিসিসির প্রতিবেদনের অন্যতম প্রধান বার্তা হল, শক্তিশালী নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে জলবায়ু বিপর্যয় এড়ানোর এখনও সময় আছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলি এই জাতীয় অনেক নীতি প্রণয়ন করলেও এর দুর্বল প্রয়োগ এবং অপর্যাপ্ত অর্থের জেরে তা বাস্তবায়িত হয় নি। আরও কিছু প্রয়োজনীয় সংশোধনী দরকার- যেমন অ-কৃষি জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি এবং জলবায়ু নিয়ে যারা কাজ করছেন সেই সমস্ত সামনের সারিতে থাকা কর্তাদের আরো সক্রিয় ভূমিকা পালনের মানসিকতা। যদিও এতে নানারকমের কূটনৈতিক বাধা আসবে, তবুও হাল ছাড়লে চলবে না। কারণ বিশ্ব পরিবেশগত স্থায়িত্ব তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলি একেবারে নিচের দিকে রয়েছে। আগামী দশকগুলিতে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভূখণ্ড ছাড়াও পানি নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হতে পারে এবং আফগান শরণার্থীরা কেবল যুদ্ধ নয় খরা থেকে বাঁচতেও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারেন। তাই ভূবিজ্ঞানীরা সবাইকে সতর্ক করে বলছেন, এখনো সময় আছে খুব বেশি দেরি হয়ে যাবার আগে সতর্ক হন, তাহলেই একমাত্র বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব ধরিত্রী মা-কে।