জাতীয় মাছ ইলিশ আমাদের ঐতিহ্যের ধারক-বাহক হলেও এখন সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। গরিবরা এ মাছের স্বাদ নিতে পারে না। জাটকা কিংবা কিশোর ইলিশ খেয়ে ইলিশের স্বাদ নিতে পারছে কোনো রকম। দু�প্রাপ্যতা ও দুর্মূল্যে কখনও কখনও তাও সম্ভব হয় না।
ইলিশ এখন গরিবের মাছ নয়, শুধুমাত্র বিত্তশালী মানুষ ও ভুঁইফোঁড় মৎস্য ব্যবসায়ীদের মাছ। ভরা মওসুমেও এক কেজি বা তার চেয়েও কম-বেশি এক একটা ইলিশের দাম কমপক্ষে ৯শ� টাকা থেকে হাজার ১২শ� টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৪/১৫শ� টাকা। আর কিশোর তথা �টেম্পু� ইলিশের কেজি ৪ থেকে ৫শ� টাকা। সাগর ও নদ-নদীতে আহরিত ইলিশের পুরোটাই চলে যায় জেলেদের হাত ঘুরে দাদনদার, আড়তদার, মৎস্য ব্যবসায়ী, চালানী ও হিমাগারে মজুদদারদের দখলে। দাম কমানোর কোনো সুযোগ নেই। সব সময় তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে জাতীয় মাছ ইলিশ। সরকার দেশের মানুষ যাতে মওসুমে ইলিশ কম দামে খেতে পারে সে জন্যে বিদেশে রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু প্রতিদিনই চাঁদপুর সহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিপুল পরিমাণ ইলিশ সীমান্ত এবং সমুদ্র বন্দর দিয়ে বাইরের দেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। রপ্তানি নিষিদ্ধ থাকলেও পাচার থেমে নেই। রপ্তানি নিষিদ্ধ করে ইলিশকে আরো দুর্মূল্য করা হয়েছে এমনটা মনে করছেন পর্যবেক্ষক মহলের অনেকে। দাদনদার, আড়তদার, মজুদদারদের কৌশলের কারণে ইলিশ দুর্মূল্য হয়ে গেছে বলে মনে করছেন অভিজ্ঞ কেউ কেউ।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, দেশে ইলিশের আহরণ বেড়েছে। তারপরও সাধারণ মানুষ ভর মওসুমেও ইলিশের স্বাদ নিতে পারছে না। নদ-নদীর অন্যান্য মাছের চেয়ে ইলিশের দাম দুই গুণ, তিন গুণ বেশি। চাঁদপুর কণ্ঠের এ প্রতিবেদক জেলে, দাদনদার, আড়তদার, হিমাগার মালিক, সাধারণ মৎস্য ব্যবসায়ী, সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা, গবেষক, প্রবীণ ব্যক্তি ও সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে ইলিশের দুর্মূল্যের বিষয়ে অনেক না জানা তথ্য পেয়েছেন।
প্রকৃত পক্ষে ইলিশ হচ্ছে সাগরের নোনা জলের মাছ। বংশবৃদ্ধির প্রয়োজনে এই ইলিশ পরিযায়ী তথা ভ্রমণকারী মনোবৃত্তি প্রদর্শন করে। এজন্যে প্রজনন মওসুমে নোনা জল ছেড়ে সাগরের সাথে সংযোগ রক্ষাকারী মিঠা নদীর পানিতে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে যায় ইলিশ। নদীতে এসে ডিম ছাড়ে। ডিম থেকে হয় শিশু তথা জাটকা। তারপর কিশোর-তরুণ হয়ে ফিরে যায় সাগরে। এক সময় পরিণামদর্শী জেলেরা এমন বড় ফাঁস বা ছিদ্রওয়ালা জাল ব্যবহার করতো, যাতে কেবল পরিপক্ক ইলিশই ধরা পড়তো, শিশু বা জাটকা কিংবা কিশোর-তরুণ তথা টেম্পু ইলিশ মোটেও ধরা পড়তো না। কালক্রমে বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা ও রপ্তানির লোভে ইলিশ ব্যাপক আহরণের তাগিদ বাড়ে। এতে লোভী ও অপরিণামদর্শী মৎস্য ব্যবসায়ীদের প্ররোচনায় জেলেরা ছোট ফাঁসযুক্ত বহুবিধ ক্ষতিকর জাল ব্যবহার করে জাটকা-টেম্পু সহ সকল বয়সী ইলিশ মাছ নির্বিচারে নিধন শুরু করে। সরকার কারেন্ট জালের ফ্যাক্টরী বন্ধ না করে জলাশয়ে এ জালের ব্যবহার নিষিদ্ধ এবং জাটকা নিধন রোধের কার্যক্রম গ্রহণ করেও ইলিশ রক্ষায় ফলপ্রসূ হতে পারছে না। সেজন্যে ইলিশ ক্রমশঃ দুর্মূল্য ও দু�প্রাপ্যতার দুর্ভাগ্যজনক অভিধা ললাটে ধারণ করতে যাচ্ছে। দূরদর্শীদের কেউ কেউ বলছেন, এমন দুঃসময় হয়তো একদিন আসবে, যেদিন ইলিশ খাবার প্লেটে নয়, ড্রইং রুমের দেয়ালে ছবি হিসেবেই স্থান পাবে।
অধিক স্বাদের মাছ ইলিশ। এক সময় এ মাছ সহজেই সাধারণ মানুষ খেতে পারতো। চারআনা আট আনায় মিলতো হালি হালি পরিপক্ক ইলিশ। মাছের সাইজও ছিলো বড়। সেই পরিমাণ একটা ইলিশের বর্তমান বাজার দর দেড়/দুই হাজার টাকায়ও মিলছে না। মেঘনার স্থানীয় ইলিশ খাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। যারা সামর্থ্যবান তারা হয়তো এর স্বাদ নিতে পারে। কম আয়ের মানুষ ইচ্ছে করলে এখন ইলিশ খেতে পারে না।
ইলিশ মাছের ব্যবসা করে চাঁদপুরে অনেক মৎস্য ব্যবসায়ী ধনাঢ্য হয়েছেন। শহরে গড়ে তুলেছেন অনেক অট্টালিকা। আধুনিক যুগে মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ উন্নত হওয়ায় সাধারণ মানুষ যেখানে ইলিশ কম দামে পাবার কথা সেখানে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। ইলিশ নিয়ে প্রতারণাও কম হচ্ছে না। চট্টগ্রাম থেকে বার্মার ইলিশ, অনেক দিনের বরফ দেয়া ইলিশের চালান এনে লোকাল মাছ বলেও চালিয়ে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। মাছের সতেজতা ধরে রাখার জন্য ইলিশে ফরমালিন না দিয়ে এখন বরফে ফরমালিন দেয়া হচ্ছে বলেও একটি সূত্র জানায়। লোকাল, বার্মার এবং নামার ইলিশ চেনার উপায় নেই। জেলেদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, তাদের আহরিত ইলিশ মানুষের কাছে পৌঁছতে ৫ বার হাত বদল হয়। জেলেরা ইলিশ ধরে যে দাম পাচ্ছে বাজারে সেই ইলিশ দুই গুণ তিন গুণ দামে বিক্রি হয়। জেলেরা কম দামে মাছ দিচ্ছে ঠিকই কিন্তু সাধারণ জনগণকে দুই গুণ তিন গুণ দাম দিয়ে মাছ কিনতে হচ্ছে। মাছের আমদানি বেশি হলে এর বড় অংশ চলে যায় হিমাগারে। ইলিশের সরবরাহ স্থানীয় হাট-বাজারে স্বাভাবিক না রেখে এখান থেকে ইলিশের সব চালান অন্যত্র পাঠানো এবং মজুদ করে রাখার দরুণ চাঁদপুরের মানুষ কম দামে ইলিশ কিনতে পারছে না।
সরজমিনে চাঁদপুর মাছঘাট সহ নদী তীরবর্তী পরিচিত ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, ইঞ্জিন চালিত জেলে নৌকার দাপট, পিক-আপ ভ্যানের ব্যাপক চলাচলের দরুণ এখন ইলিশের চালান ট্রেনের বগিতে যায় না। চাঁদপুর রেলওয়ে এলাকায় অহরহ ট্রাক, পিক-আপ ঢুকে ইলিশের চালান নিয়ে যাওয়ায় সরকার রেলওয়ের রাজস্ব আয় থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। সহজ যোগাযোগ মাধ্যম পেয়ে চাঁদপুরের ইলিশ চাঁদপুরে সরবরাহ হয় না। চলে যায় হাত ঘুরে জানা-অজানা পথে দূরে বহু দূরে।
দেশে-বিদেশে চাঁদপুরের ইলিশের বেশ পরিচিতি রয়েছে। ইলিশের রাজধানী বলা হয় চাঁদপুরকে। এ কারণে এ জেলায় প্রশাসনের যাঁরাই কর্মকর্তা আছেন, তাঁদের এবং বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের আত্মীয়স্বজন দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন যারা, তারা চাঁদপুরের ইলিশ খেতে চান। ইলিশের রাজধানীতে কম দামে ইলিশ পাবার আশায় ফোন করেন। কিন্তু দাম শুনে তারা হন অবাক। এভাবে চাঁদপুরে পেশাগত কারণে অবস্থানকারী চাকুরিজীবী বা অন্যরা নিজেরা ইলিশ কিনে না খেলেও আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু বান্ধবের জন্যে দুর্মূল্যে কিনে পাঠিয়ে চক্ষুলজ্জা দূর করেন।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যান মতে, ২০০৩ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ইলিশের আহরণ বিগত বছরগুলোর চেয়ে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। বর্তমানে প্রায় ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৫শ� মেট্রিক টন ইলিশ আহরণ হচ্ছে। মাছের আহরণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এর দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না।
এখলাছপুরের সুনীল মহাজনের জেলে নৌকার জেলে বিল্লাল (৪০), জসিম (৪৫) জানান, তারা ইলিশ সিজনে গোবিন্দিয়া মেঘনা নদীতে মাছ ধরেন। এ মওসুমে তারা আশানুরূপ মাছ পাচ্ছেন না। ধার দেনা করে নদীতে আছেন। আশায় আছেন সামনের �জোবায়� মাছ পাবেন। তারা জানান, যে মাছই এখানে ধরা পড়ছে এ মাছটা বাইরে যদি না যায়, এক্সপোর্ট না করে তাহলে এখানকার মানুষ ইলিশ খেতে পারে।
হরিণা মাছঘাটের অভিজ্ঞ আড়তদার হারুন খান (৫৫) জানান, ইলিশ অধিক সুস্বাদু হওয়ায় সব মানুষের কাছে শখের এবং রাজকীয় মাছ। সবাই ইলিশ বেশি পছন্দ করে এজন্যে দামও বেশি। কিছু লোক মাছ স্টক করে। সেজন্যে কিছুটা দাম কমলেও আবার যেই সেই হয়ে যায়। বাজারে যখন মাছ থাকে না তখন তারা বিক্রি করেন। আবার বাইরে পাচার করেন।
দাদনদার আহছান ছৈয়াল (৫৫) জানান, জাটকা মওসুমে শ� শ� মণ জাটকা ধইরা মাছের ক্ষতি করা হয়। তারপরও যে মাছ পাওয়া যায়, তাতে বলি�আমাগো দেশের মাছ আমাগো দেশে রাহেন, দেহি গরিবরা কেমনে ইলিশ খাইতে পায় না।
মাদারীপুর থেকে আসা মেঘনায় ইলিশ শিকারী জেলে রিপন মালত (৪৮) জানান, এ নদীতে মাছ কম। তিনি আড়তে গিয়া মাছ বিক্রি করেন। এখান থেকে মাছ কই যায় জানেন না। এখানের মাছ এখানে থাকলে সবাই খেতে পারতো।
চাঁদপুর সদর উপজেলার কমলাপুর গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি হাজী আঃ মান্নান ফরাজী (৮০) জানান, এক সময় ১ টাকা ৪ আনা দিয়ে এক হালি মাছ কিনেছেন। সে সময় সবাই মাছ খাইছে। এখন ইলিশের দাম শুনে খাওনের নাম মুখে লয় না। মেঘনা নদীতে ইলিশের উৎপাদন কমে যাওয়ায় এমনটি হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
পুরাণবাজারের মাছ বিক্রেতা অজিত দাস (৫০) জানান, ২৫ বছর যাবৎ বাজারে খুচরা মূল্যে ইলিশ মাছ বিক্রি করেন। অনেক আগে দেড় কেজি ওজনের ইলিশ দেড় টাকায় বিক্রি করেছেন। এখন সেই মাছ দেড় হাজার টাকায়ও পাওয়া যাবে না। তিনি আরো জানান, জেলে মাছ ধরে অস্থায়ী আড়তে দেয়। পাইকার কিনে বড় আড়তে দেয়। এরপর চালানী কিনে চালান দেয়। তার কাছ থেকে আরেক পাইকার কিনলে এরপর পাবলিকের কাছে যায়। এভাবেই ইলিশের দাম বাড়ে। দেশের ইলিশ যদি দেশে থাকে তাহলে গরিবরা খেতে পারবো। ধনীরা কোল্ডস্টোর বানাইছে, ভইরা থুইলেই দাম বাড়ে।
চাঁদপুরের মৎস্য রপ্তানিকারক শাহিদুর রহমান চৌধুরী জানান, মেঘনা নদীতে লোকাল মাছের উৎপাদন কমে গেছে। নদীর গভীরতা হ্রাস পাওয়ায় মাছ উজানে আসতে পারছে না। মৎস্য গবেষণা রিপোর্টে ইলিশের উৎপাদন সাগরে বেড়েছে, নদীতে নয়। তিনি মনে করেন, ইলিশ স্টক করলে ইলিশের বাজার স্থিতিশীল হয় এবং বারো মাসই মানুষ ইলিশ খেতে পারে। তিনি বলেন, ইলিশের দাম বেড়ে যাওয়ায় জেলেরা তার ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে। মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষও কিনতে পারছে।
মৎস্য রপ্তানিকারক হাজী আঃ মালেক খন্দকার জানান, মাছও নাই, আমদানিও নাই। এবার সিজন খুব খারাপ যাচ্ছে। বিগত দিনে যে পরিমাণ মাছ লোকালে পাওয়া যেতো তার একশ� ভাগের একভাগও মাছ নেই। আগে আমাদের নদীর পানি থাকতো মিঠা। বুড়িগঙ্গার দূষণের প্রভাব এখানে পড়েছে, তাই পানি অন্য রকম। নদীতে ডুবো চর। স্রোত কমে গেছে। অবৈধ জালের ব্যবহার, জাটকা নিধন এসব কারণে ইলিশ কমে গেছে। সাগরের ইলিশের উপর নির্ভর এখন চাঁদপুরের ইলিশের বাজার। মাছের আমদানির উপর দর কম-বেশি হয়। সরকার রপ্তানি বন্ধ করলেও এর সুফল জনগণ পাচ্ছে না। ইলিশ পাচার হয়ে গেলে পাবলিক কম দামে মাছ খেতে পারবে কোত্থেকে।
ইলিশ মজুদ করে রাখা প্রসঙ্গে আঃ মালেক খন্দকার বলেন, চট্টগ্রামে ৩০ থেকে ৪০টা হিমাগার আছে। খুলনা-বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাছ মজুদ হচ্ছে। ইলিশ প্রক্রিয়াজাতকরণ করে রাখায় জেলেরা উচিত দাম পাচ্ছে।
চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সফিকুর রহমান জানান, জনগণ সিজনে যাতে কম দামে ইলিশ পায় সেজন্যে সরকার অফিসিয়ালি মাছ রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে। বাইরে কীভাবে মাছ পাচার হয় বা কই যায় সেটা কাস্টমস্ জানে। তিনি তার পূর্ব অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে বলেন, ১ টাকা চারআনায় একটা ইলিশ লালমাই পাহাড় এলাকায় থাকা অবস্থায় কিনেছি। সেই মাছের এখন অবিশ্বাস্য দাম হবে।
চাঁদপুর সদর উপজেলার রঘুনাথপুর গ্রামের রিক্সা চালক হোসেন বেপারী (৭০) বলেন, ৬০-৬২ সালে এক টাকায় ৪টা (এক হালি) ইলিশ কিনেছি। তখন মানুষ প্রতিদিন ইলিশ মাছ খেতে খেতে এক পর্যায়ে খেতে চাইতো না। সেই মাছ ৪/৫ হাজার টাকায়ও এখন পাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, সারাদিন রিক্সা চালিয়ে চালের টাকা রোজগার করা কষ্ট। ইলিশ মাছ খাই কীভাবে। মাছের এখন যে দাম! পুকুরের ঝিউল পাঙ্গাস আর তেলাপিয়া মাছ খেয়ে মাছের স্বাদ নিচ্ছি। প্রবীণ এ ব্যক্তির মতে, এক শ্রেণীর পয়সাওয়ালা �বড় লোক� এখানের মাছ পাচার করে দেয়। বর্ষায় ইলিশ ৪/৫শ� টাকা হলে গরিবরা এ মাছ খেতে পারতো।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নদী কেন্দ্র, চাঁদপুর-এর ইলিশ গবেষক ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ আনিছুর রহমান জানিয়েছেন, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এ দু মাস ইলিশের ভরা মওসুম। সে সময় আসলে ইলিশ প্রচুর ধরা পড়বে। দেশের মোট ইলিশ উৎপাদন সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। তিনি আরো বলেন, চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে ইলিশ উৎপাদন কম হচ্ছে। এর কারণ বঙ্গোপসাগর মুখে ডুবোচর, মেঘনা নদীতে চর-ডুবো চর, নদীর গভীরতা হ্রাস, পরিবেশগত পরিবর্তন, নদী দূষণ, নির্বিচারে জাটকা নিধন, অধিক মাত্রায় ডিমওয়ালা ইলিশ আহরণ, কারেন্ট জালের অবাধ ব্যবহার ইত্যাদি। এতে ইলিশ সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। বারো মাস এবং সিজনে পর্যাপ্ত ইলিশ পাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের গবেষণা অব্যাহত রয়েছে। গবেষণায় সরকারকে সুপারিশও করা হচ্ছে। ইলিশ সম্পদ আহরণ সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্যে জেলে, জাল ব্যবসায়ী, মৎস্য আড়তদার, দাদনদার, প্রশাসন ও সর্বোপরি জনগণকে হতে হবে সচেতন। সকলে আন্তরিক না হলে জাতীয় মৎস্য সম্পদ রক্ষা সম্ভব হবে না। ইলিশ সরবরাহ স্থানীয়ভাবে পর্যাপ্ত রাখা হলে সাধারণ মানুষ মওসুমে দু একটা পরিপক্ক ইলিশ খেতে পারবে। এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আরো জানান, মানুষের জীবন যাত্রা ব্যয় বহুল হওয়ায় ইলিশ আহরণে জেলেদের খরচও অনেক বেড়ে গেছে।
আরেক মৎস্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক ড. কামাল এক বছর হয় চাঁদপুর থেকে অন্যত্র বদলি হয়ে গেছেন। মুঠোফোনে আলাপকালে দুর্মূল্যের ইলিশ সম্পর্কে বলেন, ইলিশের মওসুম সব সময় একই রকম হয় না। নদীর গভীরতা না থাকায় বিশেষ করে সাগর মোহনা এবং উপকূলীয় এলাকায় ডুবোচরের কারণে ইলিশ উজানে আসতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ইলিশ রপ্তানিযোগ্য পণ্য হওয়ায় বিদেশে রপ্তানির প্রভাবে স্থানীয়ভাবে মাছের সরবরাহ কম। এজন্যে দামও বেশি। নদ-নদীর অন্যান্য সুস্বাদু মাছের উৎপাদনও বিভিন্ন কারণে কমে গেছে। মাছের উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে পানি আর মাছে সমান থাকবে। কিন্তু আমরা তা মানছি না। যে যার মতো করে নদ-নদীর মৎস্য সম্পদ ধ্বংস করার জন্য তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছি। প্রজনন ক্ষেত্র ও জাটকা সংরক্ষণে যেসব ব্যবস্থাপনার কৌশল রয়েছে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন এবং নদ-নদী শাসন করে গভীরতা সৃষ্টি করতে পারলে ইলিশসহ অন্যান্য মাছের উৎপাদন আরো অনেক অনেক বৃদ্ধি করা সম্ভব।
চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমান কালু ভূঁইয়া জানান, আমদানির ওপর ইলিশের দাম কম-বেশি হয়। পর্যাপ্ত পরিমাণ ইলিশ আহরিত হলে ৩২/৩৩ হাজার টাকা মণ মাছের দর থাকতো। গত বছর তার নিজ আড়তে যে পরিমাণ ইলিশ আমদানি হয়েছিলো এ বছর মওসুমের দুই মাস চলে গেলেও ৫০ ভাগের এক ভাগও মাছ আসেনি। প্রচুর অর্থ লগ্নি করে তারা খুবই বেকায়দায় আছেন। এবার ইলিশ মওসুম খুব খারাপ যাচ্ছে। নদীতে মাছ না থাকলে গরিব বা ধনী মাছ খাবে কিভাবে। তার মতে, এবার প্রজনন মওসুমে নির্বিচারে জাটকা নিধন হয়েছে। যার প্রভাব ইলিশ উৎপাদনে মারাত্মকভাবে পড়েছে। জাটকা বাস্তবে রক্ষা পায়নি। তিনি আরো জানান, গত বছর শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে প্রচুর ইলিশ চাঁদপুরে আমদানি হয়েছে। সে সময় আড়তে মাছের আকার বুঝে ৪ থেকে ৫শ� টাকা কেজিতে মাছ বিক্রি হয়েছে। ব্যাপক জাটকা নিধনের কারণে মওসুমের কয়েক মাস চলে গেলেও মাছের তেমন আমদানি মিলছে না। সামনের দুই মাস আশানুরূপ মাছ পাওয়া না গেলে চাঁদপুরের মৎস্য ব্যবসায়ীরা এ মওসুমে চরম লোকসানের মুখে পড়বে। কালু ভূঁইয়ার মতে, গরিব কেনো আগামী প্রজন্মের জন্য জাটকা সংরক্ষণ জোরদার করা না হলে এখন ইলিশের যেই দাম সে দামেও কারো ভাগ্যে ইলিশ জুটবে না। যেসব স্থান দিয়ে জাটকা নিধন হয় তা চিহ্নিত করে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রশাসনকে এ ক্ষেত্রে হতে হবে আন্তরিক। জাতীয় মৎস্য সম্পদ বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে জনগণকে হতে হবে সচেতন। মাছের আমদানি পর্যাপ্ত হলে সরবরাহ যেমন বেড়ে যাবে তেমনি মাছের দামও সাধারণ মানুষের নাগালে থাকবে।
ক্যাব চাঁদপুর সভাপতি ও প্রবীণ ব্যক্তি জীবন কানাই চক্রবর্তী জানান, গ্রামে থাকাবস্থায় মৈশাদীর শেখেরহাট বাজার থেকে ৪ আনায় এক হালি (৪টা) ইলিশ কিনেছেন এক সময়। এখন সেই ইলিশের দাম পড়বে ৬/৭ হাজার টাকা। তখন জেলেরা জাটকা ধরতো না, পাবলিকও খেতো না। এখন তো প্রজনন মওসুমে ব্যাপক হারে জাটকা নিধন হয়। সেজন্যে মাছের উৎপাদনও কমে গেছে। সেই সুবর্ণ সময় আর আসবে না। তিনি মনে করেন, প্রাকৃতিক পরিবেশগত বিপর্যয়, মেঘনা নদীতে অসংখ্য ডুবোচরের বাধার কারণে সাগর থেকে ইলিশ নদীতে আসতে পারছে না। �জো�র উপর নির্ভর করে ইলিশ ধরা পড়ে বেশি। সামনের �জো� আসলে বুঝা যাবে ইলিশের আমদানি। আমরা জাটকা নিধন রোধে সাফল্যের যতই ঢাকঢোল পিটাই না কেনো জাটকা ধ্বংস করার কারণে ইলিশ দুর্মূল্য হয়ে পড়েছে।
একটি সূত্র জানায়, চাঁদপুরের মৎস্য আড়তদাররা দক্ষিণাঞ্চলে এবং চাঁদপুর মেঘনা অববাহিকায় নদী তীরবর্তী অস্থায়ী আড়তগুলোতে লোক নিয়োগ করে জেলেদের দাদন দিয়ে থাকে। নোয়াখালীর হাজীমারা থেকে হাইমচর-চাঁদপুর সদর থেকে ষাটনল পর্যন্ত মেঘনার ১০০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা সহ এসব স্থান থেকে তারা জেলেদের মাছ ক্রয় করেন। ক্রয়কৃত সেই মাছ চাঁদপুরের আড়তে এনে তাদের দাদনের টাকা হিসেব করে লাভ রেখে বিক্রি করেন। এক সাথে শত শত মণ ইলিশ চালানীরা কিনে নেন। চাঁদপুরের হাট-বাজারের মাছ ব্যবসায়ীদের একসাথে এত মাছ কেনার কোনোভাবেই সামর্থ্য হয় না। এই সুযোগে চালানীরা প্রক্রিয়াজাতকরণ করে রাখার নাম করে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে পাঠিয়ে দেয়। চাঁদপুরে আসা ইলিশের একটা অংশ চাঁদপুর ও চট্টগ্রামের হিমাগারেও নিয়ে যাওয়া হয়। এজন্যে স্থানীয়ভাবে ইলিশের সরবরাহ কমে যায়। সরবরাহ সহনীয় পর্যায়ে না থাকায় মওসুমের এক একটা পরিপক্ক ইলিশ যেখানে ৪/৫শ� টাকায় পাবার কথা, মাছ কম এ অজুহাতে তা হাজার বারোশ� টাকায় বিক্রি করা হয়। কিন্তু এতো দাম দিয়ে ক�জনেরই সৌভাগ্য হয় ইলিশের স্বাদ নেয়া?
সরজমিনে মৎস্য আড়তগুলোতে তাকালেই দেখা যায়, এক শ্রেণীর পাইকার আড়তদারদের কাছ থেকে মূলধন নিয়ে জেলেদের মাছ কিনে নিচ্ছে। সেই মাছ চাঁদপুরের মানুষ চোখে দেখতে পায় না। হাত ঘুরে চাঁদপুর থেকে বিভিন্ন দিকে চালান করে দিচ্ছে। যার সিংহভাগ বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্ত এলাকা দিয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এখানকার মৎস্য চালানীদের দাবি, এক সাথে এতো মাছ এখানকার মানুষ খেতে পারবে না। তাই তারা দেশের অভ্যন্তরে চালান করছে। সেখান থেকে ইলিশ কোথায় যায় তা তাদের জানার বিষয় না। অপর একটি সূত্র জানায়, নদী তীরবর্তী অস্থায়ী আড়তগুলোর মাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রণে জেলেরা ইলিশ শিকার করে। আহরিত ইলিশ স্ব স্ব জেলের আড়তেই বিক্রি করা বাধ্যতামূলক। জেলেদের বিক্রিত মাছের মোট টাকার মধ্যে আড়তদার অর্থাৎ দাদনদার শতকরা ১২ টাকা থেকে ১৫ টাকা কেটে রাখে। বড় আড়তদার বেপারীর মাধ্যমে নদীর পাড়স্থ আড়ত থেকে মাছ কিনে এক সাথে স্তূপ করে ঘাটে নিয়ে আসে। সেই মাছ পাইকারদের কাছে বাজার দরে মাছের সাইজ বুঝে বিক্রি হয়। বিক্রিত মাছের মোট পরিমাণ ও টাকার হিসেবে প্রতি মণে আড়তদারি নেয় ৪ থেকে ৫শ� টাকা। একদিনে লোকাল ও নামার প্রচুর ইলিশ ঘাটে আমদানি হলে মাছের বাজার দর অনেক কমে যায়। এ সুযোগ কাজে লাগায় যাদের বেশি টাকা আছে এবং বড় আড়তদার যারা। অনেক সময় অর্ধেকে লাভের সুফল তারাই পায়। কম দামে কেনা সেই মাছ স্থানীয় বাজারে সরবরাহ না করায় এখানকার মানুষ ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে ইলিশ কিনতে পারে না। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত জমজমাট মাছের আমদানি ও পাইকারি ক্রয়-বিক্রয় চলে। অনেক সময় সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতও হয়ে যায়। আড়তে দাম-দর হবার পর সাথে সাথেই পাল্লায় ওজন। হিসাবের স্লিপ নিয়েই সেই মাছ বিশেষ পদ্ধতিতে বাক্সবন্দী করে প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়। দিনে দিনেই, অনেক সময় রাতেই ট্রাক ও পিক-আপযোগে প্রশাসনের চোখের সামনেই চালানী হয়।
সরজমিনে আরও দেখা যায়, চালানীর মাছ বহন করার জন্যে রেল লাইনের উপর দিয়ে এসে ট্রাক, পিক-আপ লাইন ধরে অপেক্ষা করছে। লঞ্চযোগেও অনেক মাছ ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। একটি সংঘবদ্ধ চক্র চাঁদপুরের স্থানীয় বাজারে চাহিদা অনুযায়ী ইলিশ সরবরাহ না করে অন্যত্র পাঠিয়ে দিচ্ছে। জেলেরা বা বেপারীগণ বেশি দামে বিক্রি করেও তেমন একটা লাভবান হতে পারে না। অনেক সময় মাছ বিক্রি করে হতাশায় ভোগে। অনুসন্ধানে জানা যায়, চাঁদপুরের মানুষকে সীমিত দামে ইলিশ খাওয়া থেকে বঞ্চিত করে এখানকার এক শ্রেণীর ছোট আড়তদার, বড় আড়তদার, পাইকার, ইলিশ মজুদকারী ও চালানী। এক বছরে গড়ে মাছের উচ্চ দামের লাভের পাল্লা ভারী তাদেরই। এমন ব্যবসা করে এরা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যাচ্ছে। জেলেদের নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হচ্ছে না। সারা বছরই ধারদেনা করে সংসার, জাল-নৌকা করতে হয়। মধ্যস্বত্ব ভোগীরা হাতিয়ে নেয় বিপুল পরিমাণ অর্থ।
মাছের দেশের মানুষ সাগর কিংবা নদ-নদীর মাছ কেনার সামর্থ্য রাখছে না। সরকারি অনেক কর্মকর্তা এখানকার মাছের দাম প্রিয়জনদেরকে শুনালে তারা অবাক হন। তারা বলেন, এখানে মাছের দামতো কম হবার কথা। চাঁদপুরের ইলিশ সুস্বাদু এবং ব্যাপক সুনাম থাকায় এখানকার ইলিশ সারা দেশের মানুষের বেশি পছন্দ। সত্যিকার অর্থে সেই সুস্বাদু ইলিশ চাঁদপুরের মানুষের ভাগ্যে জুটে, না কি তারা প্রতারণার শিকার হতে হয়। চট্টগ্রামের, নামার এমনকি বার্মার ইলিশকে লোকাল মাছ হিসেবেও চালিয়ে দেয়া হয়। পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠান বা স্বজনদের আবদার রক্ষায় কিছু সংখ্যক মানুষ বেশ উৎসাহ নিয়ে ঘাটে ইলিশ কেনার জন্য যায়। কিন্তু মেঘনা-পদ্মার স্থানীয় ইলিশ কেনা বা চেনার উপায় তাদের নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাটে অবস্থান করে একসঙ্গে তো শত মণ ইলিশ কিনতে পারবে না। ২/১টা, এক হালি বা ১০/২০টা ইলিশ ওজনে যা হয় বেশি দাম দিয়ে কিনে প্রিয়জন বা কাছের মানুষের মন রক্ষা করতে হয়।
চাঁদপুরের ইলিশ এখন কোটিপতির মাছে পরিণত হয়েছে। ভরা মওসুমেও ইলিশের দুর্মূল্য ও দু�প্রাপ্যতা চলছে। নদীর পাঙ্গাস, আইর, বোয়াল, রিডা, বড় বাইলা, নদীর চিংড়ি উৎপাদন বহুলাংশে কম হলেও জেলেদের জালে যা-ই ধরা পড়ছে সেসব সুস্বাদু মাছের চেয়ে এখনও জাতীয় মাছ ইলিশের বর্তমান বাজার দর দুই গুণ তিনগুণ। গতকাল বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ৮/৯শ� গ্রাম থেকে এক কেজি পরিমাণের একটি ইলিশ ১১শ� থেকে ১৪শ� টাকা। অথচ নদীর পাঙ্গাশের কেজি ৫শ� থেকে ৬শ� টাকা, আইর মাছ ৬/৭শ� টাকা, রিডা মাছ (বড়) ৬/৭শ� টাকা, দেশী বাইলা ৬/৭শ� টাকা। রুই-কাতলসহ অন্য মাছের দাম ইলিশের তুলনায় দুই গুণ থেকে তিন গুণ কমে রয়েছে। কিশোর ইলিশের কেজি ৪শ� টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সাধারণ ভোক্তাদের আক্ষেপ : কবে আসবে সেই সুদিন�কিশোর ইলিশ নয়, একটা পরিপক্ক ইলিশ তাদের আয়ের মধ্যে কিনে খাবার সুযোগ হবে। তারা জ্যোতিষের কাছে গেলেও সে দিনটি সম্পর্কে জানবে কিনা সে ব্যাপারে রয়েছে সন্দেহ। রাষ্ট্র, সরকার, সংশ্লিষ্ট বিভাগ, প্রশাসন, সর্বোপরি জনগণের সচেতনতা এবং কার্যকর প্রশাসনিক পদক্ষেপই পারে ইলিশ সঙ্কট নিরসন ও মূল্য সাধারণের ক্রয় ক্ষমতায় রাখতে। স্থানীয় নদীতে ইলিশের প্রকৃত জাল ব্যবহার না করে অধিক হারে ছোট ও ফাঁসযুক্ত কারেন্ট জাল, কোণা জালে প্লাস্টিক সুতার ক্ষুদ্র ফাঁস পকেট ব্যবহার করায় প্রজনন সময়ে জাটকা এবং বিপুল পরিমাণ কিশোর ইলিশ নিধন হবার ফলে চাঁদপুর মেঘনা অববাহিকায় যে পরিমাণ ইলিশ পাবার কথা তা অঙ্কুরেই বিনাশ হয়ে যাচ্ছে। মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বাজারে সহনীয় পর্যায় সরবরাহ নিশ্চিত হলে জেলেরা যেমন কম খরচে বেশি মাছ আহরণ করতে পারবে, দাদনদার, আড়তদার ও চালানী স্বল্প লাভে পর্যাপ্ত পরিমাণ ইলিশ বাজারজাত করতে পারবে। তখন এমনি এমনিতেই ইলিশের দাম সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে বলে পর্যালোচনায় অভিজ্ঞ মহলের অভিমত।
চাঁদপুর রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মুহাম্মদ হোসেন মজুমদার জানিয়েছেন, ইলিশ মাছ পরিবহনের জন্য আলাদা রেল লাগেজ ভ্যান রয়েছে। এ বছর মাছ কম হওয়ায় তেমন বুকিং হচ্ছে না। ঈদের আগে গড়ে ১০/১৫ ঝুড়ি বা বাক্স বুকিং হয়েছে। লাকসাম পর্যন্ত যাবার পর গন্তব্যে পৌঁছার নিশ্চয়তা নেই। একবার মাছ ফেরৎও এসেছে। ব্যবসায়ীরা তাদের সুবিধা মোতাবেক হয়তো বিকল্প পথে মাছ পাঠাচ্ছেন। তিনি আরো জানান, গত বছর মাছ বেশি ধরা পড়ায় প্রতিদিন ৫০ থেকে ৭০ ঝুড়ি ইলিশ বুকিং হয়েছে। এখন তো মাছই নেই। রেলের অভ্যন্তরে অবাধে সড়ক পরিবহনের যানবাহন যাতায়াত বেআইনি। যেহেতু মাছ বুকিং নেয়া হলেও ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী সেবা রেল দিতে পারছে না, গন্তব্যে পৌঁছাও অনিশ্চিত, সেই বিবেচনায় স্থানীয়ভাবে তাদের নিষেধও করা যাচ্ছে না। মাছ পরিবহনে ট্রাক, পিক-আপ যাতে ঢুকতে না পারে স্টেশনের সাথে রেল ব্যারিকেড দেয়া আছে। কিন্তু অন্যদিক দিয়ে কিছু গাড়ি ঢুকছে। স্টেশন মাস্টার জানান, চাঁদপুর মাছ ঘাট থেকে ট্রেনে বেশি ইলিশ যায় ময়মনসিংহ। চট্টগ্রামেও কিছু ইলিশ যায়।
চাঁদপুরের প্রবীণ রাজনীতিক মোঃ নূরুল হক বাচ্চু মিয়াজী জানিয়েছেন, তাঁর শৈশব-কৈশোর-যৌবনে ৪ পয়সা ছিলো একটা ইলিশের দাম। ওজনও ছিলো এক কেজি বা তার বেশি। এখন সেটা ১১/১২শ� টাকা। সেই ইলিশের এখন এতটাই দুর্মূল্য যে, ধনাঢ্য ব্যক্তিরা ছাড়া কেউ কিনতে পারছে না। ইলিশের তখনকার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বাচ্চু মিয়াজী আরো জানান, নদ-নদীতে মাছ ধরতো হিন্দু দাসেরা। তারা আষাঢ় মাসে গঙ্গা পূজা দিয়ে নদীতে নামতো। নাইনলের জাল ছিলো না। সুতার জাল ব্যবহার করতো। জালের ফাঁস ছিলো বড়। তিনি বলেন, এমন জেলেরা আষাঢ়-শ্রাবণ-ভাদ্র-আশ্বিন এ ৪ মাস ইলিশ শিকার করতো। বছরের বাকি মাসগুলোতে জেলেরা অন্য মাছ ধরতো। জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে অভাবের তাড়নায় জেলেরা ডিমওয়ালা মাছ এবং জাটকা ধরে ফেলছে। এতে ইলিশের দু�প্রাপ্যতা ও দুর্মূল্য তো হবেই। ডিম ও জাটকা রক্ষা হলে নদীর পানি ইলিশে একাকার হতো।