দেশের মানুষ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থেকে মুক্ত থাকতে চায়, স্বস্তি-শান্তি চায়। উৎপাদন-ব্যবস্থা ও রফতানিসহ সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকা- পূর্ণ গতিশীল হোক এবং সকল ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা-পূর্ব পরিস্থিতি ফিরে আসুক ও তা বহাল থাকুক, এটাও সঙ্গত কারণে এ মুহূর্তে দেশবাসীর একান্ত চাওয়া। সকল দলের অংশগ্রহণে উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তারপরও বিশ্লেষকরা শংকা প্রকাশ করছেন যে, পরিস্থিতি পুনরায় উদ্বেগজনক অবস্থার দিকে মোড় নিতে পারে। চট্টগ্রামে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়ে বিচারক তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নীরবতাকে ‘রহস্যজনক’ বলে উল্লেখ করেছেন। এদিকে গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনির্ধারিত আলোচনায় বলেছেন, ‘দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলার বিচারের সময় সাক্ষীদের সাক্ষ্যে যেহেতু বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও হাওয়া ভবনের সম্পৃক্ততার বিষয়টি চলে এসেছে, তাই এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দিতে একটি তদন্ত হওয়া দরকার। আমরা তদন্ত করবো। আন্তর্জাতিকভাবেও তদন্ত করা হচ্ছে।’ অন্যদিকে একই দিন সন্ধ্যায় রাজধানীর একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসন ও ১৯ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ‘জালিয়াতিপূর্ণ’, দশম জাতীয় সংসদকে ‘তামাশার’ এবং বর্তমান সরকারকে ‘সম্পূর্ণ অবৈধ’ বলে আবারও আখ্যায়িত করেছেন। বেগম জিয়া বলেছেন, ‘জবরদস্তি ও ত্রাসের এই বেআইনী শাসনের বিরুদ্ধে জনগণ বেশিদিন নীরব থাকবে না। আমরাও চুপ থাকবো না।’ তিনি বাংলাদেশে মানবাধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সব মানবাধিকার সংস্থাকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে নেদারল্যান্ডের হেগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ এনেছে তুরস্কের একটি ইসলামী সংগঠন- ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন ফর ফ্রিডমস অব রাইটস। এ সংগঠনের অভিযোগে বলা হয়েছে, ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানি করার মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার মানবাধিকারের বিরুদ্ধে অপরাধ করছে।’
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও দাতাগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার পরামর্শ ও তাগিদ নির্বাচনের আগেও দেয়া হয়েছে এবং এখনও দেয়া হচ্ছে। গত মঙ্গলবার লন্ডনে কমনওয়েলথ সচিবালয়ের মুখপাত্র রিচার্ড উকুও এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে আগাম নির্বাচনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কার্যকর সংলাপ চায় কমনওয়েলথ। এজন্য গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করে জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটে- এমন একটি নির্বাচন আয়োজনের কাঠামো খুঁজে বের করতে কার্যকর সংলাপ অনুষ্ঠানের বিষয়ে সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত কমনওয়েলথ।’ বলার অপেক্ষা রাখে না, রাজনৈতিক অস্থিরতায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সার্বিক ইমেজ বা ভাব-মর্যাদা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রফতানি-পণ্য ও শ্রমশক্তি আমদানিকারক দেশগুলো বিরক্ত ও হতাশ হয়েছে এবং অনেক অর্ডার অন্যত্র চলে গেছে। আমাদের তৈরি পোশাকের বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো ও যুক্তরাষ্ট্র এবং জনশক্তি রফতানির বড় বাজার সউদী আরব ও আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশের ইমেজ পুনরুদ্ধার এখন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। আরও বড় সমস্যা এখনও দেশের অর্থনীতিতে আকাক্সিক্ষত গতি আসছে না। অর্থনৈতিক কর্মকা-ে উদ্যম-উদ্দীপনা জাগিয়ে পূর্ণ গতি ফিরিয়ে আনা সঙ্গত কারণেই সরকারের এক নম্বর টার্গেট হওয়া উচিত। বিগত সময়ে হরতাল-অবরোধের মত রাজনৈতিক কর্মসূচীর কারণে দেশের উৎপাদন-ব্যবস্থা, বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও রফতানিসহ সার্বিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটেছে, তা দ্রুত পুষিয়ে নেয়ার বিকল্প নেই। বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য দুবাই তথা সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভিসা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের রেমিটেন্স আয়ের দ্বিতীয় বৃহৎ উৎস এই দেশটি কর্মসংস্থান বা এমপ্লয়মেন্ট ভিসা, ট্যুরিস্ট বা ভ্রমণ ভিসা এবং সব ধরনের বাণিজ্যিক ভিসা প্রদান সম্পূর্ণ বন্ধ রেখেছে। সউদী আরবের পর সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী আছেন এ দেশটিতে এবং তাদের সংখ্যা প্রায় ২৩ লাখ। সউদী আরবও বাংলাদেশীদের ক্ষেত্রে এরকম পদক্ষেপের কথা ভাবছে। যুক্তরাষ্ট্রেও বিপুল সংখ্যক অভিবাসী সংকটের মুখে পড়তে পারে, এমন কথাও শোনা যাচ্ছে। আর তাতে সেখানে কর্মরত অনেক বাংলাদেশীর ফেরত আসার শংকা দেখা দিতে পারে। এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে জিএসপি সুবিধা বাতিলের শংকা ছাড়াও ইতোমধ্যে সে সব দেশ থেকে অনেক অর্ডার বাংলাদেশে না এসে অন্যত্র চলে গেছে বলে ব্যবসায়ীরা উল্লেখ করেছেন।
অর্থনীতির গতি পুনরুদ্ধার এখন নতুন সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। আর এজন্য নিরপেক্ষ বিবেচনায় কার্যকর সংলাপ শুরুর তাগিদ উচ্চারিত হচ্ছে। সংলাপ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে, এটা কেউ মনে করছেন না, তবে একথা ঠিক, সংলাপ শুরু হলে পরিস্থিতি ইতিবাচক দিকে মোড় নেবে। রাজনৈতিকসহ সকল মহলে আশাবাদ যদি না জাগানো যায়, তাহলে জনগণের ক্ষোভ ও হতাশা কাটবে না। শীর্ষ রাজনৈতিক মহল থেকে উদ্বেগ ছড়ানো উষ্ণ কথাবার্তা কি করে পরিস্থিতি শান্ত ও সমঝোতাপূর্ণ করতে পারবে, এটাও ভেবে দেখতে হবে। বিশেষ করে দেশের সবার কি আকাক্সক্ষা, কি মতামত, তা-ও বিবেচনায় নিতে হবে। সরকারের হাতে সকল ক্ষমতা, এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য, তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, মোহাম্মদ নাসিমের মত অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদরা এখন সরকারে আছেন। তাদের অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞাকেও এক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হবে। পরিস্থিতি যাতে আবারও পিছিয়ে না যায়, আগের অবস্থায় গিয়ে না পৌঁছে- এটা প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি নেত্রীকেও গভীরভাবে ভাবতে হবে। দমন-পীড়ন যাতে অব্যাহত না থাকে এবং অন্যদিকে হরতাল-অবরোধের মত কর্মসূচীতে সব কিছু বন্ধ হয়ে না যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। দেশ-জাতি ও জনগণের স্বার্থেই স্থিতিশীলতা বজায় রেখে শান্তি-স্বস্তি প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হতে হবে।
চাঁদপুর নিউজ সংবাদ