ফরিদগঞ্জ প্রতিনিধি :ফরিদগঞ্জ উপজেলার ৩০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় যেনো এখন মৃত্যুকূপের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। যে কোন মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে এমন আতঙ্ক প্রায় ১০ সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর। প্রায় শত বছর আগে নির্মিত জরাজীর্ণ বিদ্যালয়গুলোতে মারাত্মকভাবে ফাটল দেখা দেওয়ায় অনেক বছর আগেই সেগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। অধিকাংশ বিদ্যালয়গুলোর শ্রেণিকক্ষে ক্লাস চলাকালে ছাদের আস্তর খসে পড়ছে শিক্ষার্থীদের গায়ে। সবগুলো বিদ্যালয়েরই ছাদের ভীমের সিংহভাগ খসে পড়ে গেছে। আধা-পাকা ভবনগুলোর টিন ও উপরের ছাউনি ঝুলে আছে নামকাওয়াস্তে। একটু বৃষ্টি এলেই ছাদের পানিতে ভেসে যায় পুরো ক্লাস। নিরুপায় হয়ে আকাশে মেঘে গর্জন দিলেই বিদ্যালয় ছুটি দিতে বাধ্য হন ভুক্তভোগী প্রধান শিক্ষকরা। কয়েকটি বিদ্যালয়ের মাঠ পার্শ্ববর্তী পুকুর বা দীঘিতে বিলিন হয়ে গেছে। পুকুরের পাড় ভাঙ্গার ফলে যে কোন সময় পুকুরে তলিয়ে যেতে পারে বিদ্যালয়ের মূল ভবন।
গত ১ সপ্তাহ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ঘুরে এমন চিত্রই দেখা যায়। ইতিমধ্যে কয়েকটি বিদ্যালয়ের মূল ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণা করে বিকল্প স্থানে ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষকরা। যে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকল্প স্থানে ক্লাস নেওয়ার কোন সুযোগ নেই, সেগুলোতে জীবন বাজি রেখেই চলছে পাঠদান কার্যক্রম। উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় আছে ইসলামপুর ও পশ্চিম চাঁদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। শ্রেণিকক্ষে ছাদের আস্তর খসে পড়ে রডগুলো দেখা যাচ্ছে। কয়েকটি স্থানে বৃহত্তর ফাটল বড় ধরনের দুর্ঘটনার হাতছানি দিচ্ছে। কোন কোন স্থানে ফাটল দিয়ে আকাশ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে।
বিদ্যালয় দু’টির প্রধান শিক্ষকরা জানান, ইতিমধ্যে উপর থেকে ইট পড়ে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। বিকল্প কোন স্থানে ক্লাস করানোর ব্যবস্থা না থাকায় ঝুকিপূর্ণ এ ভবনটিতেই চলছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পাঠদান। ১৯৯৮ সালে নির্মিত উপজেলার সবচেয়ে পুরনো স্কুল গোবিন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শতবর্ষী পুরনো জরাজীর্ণ ভবনটিতে চালাচ্ছে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম। দেয়াল ও ছাদের আস্তর খসে পড়ে দূর থেকে ভবনটি ভূতুরে আস্তানা মনে হয়।
ফরিদগঞ্জ সদরের ঐতিহ্যবাহী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির চিত্র কিছুটা ব্যতিক্রম। বহু কক্ষবিশিষ্ট পরিপাটি একটি ভবন থাকলেও ভবনটির একপাশ পুকুরে ধসে পড়ার পথে। মাটি খেকো মাছ চাষ করায় ইতিমধ্যে বিদ্যালয়ের মাঠসহ প্রবেশপথটি পুকুরে বিলীন হয়ে গেছে।
মূলপাড়া সরখাল প্রাথমিক বিদ্যালয়টির রূপ আরো ভয়াবহ। পার্শ্ববর্তী দীঘি ইতিমধ্যে বিদ্যালয়টির ৩ শতাংশ জমি তলিয়ে নিয়ে গেছে। বিদ্যালয় থেকে মাত্র একহাত দূরে মাটি খেকো দিঘীটি। যে কোন সময় বিদ্যালয়টি তলিয়ে যেতে পারে- এমন আতঙ্কে শিক্ষকরা।
গুয়াখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির অবস্থা আরো করুণ। বছরদশেক আগে বহু অনুনয় বিনয়ের পর ঝুকিপূর্ণ পুরাতন ভবনটির পাশে একটি নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়। যার অবস্থা পুরাতন ভবনটির চাইতেও জরাজীর্ণ। নিম্নমানের ইট, সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করায় ক্লাস চলাকালে শিক্ষার্থীদের গায়ে আস্তর খসে পড়ে।
পশ্চিম বাঁশারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আধাপাকা ভবনটি দাড়িয়ে আছে নামেমাত্র। টিনের চালের একপাশ কাত হয়ে আছে গত এক বছর। বড় ধরনের ঝড় এলেই ধসে পড়তে পারে স্কুলটি। ১৯৩৯ সালে নির্মিত পূর্ব কমলপুর ও রামপুর বাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় দু’টি সামান্য বৃষ্টিতেই শ্রেণি কক্ষে পানিতে ভরে যায়। ভবন দু’টির ছাদে ফাটল থাকায় ছাদ চুইয়ে পানি গড়িয়ে পরে।
গুপ্টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাদের ভীমগুলো খসে পড়ছে প্রতিনিয়ত। বিদ্যালয়টি ধসে পড়ার আতঙ্কে। ঝড়-বৃষ্টির আভাস পেলে স্কুল ছুটি দিতে বাধ্য হন প্রধান শিক্ষক।
শোভান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আধাপাকা ভবনটি ইতিমধ্যে একাংশ ধসে পড়েছে। বাকি যে অংশ দাঁড়িয়ে আছে তার মধ্যে ঝুকি নিয়ে চলছে শিশু ও ২য় শ্রেণির পাঠদান।
দরজা-জানালা ভাঙ্গা অরক্ষিত পশ্চিম লাড়–য়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির বেশ কিছু স্থানে দেয়ালে খসে পড়েছে। উপরের টিনের চালা যেকোন মুহূর্তে ভেঙ্গে পড়তে পারে শিক্ষার্থীদের গায়ে।
পশ্চিম হাঁসা প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে সামান্য বৃষ্টি হলেই পানির স্রোত নামে।
ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যার দিক থেকে উপজেলার সর্ববৃহৎ গল্লাক বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ৫৭৫ জন শিক্ষার্থীর ক্লাস নিতে পারছে না শ্রেণি কক্ষের অভাবে। পুরাতন ভবনটি ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়ায় নতুন ভবননে পাঠদান চলছে ক্ষীণ পরিসরে।
পুরাতন ভবনটি ধসে পড়ার আতঙ্ক থাকায় তা থেকে বেড়িয়ে তিন কক্ষবিশিষ্ট নতুন ভবনে চলছে পূর্ব ধানুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান। শিক্ষকদের অফিস রুমে নেয়া হচ্ছে ৫ম শ্রেণির ক্লাস।
ছাদের আস্তর খসে পড়ায় দু’টি কক্ষ তালাবদ্ধ লোহাগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। বাকি কক্ষগুলোতে ক্লাস চললেও ছাদ ধসে পড়ার আতঙ্কে বিদ্যালয়ের তিন শতাধিক শিক্ষার্থী।
প্রতিবছর ভাল ফলাফল অর্জন করলেও সেকদি, দেইচর ও উভারামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভাগ্য ফেরেনি গত ২০ বছরেও। নির্মাণের পর থেকে করা হয়নি জরাজীর্ণ ভবন তিনটির সংস্কার কাজ।
মানুরী, খাড়খাদিয়া ও শেকদিরামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় তিনটি একই আতঙ্কে আতঙ্কিত।
পশ্চিম গাঁব্দেরগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা জানান, বহু আবেদন করার পরও তার স্কুলের জরাজীর্ণ ভবনটি ভেঙ্গে পুনঃনির্মাণ করার আশার বাণীটুকু পাননি প্রশাসনের কাছ থেকে।
হর্নি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি আধাপাকা ভবনটি বর্ষা এলেই আতঙ্ক ছড়ায়।
১৯২২ সালে নির্মিত পুরাতন জরাজীর্ণ টিন সেটের লড়াইরচর প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ৩শ’ শিক্ষার্থীর জন্য মরণ ফাঁদ।
দক্ষিণ সাহেবগঞ্জ ও ষোলদানা প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ঝুকিপূর্ণ ভবনে ক্লাস করতে এসে অনিরাপত্তায় ভুগছে ৫ শতাধিক শিক্ষার্থী।
দক্ষিণ ও পশ্চিম বিষকাটালী এবং পুরাণ রামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা আরও শোচনীয়।
ধ্বসে পড়ার আতঙ্কে নিয়েই উপজেলার এমন ৩০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ১০ হাজার কচি শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে। ঝুকিপূর্ণ ভবনগুলো ভেঙ্গে নতুন ভবন নির্মাণ করা হবে কি-না এ বিষয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অন্যান্য উপজেলার তুলনায় ফরিদগঞ্জ উপজেলায় ঝুকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা বেশি। তারপরও তিনি মারাত্মক ঝুকিপূর্ণ ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ ৫টি ভবন নির্মাণ এবং বাদবাকিগুলো আগামি বর্ষার আগে সাময়িক সংস্কারের জন্য একাধিকবার আবেদন পাঠিয়েছেন। উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কোন সাড়া পাচ্ছেন না। তাই ইচ্ছা থাকা স্বত্ত্বেও সেগুলোতে কাজ করাতে পারছেন না।
৩০টি বিদ্যালয়ের মধ্যে যে কোন ১ টি ধসে পড়লে প্রাণনাশ হতে পারে শত শত কোমলমতি শিক্ষার্থীদের। শীঘ্রই বড় ধরনের কোন দুর্ঘটনা ঘটার আগে কর্তৃপক্ষ বিষয়টির প্রতি সুনজর দেবেন এমনটাই দাবি হাজারো অভিভাবক, শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের।
শিরোনাম:
সোমবার , ২১ এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ৮ বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।