চাঁদপুর: যাত্রীবাহী লঞ্চসহ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা মূল্যের ২ হাজার ৫’শ নৌযান দেশের বিভিন্ন নদীর তলদেশে আটকে রয়েছে। ১৯৪৭ সাল থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত নৌ-দুর্ঘটনায় এসব নৌযান নদীর তলদেশে আটকা পড়ে। শুধু নৌযান আটকে নয়, ৬৬ বছরে নৌ-দুর্ঘটনায় ১৭ হাজার ৭৭৯ যাত্রী মারা যান ও ২০ হাজার ৬৪৭ যাত্রী আহত হন। বিআইডবিস্নউটিএ’র নৌ-সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগ ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব চিত্র পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, ডুবে যাওয়া ৩ হাজার ২৩৯টি নৌযানের মধ্যে বিআউডবিস্নউটিএ’র উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা ও রুস্তম মাত্র ৪৮৬টি নৌযান উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এছাড়া ব্যক্তিগতভাবে উদ্ধার করার হয়েছে ২৯৭টি। হামজা ও রুস্তম দিয়ে মাত্র ৬০ টন ওজনের নৌযান উদ্ধার করা যায়। আর যেসব নৌযান ডুবে রয়েছে তার ওজন ১০০ থেকে হাজার টনের উপরে। সরকারের প্রয়োজনীয় শক্তিশালী বড় উদ্ধার জাহাজ না থাকায় উলি্লখিত ডুবে থাকা নৌযান উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ফলে এসব নৌযানে পলি জমে ডুবোচরের সৃষ্টি করে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নৌপথ সুরু হয়ে যাচ্ছে। নৌযান চলাচলেও মারাত্মক বিঘ্ন ঘটছে। পাশাপাশি নদীর জীব-বৈচিত্র্য ও মৎস্যসম্পদ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নদীর তলদেশে ডুবে থাকা এসব নৌযান উদ্ধার না করেই সরকার সারাদেশে ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৩টি নদী খনন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। নদীর তলদেশে যত্রতত্রভাবে নৌযান ডুবে থাকার কারণে নদী খনন প্রকল্পও সফল হবে না বলে নৌ বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
নদী বিশেষজ্ঞরা আরো বলেছেন, নদী খনন প্রকল্প সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয় করা ছাড়া আর কিছুই হবে না। মংলা বন্দর চ্যানেলে মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে ডুবে যাওয়া তেল ও সিমেন্ট বোঝাই ৩টি কার্গো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ডুবে থাকা কার্গো থেকে তেল ভেসে বেড়াচ্ছে। সিমেন্টের আস্তরণ ও বর্জ্যে নদী এবং সুন্দরবনে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
নদী বিশেষজ্ঞ মো. এমদাদুল হকের (বাদশা) নদী, নৌযান এবং নাবিকদের অতীত ও ভবিষ্যৎ এবং নৌ-দুর্ঘটনার ওপর এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানা গেছে, নৌযান চালকদের ভুল-ত্রুটির (মাস্টার, সুকানী লস্কর অর্থাৎ নৌযানের ক্রু) কারণে শকতরা ৩৪ ভাগ, ঘূর্ণিঝড়-টর্নেডো ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ২৫ ভাগ, অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ে ২০ ভাগ, ত্রুটিপূর্ণ নৌযানে ১৩.৬৮ ভাগ, যাত্রীদের অসতর্কতায় ০২.৩২ ভাগ, পাইলটদের ভুলে ২.০ ভাগ ও অপর্যাপ্ত মার্কিংয়ে ১.০ ভাগ নৌ-দুর্ঘটনার কারণ উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
১৯৯৪ সালে চাঁদপুরের মেঘনা-ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় ঘূর্ণিঝড়ে এমভি দীনার-২ যাত্রীবাহী লঞ্চটি ডুবে যায়। ১৪০ যাত্রীর প্রাণহানি হলেও ডুবে যাওয়া লঞ্চটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ২০০৩ সালে পুনরায় চাঁদপুরের মোহনায় এমভি নাসরিন-১ লঞ্চ ডুবে যায়। এ দুর্ঘটনায় ৬২৫ যাত্রীর প্রাণহানি হলে সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং ২০০৪ সালে এমভি দীপ ও লাইটিং সান লঞ্চডুবির পর জাতীয় দৈনিকে ও বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ব্যাপক প্রচার পাওয়ায় একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। তবে বর্তমান সরকারের কঠোর নীতি অবলম্বনের ফলে বর্তমানে নৌ-দুর্ঘটনা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে বলে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় দাবি করেছে।
১৯৬৫ হতে অদ্যাবধি বিআইডবিস্নউটিএ হামজা ও রুস্তম জাহাজ প্রায় ৪’শ ডুবন্ত নৌযান উদ্ধার করেছে। কিন্তু এ দুটো উদ্ধারকারী জাহাজ উত্তোলনের ক্যাপাসিটির বাইরে থাকায় প্রায় বাকি নৌযানগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। গত ২০ বছর ধরে হাই পাওয়ার স্যালভেজ শিপ আনার উদ্যোগ নেয়া হলেও প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকায় আনা সম্ভব হয়নি। তবে বর্তমান মহাজোট সরকার অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন উদ্ধারকারী জাহাজ আনার উদ্যোগ নেয়। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বর্তমান বিশ্বের উন্নত দেশে গ্যাব-টাইপ স্যালভেজ শিপ আছে, যা দিয়ে তীব্র স্রোতে ডুবুরিদের জীবনের ঝুঁকি ছাড়া এসব ডুবন্ত নৌযান উদ্ধার করা সম্ভব হবে বলে তাদের অভিমত।
এ ব্যাপারে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান জানান, নৌ সেক্টর উন্নয়নের লক্ষ্যে বহুবিধ ইতিবাচক কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ নৌযানে ‘রিভার্সিবল গিয়ার’ সংযোজন করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এর ফলে নৌযান সহজেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। ফলে নৌ-দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে। তিনি বলেন, অনাকাঙ্ক্ষিত ও দৈব- দুর্বিপাকে নৌ-দুর্ঘটনায় নিমজ্জিত লঞ্চ বা জাহাজ উদ্ধারের লক্ষ্যে দীর্ঘ ২৮ বছর পর ৩৫৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রতিটি ২৫০ টন উত্তোলন ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি উদ্ধারকারী জাহাজ সংগ্রহ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, নৌ-সেক্টরে প্রশিক্ষিত জনশক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে আরো দুটি ডেক অ্যান্ড ইঞ্জিন পার্সোনেল ট্রেনিং ইন্সটিটিউট সেন্টার (ডিইপিটিসি) প্রতিষ্ঠা করা হবে। দেশি-বিদেশি জাহাজে নাবিকদের অধিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ৪২ বছর পর ৪টি ‘মেরিন একাডেমি’ ও ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেরিন বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। নৌপথে সার্বিক নিরাপত্তা ও ডাকাতি বন্ধে ‘জলথানা’ গঠন করার কথা জানান তিনি।
বড় জাহাজ ডুবে গেলে হামজা ও রুস্তম দিয়ে তা তোলা যায় না। দীর্ঘ ২৮ বছর পর গত এপ্রিলে বিআইডবিস্নউটিএ’র জন্য প্রতিটি ২৫০ টন উত্তোলন ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি উদ্ধারকারী জাহাজ সংগ্রহ করার কথা জানান মন্ত্রী।
বিআইডবিস্নউটিএ’র সাবেক পরিচালক ( নৌ-সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগ) ও মাদারীপুর শিপ ট্রেনিং ইন্সটিটিউটের অধ্যক্ষ মো. এমদাদুল হক বাদশা বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় নৌপথে নিমজ্জিত নৌযানগুলো উদ্ধারের ব্যাপারে একটা ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নেয়া উচিত এবং ভূতাত্তি্বক জরিপ করে নিমজ্জিত নৌযানগুলোর প্রকৃত অবস্থা নির্ণয় করে দ্রুত উদ্ধারের জন্য প্রাইভেট স্যালভেজ পার্টিকে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। এসব শত শত নিমজ্জিত নৌযানগুলো উদ্ধার করা হলে নদীর নাব্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নদীর গতিপ্রবাহ স্বাভাবিক হলে নৌ-চালাচল নিরাপদ হবে, তেমনি মৎস্য চাষ, কৃষিতে সেচসুবিধা বৃদ্ধিসহ বহুমুখী লাভ হবে বলে তিনি মনে করেন। এছাড়া পরিবেশ উন্নয়নও সম্ভব হবে। জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। তিনি জানান, উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা ও রুস্তমের ডুবুরী কোথাও পাঠাতে হলে ২টি গাড়ি, ২টি স্পিড বোট সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন।
শিরোনাম:
সোমবার , ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ৫ ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।