এম. সাখাওয়াত হোসেন মিথুনঃ
বেড়েই চলেছে নিত্যপণ্যের দাম। কয়েক সপ্তাহ ধরে আটা, ময়দা, ভোজ্যতেল, চিনি, লবণ, সব ধরনের জিনিসের দাম কয়েক দফা বেড়েছে। বাদ যায়নি শিশুখাদ্যও। এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে দিশেহারা সাধারণ মানুষ। জীবনের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষকে। নিম্ন আয়ের মানুষ তিন বেলা পেটপুরে খেতেও পারছেন না। বিলাস সামগ্রী ব্যবহার প্রায় ভুলতে বসেছেন অনেকে। আয়ের সঙ্গে ভারসাম্য রাখতে গিয়ে নিত্য কাটছাঁট করতে হচ্ছে খাদ্য তালিকা। কাটছাঁট করা হচ্ছে বাজার তালিকা। পাশাপাশি বাসাভাড়া, চিকিত্সা, যাতায়াত, শিক্ষাসহ অন্যান্য খরচ মেটাতে গিয়ে দিশেহারা সাধারণ মানুষ। ব্যয় বাড়লেও আয় না বাড়ায় শেষ সম্বল ‘সঞ্চয়’ ভেঙে জীবন বাঁচানোর লড়াই করছেন অনেকে। নিম্নবিত্ত মানুষের অবস্থা এতই করুণ যে, হাজীগঞ্জে বস্তিবাসীদের ভাতের সঙ্গে আলু ও বাঁধাকপি সিদ্ধ করে খেতে দেখা গেছে। বেড়ে গেছে ভিক্ষুক সংখ্যাও। নিত্যপণ্যের এ দাম বৃদ্ধিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষ। তাদের মতে, ব্যয় এতই বেড়েছে যে, জীবন বাঁচানো দায়। ধার-দেনা করে কোনোমতে সংসার চলছে। প্রয়োজনীয় পণ্যের একটি কেনা সম্ভব হলে আরেকটি কেনা যাচ্ছে না।
ব্যবসায়ীরা জানান, গত কয়েকদিনে আটা, ময়দা, মুরগিসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে মুরগির কেজিতে ৫-১০ টাকা, পোলাও চালে ২৫-৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে আটার দাম কেজিতে ১৩ টাকা বেড়েছে। একই হারে বেড়েছে ময়দার দাম। মাছ-মাংসের দাম এতই চড়া যে, সাধারণ মানুষ এসবের স্বাদ ভুলতে বসেছেন। কম খরচের জন্য যারা ডিমের ওপর নির্ভারশীল ছিলেন তারা এখন এর থেকে দূরে সরতে বাধ্য হচ্ছেন। গতকাল হাজীগঞ্জে বাজারভেদে এক ডজন ডিম ১০৮-১১২ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। গতকাল হাজীগঞ্জ বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সব পণ্যই চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। খোলা আটা প্রতি কেজি ৩২-৩৫ টাকা, দুই কেজি ফ্রেশ ও স্বাদ ব্রান্ডের আটা ৭৬ টাকা, পুষ্টি ব্রান্ডের আটা ৭৭ টাকা, দুই কেজি ওজনের তীর ব্রান্ডের ময়দা ৯২ টাকা ও এসিআই ময়দা ৯৪ টাকা দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে। বাকিলা বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, এক ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১০৮-১১০ টাকায়। ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৬০-১৬৫ টাকা। একই দামে পলাশী বাজারেও বিক্রি করতে দেখা গেছে। অথচ সাধারণ সময়ে ডিমের হালি ২৪-২৬ টাকা ও ব্রয়লার মুরগি ১২০-১২৫ টাকার মধ্যে ছিল। উয়ারুক বাজারের ব্যবসায়ী আওলাদ হোসেন বলেন, প্রতি কেজি প্যাকেটজাত লবণ ২৭ টাকা দরে বিক্রি করছি। কয়েক মাস আগেও একই লবণ ২০ টাকা দরে বিক্রি করেছি।
দাম বাড়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা জানান, দফায় দফায় জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ার প্রভাব বাজারে পড়েছে। পরিবহন ব্যয় ও উত্পাদন খরচ বেড়েছে। এছাড়া পথে পথে চাঁদাবাজি, বাজার মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা না থাকা, ডলার সঙ্কট, অর্থনৈতিক মন্দা ও কিছু অসত্ ব্যবসায়ীর কারসাজির কারণে দাম বেড়েছে।
দিশেহারা সাধারণ মানুষ : আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রব্যমূল্য কমানোর প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। ইশতেহারের ১.১ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘দ্রব্যমূল্যের দুঃসহ চাপ প্রশমনের লক্ষ্যে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল রাখার ব্যবস্থা করা হবে। দেশজ উত্পাদন বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সময় মতো আমদানির সুবন্দোবস্ত, বাজার পর্যবেক্ষণসহ বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মজুতদারি ও মুনাফাখোরি সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া হবে, চাঁদাবাজি বন্ধ করা হবে। ‘ভোক্তাদের স্বার্থে ভোগ্যপণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ’ গড়ে তোলা হবে। সর্বোপরি সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য কমানো হবে ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা হবে।’ গত তিন বছরের বাজার পরিস্থিতিতে এই প্রতিশ্রুুতি প্রতিফলিত দেখা যায়নি, বরং জনগণকে ভোগ করতে হচ্ছে একেবারেই বিপরীত ফল। নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় শহর ও গ্রামে দুঃসহ জীবনযাপন করছেন সাধারণ ও নিম্ন আয়ের মানুষ। বস্তিতে গিয়ে দেখা গেছে করুণ দৃশ্য। ঘরে ঘরে খাবারের জন্য হাহাকার। কোনো কোনো মায়ের অভিযোগ পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খেতে না পারায় শিশুকে পর্যাপ্ত বুকের দুধ দিতে পারছেন না তারা। হাজীগঞ্জে অন্য বস্তিগুলোতে ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ বস্তিবাসী কম দামের খাবার যেমন আলু, বাঁধাকপি, ফুলকপি ও বাসী তরকারি খেয়ে বেঁচে আছেন। সবচেয়ে বেকায়দায় পড়েছেন মধ্যবিত্ত মানুষ। তারা লোকলজ্জার ভয়ে মানুষের কাছে সাহায্য চাইতে পারেন না, আবার জীবন বাঁচাতে প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য কিনতেও পারছেন না। এসব মানুষের বোবাকান্না দেখার কেউ নেই্তঅভিযোগ করে মকিমাবাদ বাসিন্দা সালেহ আকরাম বলেন, বাসাভাড়া, পরিবহন, শিক্ষা ও চিকিত্সা খরচের পর খাবার কেনার টাকা থাকে না। আবার উচ্চদরের খাদ্যদ্রব্য কিনলে অন্যান্য ব্যয় মেটানো যায় না। সব মিলিয়ে উভয় সঙ্কটে আছি। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা মো. মোফাজ্জেল একটি রশিদ দেখিয়ে বলেন, গত ১২ জানুয়ারি এক কেস ডিম (৩০ পিস) কিনেছি ২২০ টাকায়। গতকাল একই দোকান থেকে একই আটা ৭৭ টাকা ও ভোজ্যতেল ২৬০ টাকায় কিনেছি। একইভাবে অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়েছে। অথচ একটাকা আয় বাড়েনি। এ অবস্থায় আমরা কীভাবে চলব? হাজীগঞ্জবাজারে আটা কিনতে আসা উপজেলার মকিমাবাদ বাসিন্দা রোকেয়া আক্তার শিউলি বলেন, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী দুই বেলা আটার রুটি খেতে হয়। কিন্তু চালের চেয়ে আটার দাম বেড়ে গেছে। এখন দিনে দুই বেলা ভাত ও একবেলা রুটি খাচ্ছি।
গতকালের বাজার দর : হাজীগঞ্জে খুচরা বাজারগুলো ঘুরে দেখা গেছে, খোলা আটা প্রতি কেজি ৩২-৩৫ টাকা ও বিভিন্ন কোম্পানির প্যাকেটজাত দুই কেজি ওজনের আটা ৭৬-৭৭ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, বাজারে খোলা আটার দাম সর্বোচ্চ ৩৫ টাকা। অথচ জানুয়ারি মাসে বাজারে আটার দাম ছিল সর্বোচ্চ ২৫ টাকা। মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে আটার দাম কেজিতে ১৩ টাকা বেড়ে গেছে। এ সময় আটার দাম বেড়েছে শতকরা ৪৪ ভাগ। খোলা আটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ময়দার দামও বেড়ে গেছে। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি খোলা ময়দার দাম ৪০ টাকা। তীর ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত দুই কেজির ময়দা ৯২ টাকা ও এসিআই ৯৪ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ৫৮-৬০ টাকা দরে। আর প্যাকেটজাত চিনির কেজি ৬৩ টাকা। সরকার সয়াবিন তেলের দাম ১০৯ টাকা ও পামতেল ৯৯ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও ওই দামে হাজীগঞ্জে বাজারে তেল পাওয়া যায় না। সরকার দাম নির্ধারণের পর কয়েক দফায় দাম বেড়েছে। বর্তমানে খুচরা বাজারে এক লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৩০ টাকা ও পামতেল ১১০ টাকা দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে। এছাড়া এক লিটার ওজনের বোতল ১৩৫ টাকা, দুই লিটার ওজনের তেল ২৫৬-২৬০ টাকা, ৫ লিটারের তেল ৬৪৫-৬৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কয়েক দিনের ব্যবধানে পোলাও চাল কেজিতে বেড়েছে ২৫-৩০ টাকা। কিছু দিন আগেও প্রতি কেজি পোলাও চাল বিক্রি হয়েছে ৬৫-৭০ টাকা দরে। গতকাল একই মানের চাল ৯৫-১০০ টাকা দরে।
অন্যান্য পণ্যের মধ্যে ২০ টাকার লবণ দুই দফায় বেড়ে ২৭ টাকা, আমদানি রসুন ৬০-৭০ টাকা, দেশি পেয়াজ ২৫-২৮ টাকা, আমদানি পেয়াজ ২০-২৫ টাকা, আমদানি আদা ৬০-৭০ টাকা, মসুর ডাল মানভেদে ৭০-১১০ টাকা, জিরা ৪৭০-৫০০ টাকা, এলাচি ২৪০০-২৫০০ টাকা, দারুচিনি ২৮০-৩০০ টাকা, লবঙ্গ ২ হাজার টাকা দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে। শিশুখাদ্যের দামও আকাশচুম্বী। এক কেজি ওজনের ডিপ্লোমা গুঁড়া দুধ ৫৩০ টাকা থেকে বেড়ে ৫৭৫ টাকা, ৫০০ গ্রামের দুধের দাম ২৭০ টাকা থেকে বেড়ে ২৯০ টাকা, ৫০০ গ্রামের ডানো ২৮৫ থেকে বেড়ে ২৯৮, ৪০০ গ্রামের ডানো ২৩৫ টাকা থেকে বেড়ে ২৪৮ টাকা, এক কেজি ডানোর ৫৬০ টাকা থেকে বেড়ে ৫৯৬ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া মার্কস ও ফ্রেশ দুধের কেজি ৫০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। খরচ বাঁচাতে কম দামের পুকুরে চাষ করা পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া মাছ ছিল অনেকের ভরসা। কয়েক মাস আগেও পাঙ্গাস ৭০-৮০ টাকা ও তেলাপিয়া ১০০ টাকায় কেনা যেত। গতকাল পাঙ্গাস ১২০-১৪০ টাকা ও তেলাপিয়া ১৪০-১৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কম দামের তেলাপিয়া আর পাঙ্গাস খেতে খেতে যারা বিরক্ত, তাদের স্বস্তি ব্রয়লার মুরগিতে। সেই মুরগির কেজিও এখন ১৬৫ টাকা। ফার্মের মুরগির ডিমের হালি উঠেছে ৩৬-৩৮ টাকা। এছাড়া ১৮০-২০০ টাকার বড় রুই বর্তমানে ২০০-২৫০ টাকা ও দেশি রুই ২৫০-৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কই ২৫০-৩০০ টাকা, শোল ৩০০-৪০০, টেংরা ৩০০-৩২০ টাকা, পুঁটি ৩০০ টাকার কম পাওয়া যায় না। আর চাষ করা কই বিক্রি হচ্ছে ২০০-২৫০ টাকা কেজি দরে। গরুর মাংস প্রতি কেজি ২৮০ টাকা ও মাঝারি আকারের দেশি মুরগি প্রতিটি ৩৫০-৪০০ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, এক বছর আগের তুলনায় বর্তমানে ডিমের দাম ৫৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ, রুই মাছ ২৫ শতাংশ, ব্রয়লার মুরগি ১৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেড়েছে। সবজির বাজারে স্বস্তি নেই। বাজারে সব ধরনের সবজির দাম বেড়েছে। বর্তমানে প্রায় সব ধরনের সবজির দাম ৪০ টাকার কমে পাওয়া যায় না। গতকাল হাজীগঞ্জ বাজারে প্রতি কেজি করল্লা ৬০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। এছাড়া পটল ৪০-৪৫ টাকা, ঝিঙ্গা ৬০ টাকা, বরবটি ৬০-৬৫ টাকা, ঢেঁড়স ৪০ টাকা, বেগুন ৩৫ টাকা, শশা ২৫ টাকা, টমেটো ৩০-৪০ টাকা, শিম ৩০ টাকা ও পেঁপে ২৪ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। এছাড়া প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ১৬ টাকা থেকে ২২ টাকার মধ্যে। কয়েক দিন আগেও এসব সবজির দাম ছিল ১৫ থেকে ২০ টাকার মধ্যে। এ সময় মটরশুঁটি, শিম, টমেটো, গাজর, ফুলকপি ও বাঁধাকপিসহ সব রকমের সবজির দামই বেড়েছে।
শিরোনাম:
বুধবার , ২৩ এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ১০ বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।