মোশতাক আহমদ
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত সংগঠন জামায়াতে ইসলামী এখন সহিংসতা পরিহার করে জনমুখী কর্মসূচির কথা ভাবছে। একই সঙ্গে দলের অস্তিত্ব রক্ষা, মামলা ও পুলিশি হয়রানি থেকে নেতা-কর্মীদের রক্ষা এবং দেশে দ্রুত আরেকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের স্বার্থে জোটের প্রধান শরিক বিএনপি থেকে আলাদা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াত। সংগঠনটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ তথ্য জানা গেছে। তবে কেউ এ বিষয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে রাজি হননি।
জামায়াতের নেতারা বলছেন, দলের অস্তিত্বের প্রশ্নটিই এখন নেতা-কর্মীদের কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। বিএনপির সঙ্গে জামায়াত জোটবদ্ধ রাজনীতির পাশাপাশি সরকারবিরোধী আন্দোলন করছে। কিন্তু মাঠে বিএনপিকে পায়নি জামায়াত। ফলে আন্দোলনে সংগঠনের ক্ষয়ক্ষতি ও নেতা-কর্মীদের হতাহতের বড় অংশই হয়েছে জামায়াতের। ফলে আগামী আন্দোলন পরিকল্পনায় বিএনপিকে শক্ত সহযোগী হিসেবে বিবেচনায় নিতে পারছে না জামায়াত। তাই তারা যেকোনো মূল্যে দেশে আবারও একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চায়।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার এক সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশের প্রয়োজনে আমরা রাজনীতিতে যেকোনো পরিবর্তনে বিশ্বাসী।’ বিএনপি থেকে আলাদা হচ্ছেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের এ নেতা বলেন, এটা সংগঠনের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার বৈঠকে বিবেচনা করা হবে।
জামায়াতের একটি সূত্র জানায়, তারা প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য না দিলেও নতুন নির্বাচনের স্বার্থে বিএনপির সঙ্গ ছাড়তে প্রস্তুতি নিয়েছে। কারণ, জামায়াত আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না এটা প্রায় নিশ্চিত। আদালতে আপিল থাকলেও নির্বাচন কমিশন অনেক আগেই তাদের জানিয়ে দিয়েছে যে জামায়াতের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
জানতে চাইলে ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে জামায়াতের ঢাকা মহানগরীর এক নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সুযোগ পেলে আমরা জোটবদ্ধ নির্বাচন করলেও বিএনপির কোনো প্রতীক নেব না।’ তিনি বলেন, জামায়াত নির্বাচনে গেলে স্বতন্ত্র হয়ে করবে। না হয় বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের মনোনীত প্রার্থীকে ভোট দেবে। তবে সরকারের সঙ্গে কোনো আপসের সম্ভাবনা নেই বলেও জানান এ নেতা।
জামায়াতের নেতারা দাবি করেন, আওয়ামী লীগ ফের সরকার গঠন করায় তারা জামায়াতের কারাবন্দি শীর্ষস্থানীয় নেতাদের একের পর এক ফাঁসি দিতে পারে- তাদের কাছে এমন আলামত স্পষ্ট। সে ক্ষেত্রে দল রক্ষায় তাদের নতুন করে পরিকল্পনা করতে হচ্ছে।
এদিকে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব বেড়ে যাওয়ার একাধিক কারণও মূল্যায়ন করছেন দলের নেতারা। জামায়াতের নেতারা মনে করছেন, জনমতের চাপে বিএনপি এখন জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের কথা বিবেচনা করছে। অন্যদিকে আন্দোলনে জামায়াত-শিবিরের সহিংসতার কোনো দায়ভার মাথায় নিতে চাইছে না বিএনপি। গত সোমবার রাতে ১৮ দলের সভায় বিএনপির পক্ষ থেকে বিষয়টি জামায়াতকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব কারণ বিশ্লেষণ করে রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে সাময়িকভাবে বিএনপির সঙ্গ ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াত।
দলটির আরেকটি সূত্র জানায়, বিএনপির সঙ্গ ছাড়লেও পৃথকভাবে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের রক্ষায় কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে জামায়াত-শিবির। নেতারা জানান, এখন বিএনপির সঙ্গ ছাড়লেও আন্দোলনের মাধ্যমেই টিকে থাকতে হবে তাদের। দলে বিপুলসংখ্যক তরুণ নেতা রয়েছেন, যাঁরা সংগঠন পরিচালনায় সক্ষম। আগামী নেতৃত্ব তাঁদের হাতেই থাকছে। তাঁরাই দলকে সংগঠিত করছেন। রাজনৈতিক কর্মসূচি ও আন্দোলনে থাকলে দলের নেতা-কর্মীরা সক্রিয় থাকবে। এতে দল চাঙ্গা থাকবে। মাঠেও জামায়াতের প্রভাব থাকবে।
সূত্র জানায়, অতীতের মতো আগামী আন্দোলনেও সমানতালে সক্রিয় থাকবে না বিএনপি, সেটিও তাদের মাথায় রয়েছে। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধের বিচার ও দণ্ডপ্রাপ্ত নেতাদের ফাঁসি কার্যকরের সময় বিএনপির প্রকাশ্য কোনো সমর্থন পাবে না জামায়াত- তা নিশ্চিত হয়েছেন দলের নীতিনির্ধারকরা।
জামায়াতের দলীয় সূত্রগুলো আরো বলছে, শিবিরের একাধিক নেতা এখন জেলে রয়েছেন। ছাত্রভিত্তিক সংগঠনটির কয়েক হাজার নেতা-কর্মীর শিক্ষাজীবন ঝুলে আছে মামলাসহ বিভিন্ন জটিলতায়। তাই সামনে খুব ভেবেচিন্তে আন্দোলনে তাদের সম্পৃক্ত করার কথা ভাবা হচ্ছে। শিবিরের সাম্প্রতিক সহিংসতা নিয়ে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে শিবিরকে আন্দোলনের কোন স্তরে সম্পৃক্ত করা হবে, সেটি জামায়াত নেতাদের ভাবনার বড় বিষয় হয়ে উঠেছে।
জামায়াত নেতারা বলছেন, আগামী দিনেও রাজনীতির মাঠে টিকে থাকতে হলে জামায়াতকে কোনো না কোনো কর্মসূচি নিয়ে থাকতে হবে। সেটা সহিংস না হলেও হতে হবে জনমুখী। তাই তাদের নেওয়া পরিকল্পনায় রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে থাকবে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। পাশাপাশি থাকবে দিবস ও বিষয়ভিত্তিক রুটিন কর্মসূচি। মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশ কর্মসূচিও থাকবে, তবে এসব করতে গিয়ে সহিংসতা থেকে দূরে থাকার জন্য নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে সংগঠনকে ভেতরে ভেতরে চাঙ্গা করেই জামায়াত চূড়ান্ত কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে চাইছে বলেও জানা গেছে।