মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক এই সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী( নিশা দেশাই) কে ‘দুই আনার মন্ত্রী’ ও
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাকে ‘কাজের মেয়ে মর্জিনা’ বলেছেন
============================================================
মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালের সাম্প্রতিক সফর নিয়ে হঠাৎ করেই উত্তপ্ত রাজনৈতিক মাঠ। সফরকালে সরকারের শীর্ষ ব্যক্তি ও প্রভাবশালী মন্ত্রী-নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ না হওয়ার ঘটনায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে খোদ সরকারের মধ্যে। বিশেষ করে প্রথম দিনে বিএনপি নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রশ্নবিদ্ধ করেছে সরকারের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডকে। সফর শেষে সংবাদ সম্মেলনে নিশা দেশাই ‘বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী ও অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র দেখতে চায় তার দেশ’ বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে সরকারের তুলনায় বিএনপির দিকেই যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের পাল্লা কিছুটা ভারি বলেই আভাস মিলছে। সরকারের ক্ষুব্ধ মনোভাব প্রথম প্রকাশ পায় নিশা দেশাইকে নিয়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফরাফের বক্তব্যে। এমনকি তিনি সমালোচনা করতে ছাড়েননি মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনার কর্মকাণ্ড ও নিশা দেশাইকে ঘিরে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার মনোভাব নিয়েও। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া : নিশা দেশাই দেশে অবস্থানকালেই শনিবার খুলনায় মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সৈয়দ আশরাফ হোসেন প্রকাশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক এই সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ‘দুই আনার মন্ত্রী’ বলে উল্লেখ করেন। তার সম্পর্কে বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই আনা, চার আনাও না, এক মন্ত্রী আছে নিশা দেশাই। ভারতীয় বংশোদ্ভূত, যদিও সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক।’ নিশা দেশাইকে জড়িয়ে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সমালোচনা করেন সৈয়দ আশরাফ। তিনি বলেন, ‘নিশা দেশাই বিসওয়ালের দিকে হাত পেতে বসে আছেন খালেদা জিয়া, ক্ষমতাটা যাতে এই মিস দেশাই খালেদা জিয়ার হাতে তুলে দেবেন। যতবারই সাক্ষাৎ করুন না কেন কোনো লাভ হবে না।’ এমনকি সমালোচনা করতে ছাড়েননি খোদ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাকে নিয়েও। মজিনাকে ‘কাজের মেয়ে মর্জিনা’ সম্বোধন করে তিনি বলেন, ‘কয়দিন আগে উনি (খালেদা জিয়া) ছিলেন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে। মজিনা তো কত চেষ্টা করল নির্বাচনটা (৫ জানুয়ারির) বন্ধ করার জন্য, শেখ হাসিনা যাতে প্রধানমন্ত্রী না হতে পারে তার জন্য। এমন কোনো প্রচেষ্টা নেই তিনি করেননি। বাংলাদেশ কিন্তু ওই অবস্থায় নেই যে, কাজের মেয়ে মর্জিনা বাংলাদেশের ক্ষমতার রদবদল করবে।’ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ আলম লেনিনের বক্তব্যেও সরকারের ভেতরকার ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘আজকে সারা দুনিয়াতে যত অশান্তি, সেখানেই তারা (যুক্তরাষ্ট্র)। তারা (যুক্তরাষ্ট্র) বাংলাদেশেও অশান্তি বাধাতে চায়। সুতরাং দেখা করেননি (নিশা দেশাই), ভালোই করেছেন। তাদের বুঝতে হবে, এখনকার বাংলাদেশটা ’৭৫ সালের বাংলাদেশ নয়। আমরা এখন নিজের অর্থে পদ্মা সেতু তৈরি করি।’ তবে তিন দিনের সফরেও প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের প্রভাবশালী কোনো মন্ত্রীর সঙ্গে নিশা দেশাইর সাক্ষাৎ না হওয়ায় খোদ প্রশ্ন উঠেছে সাক্ষাতের ব্যাপারে সরকারের আগ্রহ নিয়ে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, নির্বাচন-পরবর্তী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, দেশে ইসলামী জঙ্গিদের কর্মকাণ্ড ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নির্বাচনের পর থেকেই সরকারের সঙ্গে ঠিক বনিবনা হচ্ছিল না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। নিশা দেশাইর সফরে তার আভাস মিলেছে। জানা গেছে, অনেক আগেই নিশা দেশাইর সফরটি নির্ধারিত হয়েছিল। দিন-তারিখ চূড়ান্ত করার আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বৈদেশিক সম্পর্ক দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্তদের সফর সম্পর্কে বিস্তারিত অবহিত করেছিল ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস। সেভাবেই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাত্ চাওয়া হয়েছিল। অন্যান্য সাক্ষাতের শিডিউলগুলোও ঠিক করেছিল দূতাবাসই। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎসহ সরকারি বৈঠকগুলোর বিষয়ে দূতাবাস শেষ সময় পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছে। পররাষ্ট্র দফতর জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর এক উপদেষ্টা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে শেষ দিনে বৈঠক হলেও নিশা দেশাই প্রধানমন্ত্রীর দেখা পাননি। পররাষ্ট্র দফতরের সংশ্লিষ্ট উইং অবশ্য বলছে, শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলেও শনিবার ঢাকার বাইরে কর্মসূচি থাকায় সাক্ষাত্ সম্ভব হয়নি। নিশা দেশাই এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে জানান, শনিবার হবিগঞ্জের বিবিয়ানা গ্যাস ট্রান্সমিশন সিস্টেম উদ্বোধনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার যোগ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে তার যাওয়া হয়নি। কারণ সে সন্ধ্যায় তার উজবেকিস্তানে যাওয়ার সময় নির্ধারণ করা ছিল। এ নিয়ে অবশ্য সরকারের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ আলম লেনিন সকালের খবরকে বলেন, ‘সরকার কোনো গ্যাপ (দূরত্ব) তৈরি করেনি। তিনিই (নিশা দেশাই) গ্যাপ সৃষ্টির সুযোগ খুঁজছেন।’ পাল্লা বিএনপির দিকেই : নিশা দেশাইর সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্য-বিশ্লেষণেও আপাতত মার্কিন দূতিয়ালির পাল্লাটা বিএনপির দিকেই কিছুটা ভারি বলে আভাস মিলছে। ওবামা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ওই কর্মকর্তা স্পষ্টই বলেছেন, এখানে একটি শক্তিশালী ও অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র দেখতে চায় তার দেশ। তাই সব দলের অংশগ্রহণে সংলাপ জরুরি। দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি ও নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের সঙ্গে র্যাব সদস্যদের সম্পৃক্ততা বিষয়ে তিনি বলেন, এখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে ঘটনা ঘটছে সে বিষয়ে তার দেশ ও সরকার অবহিত। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতি এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। এ সময় তিনি দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর তদন্ত এবং অপরাধের সঙ্গে যুক্তদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন। এমনকি রাজনৈতিক সংলাপের বিষয়ে বিএনপি নেতার (খালেদা জিয়া) অবস্থান তার দেশ সমর্থন করে বলেও জানান তিনি। নিশা দেশাই তার দেশের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার প্রশংসা করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে তিনি খুবই সোচ্চার ছিলেন। মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সফরকে বিএনপির জন্য ‘পজিটিভ’ হিসেবেই দেখছেন দলের সহ-সভাপতি শমসের মোবিন চৌধুরী। তিনি সকালের খবরকে বলেন, ‘জনগণ সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। সে জন্য দুই নেত্রীর (শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া) সংলাপ প্রয়োজন। সেটি তিনিও (নিশা দেশাই) চান। জনগণের দাবির সঙ্গে ওনারাও (নিশা দেশাই ও তার দেশ) একমত। এটি আমাদের (বিএনপি) জন্য পজিটিভ।’ কূটনীতিকদের মন্তব্য : সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘নিশা দেশাইর সফর ছিল তার রুটিন ভিজিট। সার্ক সম্মেলনে এসেছেন, তাই দেশটাও ঘুরে গেলেন। এ নিয়ে এত আলোচনার কিছু নেই। এ সফরকে খুব বড় কিছু হিসেবে আমি দেখতেও চাই না। যতটুকু পেরেছেন, সাক্ষাৎ করেছেন। এ নিয়ে কারও কিছু বলারও দরকাই নেই।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান বলেন, ‘উনি (নিশা দেশাই) মাঝারি গোছের একজন কর্মকর্তা। প্রটোকল অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী বা শীর্ষ মন্ত্রীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে, এমন নয়। কিন্তু কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত যেটি হয়েছে, সেটি হল-তাকে নিয়ে আপত্তিকর ভাষা ব্যবহার করা। কারণ উনি মেহমান হিসেবে এসেছেন। এটি সামাজিকতাবহির্ভূতও বটে। এটি একটি সিগন্যাল হয়ে থাকল যে, তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়েছে। কূটনৈতিক শিষ্টাচার আইনেও অপমান করতে পারেন না। তিনি এসেছিলেন সম্পর্কের উন্নতি করতে। যেহেতু ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের নানা বিষয়ে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কটা জরুরি।’ নিশা দেশাই এবং মজিনা সম্পর্কে আশরাফের বক্তব্যে সরকারের ভেতরে বাইরে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর এমন বক্তব্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সরকারের বড় ধরনের দূরত্ব সৃষ্টির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। – See more at: https://www.thebengalitimes.com/details.php?val=2037&pub_no=10&menu_id=1#sthash.YO502zS4.Q9oYgrl9.dpuf