মিজানুর রহমান
চাঁদপুরের মেঘনা অববাহিকায় ইলিশ রক্ষা কর্মসূচি চলাকালীন নির্বিচারে চলছে ইলিশ নিধন। যে নদীতে ইলিশ মৌসুমে জেলেরা কাঙ্ক্ষিত ইলিশ পায়নি, সেই জেলেরা তাদের জালে এখন পাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ডিমওয়ালা ইলিশ। মৎস্য অধিদপ্তর ও প্রাণি সম্পদ বিভাগ এক প্রজ্ঞাপনে পূর্ণিমার ৫ দিন আগে ও ৫ দিন পরে এবং পূর্ণিমার একদিন মোট ১১ দিন ইলিশ প্রজনন মৌসুম রক্ষা কর্মসূচি নির্ধারণ করে ১৩ অক্টোবর থেকে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চলের ৪টি প্রজনন ক্ষেত্রসহ দেশের সকল নদ-নদীতে ইলিশ নিধন, ক্রয়-বিক্রয়, পরিবহন এবং বাজারজাত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে আইনগত শাসত্দির বিধান রয়েছে। কিন্তু চাঁদপুর মেঘনা অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সব জেলে এখন নদীতে। তারা অভিযান উপেক্ষা করে দিন-রাত ইলিশ শিকার করে যাচ্ছে। সে ইলিশে সয়লাব নদী তীরবর্তী এলাকাগুলো এবং মাছের আড়ৎ।
সরজমিনে দেখা যায়, প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ায় বড় আকারের এক হালি অর্থাৎ ৪টি ইলিশ এখন সাধারণ মানুষ মাত্র ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকায় কিনতে পারছে। এ সুযোগ হাত ছাড়া করতে চান না কেউ। ঘরের বউ ঝিয়েরা থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ ছুটে যাচ্ছে নদীর পাড়ে। যেখানে জেলেরা মাছ নিয়ে ঘাটে আসছে। একটি নৌকা তীরে ভিড়লে ওমনিতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন ক্রেতারা। ইলিশ কেনার জন্য মানুষের উপচেপড়া ভিড়। চাঁদপুরের টাস্কফোর্স প্রতিদিনই নদীতে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ কারেন্ট জাল, ইলিশ আটক করছে। জেলেদেরও আটক করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তি দিচ্ছে। তারপরও জেলেরা আইন অমান্য করে মাছ ধরছে, আড়ৎদার আড়তদারি করছে এবং জনগণও কম দামে কিনছে। এখন মানুষের ঘরে ঘরে ইলিশ আর ইলিশ। এ সুযোগ বছরের কয়েকটি দিন কেউ হাত ছাড়া করতে চান না। কোরবানির ঈদের মাংস বিত্তবানদের ফ্রিজে এমনিতেই জায়গা নেই। তার উপর এবার কম দামে অনেক ইলিশ পেয়ে এখন মাছ ও মাংসে ফ্রিজগুলো ঠাসা।
একটি সূত্রে জানা যায়, জেলা প্রশাসন ইলিশ প্রজনন মৌসুম রক্ষা কর্মসূচি সফল করার লক্ষ্যে যাতে কেউ ইলিশ মজুদ করতে না পারে এ কারণে এখানকার সকল বরফ কল এগার দিন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। কিন্তু শহরে নতুন বাজার ইলমা শাওরীন আইস ফ্যাক্টরী ও পুরাণবাজার লোহারপুল এলাকার ভাই ভাই আইস্ ফ্যাক্টরী বরফ উৎপাদন অব্যাহত রেখে সরবরাহ করছে। আরেকটি সূত্রে জানা যায়, চাঁদপুর সদর উপজেলার রাজরাজেশ্বর জাহাজমারা, লগ্নীমারাসহ এর আশপাশের চর এলাকার নির্জন স্থানে কতিপয় মাছ ব্যবসায়ী নদীতে ট্রলার নিয়ে জেলেদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ইলিশ সংগ্রহ করে চরে মজুদ করে রেখেছে। মা ইলিশ রক্ষা অভিযান শুরুর আগ থেকেই প্রচুর পরিমাণ বরফ সেখানে নিয়ে রাখা হয়েছে। জেলেরা জানায়, চাঁদপুর বড় স্টেশন বিপরীত মেঘনার পশ্চিম পাড় চেয়ারম্যান ঘাট ও শরীয়তপুরের দুলারচর এলাকায় প্রচুর ডিমওয়ালা ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া চাঁদপুরের পশ্চিম কল্যাণপুর, দাসাদী, তরপুরচণ্ডীর আনন্দ বাজার, শহরের বিকল্প লঞ্চঘাট এলাকা, পুরাণবাজার রনাগোয়াল, দোকানঘর গুচ্ছগ্রাম, বহরিয়া মাছ ঘাট, লক্ষ্মীপুর মৃধাবাড়ি সংলগ্ন গুচ্ছগ্রাম, হানারচর হরিণাঘাট ও আখনের হাটে জেলেদের নিধনকৃত ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া মেঘনার পশ্চিম পাড় ঈদগাহ বাজার মাছ ঘাট, আলু বাজার, হাইমচরের বিভিন্ন মৎস্য আড়তগুলোতে নিধনকৃত এসব মা ইলিশ আড়তে খুচরা ও পাইকারি বিক্রয় হচ্ছে অবাধে। খুচরা মাছ ব্যবসায়ীরা এসব ইলিশ বাজারে না বিক্রি করে বাড়িতে ফেরি করে বিক্রি করছে। অনেকে খাওয়ার জন্য ইলিশ কিনে নিচ্ছে। পুলিশ সুপার মোঃ আমির জাফরকে মাছঘাটগুলোতে প্রকাশ্যে ইলিশ ক্রয়-বিক্রয়ের বিষয়টি অবহিত করলে তিনি জানান, ঈদ ও পূজার কারণে আমাদের জনবলের কিছুটা সঙ্কট রয়েছে। তবে আমি বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছি। চাঁদপুর জেলা ভারপ্রাপ্ত মৎস্য কর্মকর্তা রতন দত্ত জানান, নিষেধাজ্ঞার পর থেকেই মৎস্য বিভাগ নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে। সরেজমিন পরিদর্শন করার জন্য ঢাকা থেকে মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তাগণ চাঁদপুরে এসেছেন। প্রকাশ্যে মাছ ক্রয়-বিক্রয়ের বিষয়টি তিনি দেখবেন বলে জানান। চাঁদপুর কোস্টগার্ড স্টেশন কমান্ডার লেঃ মাহফুজ জানান, মা ইলিশ নিধন না করার জন্য প্রচার প্রচারণা করা হলেও জেলেদের মধ্যে সচেতনতা দেখা যায়নি। নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে তারা মা ইলিশ নিধন করছে। আমাদের যে পরিমাণ লোকবল রয়েছে, তা নিয়ে প্রতিদিন ১৪-১৫ ঘণ্টা অভিযান পরিচালনা করছি। তবে মাছঘাট এলাকার স্থানীয় কিছু লোক আমাদের সহায়তা করবে বলেও আড়ালে গিয়ে তারা ইলিশ ক্রয়-বিক্রয় কাজ করছে। অনেক মৎসজীবী নেতা এর সাথে জড়িত রয়েছে।