রেলকে পরিবহনের প্রধান মাধ্যমে পরিণত করতে চায় সরকার। এজন্য রেল অবকাঠামোর উন্নয়নে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ৩০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা, যার শুরু ২০১৬ সালে। নতুন রেলপথ নির্মাণ, বিদ্যমান রেলপথের সক্ষমতা বৃদ্ধি, নতুন ইঞ্জিন-কোচ সংগ্রহ, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পরিচালন ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ এবং রেলওয়ের বাণিজ্যিক কার্যক্রমের পরিসর বাড়াতে এ মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন নীতিনির্ধারকরা।
মহাপরিকল্পনাটির আওতায় ছয় ধাপে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকার ২৩০টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। এর প্রথম ধাপে ২০১৬-২০ সালের মধ্যে মোট ৮৩টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়েছিল রেলওয়ে। প্রথম ধাপের মেয়াদ পেরিয়ে আরো দুই বছর শেষ হতে চললেও এখন পর্যন্ত এর মধ্যে একটি প্রকল্পও বাস্তবায়ন হয়নি। চলমান রয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি প্রকল্প। যদিও মহাপরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপের মেয়াদ এর মধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। ২০২১-২৫ মেয়াদে আরো ৬৭টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে এতে।
মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে এ অচলাবস্থার পেছনে রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়ের দুর্বলতাকে দায়ী করছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, মহাপরিকল্পনা করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটি পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এ পরিকল্পনাহীনতার দায় মন্ত্রণালয় ও রেলওয়ে—উভয়ের ওপর কিছুটা হলেও বর্তায়।
প্রথম ধাপে ২০১৬-২০ মেয়াদে বাস্তবায়ন পরিকল্পনায় থাকা ৮৩ প্রকল্পের মধ্যে ১৫টিকে রাখা হয়েছিল ‘উচ্চ প্রাধিকার প্রকল্প’ হিসেবে। যদিও এখনো যমুনা নদীতে স্বতন্ত্র রেলসেতু, আখাউড়া-আগরতলা ডুয়াল গেজ রেলপথ আর বগুড়া-মনসুর আলী ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ এবং কিছু ইঞ্জিন (লোকোমোটিভ) ও কোচ-ওয়াগন সংগ্রহ বাদে ‘উচ্চ প্রাধিকার’ পাওয়া আর কোনো প্রকল্পই শুরু করতে পারেনি রেলওয়ে।
এছাড়া ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণ, আখাউড়া-সিলেটের বিদ্যমান মিটার গেজ রেলপথকে ডুয়াল গেজে রূপান্তর, ঈশ্বরদী-জয়দেবপুর ও জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ-জামালপুরের মধ্যে দ্বিতীয় রেলপথ নির্মাণ, পার্বতীপুর লোকোমোটিভ কারখানার আধুনিকীকরণ, নারায়ণগঞ্জে একটি লোকোমোটিভ ও একটি ডেমু কারখানা নির্মাণ, নয়টি ডিজেল লোকো শেড পুনর্নির্মাণ, গাজীপুরের ধীরাশ্রমে ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) নির্মাণ এবং যশোর-বেনাপোল রেলপথ পুনর্বাসন কার্যক্রম বাস্তবায়ন প্রথম ধাপের ‘উচ্চ প্রাধিকারের’ তালিকায় থাকলেও তা শুরু হয়নি।
মহাপরিকল্পনায় প্রথম ধাপের ৮৩ প্রকল্পের জন্য সব মিলিয়ে মোট ১ লাখ ৮৭ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা বিনিয়োগের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। ২০২১-২৫ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য দ্বিতীয় ধাপের ৬৭ প্রকল্পে বিনিয়োগ হওয়ার কথা রয়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ রেলওয়ের এ ৩০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনাটিকে যুগোপযোগী হিসেবে অভিহিত করলেও এর বাস্তবায়ন অপরিকল্পিতভাবে হচ্ছে বলে মনে করেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, রেলের এ মহাপরিকল্পনাটি লাইনচ্যুত হয়ে গিয়েছে। এর পেছনে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ঘাটতির দায় রয়েছে। সবচেয়ে জরুরি ছিল দেশের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাগুলোর সমন্বয় করে এগুলোর বাস্তবায়ন। এ কাজটিই হচ্ছে না। মহাপরিকল্পনার কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। আবার এগুলোও করা হচ্ছে বিক্ষিপ্তভাবে। যে প্রকল্পে অর্থায়ন পাওয়া যাচ্ছে, সেটাই করা হচ্ছে। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্রমও ঠিক থাকছে না। যে প্রকল্পটা পরে করা দরকার, সেটি আগেই হয়ে যাচ্ছে। আবার আগের প্রকল্পগুলো হচ্ছে না।
অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, এ ধরনের মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন বেশ সহজ, কিন্তু বাস্তবায়ন অনেক কঠিন। মহাপরিকল্পনা পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়ন না হলে সাধারণ মানুষ তার সুফল পাবে না।
দ্বিতীয় ধাপে বাস্তবায়নের তালিকায় রয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড রেলপথ, চট্টগ্রাম বন্দরে ইন্টার-মোডাল টার্মিনাল, মোংলা বন্দরে আইসিডি ও কমলাপুর রেলওয়েকে মাল্টি-মোডাল ট্রান্সপোর্ট হাবে রূপান্তরের মতো বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প।
মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী তৃতীয় ধাপে ২০২৬-৩০ মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে ৩৭টি প্রকল্প। এতে খরচ হবে ৯৪ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। পঞ্চগড় থেকে বাংলাবান্ধা পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণ, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রেল রুটে দ্বিতীয় রেলপথ নির্মাণ, সিগন্যাল ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, একাধিক নতুন আইসিডি নির্মাণের মতো প্রকল্প রয়েছে এ ধাপে।
চতুর্থ ধাপে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ২৩টি প্রকল্প, যাতে ব্যয় হবে প্রায় ৯৭ হাজার কোটি টাকা। একইভাবে পঞ্চম ও ষষ্ঠ ধাপে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা যথাক্রমে ১৪ ও ছয়টি প্রকল্প। এসব প্রকল্পের জন্য প্রাক্কলিত সম্ভাব্য বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৯৫ হাজার কোটি টাকা।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০-৩০ সাল পর্যন্ত একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। পরবর্তী সময়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে এটি হালনাগাদ করা হয়। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয় ২০১৬ থেকে ২০৪৫ সাল পর্যন্ত।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সংস্থাটি ৮৩টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে মহাপরিকল্পনার প্রথম ধাপে অর্থাৎ ২০১৬-২০ মেয়াদে বাস্তবায়ন হয়েছে নয়টি প্রকল্প, যার আটটিই ছিল সমীক্ষা প্রকল্প।
অন্যদিকে বর্তমানে উন্নয়ন ও কারিগরি সহায়তা মিলিয়ে চলমান আছে ৩৭টি প্রকল্প। মহাপরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপে ৬৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার কথা থাকলেও ২০২০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত রেলওয়ের মাত্র তিনটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)।
এমন প্রেক্ষাপটে খোদ রেলওয়ের কর্মকর্তারাই ৩০ বছর মেয়াদি এ মহাপরিকল্পনার বিষয়ে হতাশার কথা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, মহাপরিকল্পনার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, দেশের সার্বিক রেল অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটিয়ে মানুষের জন্য সহজ, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। পাশাপাশি পণ্য পরিবহন সক্ষমতা বৃদ্ধি করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখা এবং রেলের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন যত বিলম্বিত হবে, এসব লক্ষ্য পূরণ ততই বিলম্বিত হবে বলে মনে করছেন তারা।
তবে রেলের উন্নয়নে এখন পর্যন্ত সরকার সঠিক পথেই হাঁটছে বলে মনে করছেন রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন রেলের কোনো উন্নয়ন হয়নি, বরং নানাভাবে খাতটি সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে রেলের সবখানেই একটা বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতি রাতারাতি পূরণ সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রেল খাতের উন্নয়নে ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগ করছে।
পদ্ধতিগত কিছু জটিলতার কারণে রেলের মহাপরিকল্পনায় থাকা প্রকল্পগুলো সঠিক সময়ে গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না বলে অভিমত রেলমন্ত্রীর। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অর্থায়ন আমাদের এখানে প্রকল্প বাস্তবায়নে একটা বড় সমস্যা। এ সমস্যা মিটলে আবার জমি অধিগ্রহণে আরেকবার সমস্যায় পড়তে হয়। বর্ষাকালে আমরা কোনো কাজ করতে পারি না। এর মধ্যে করোনা মহামারী এবং বর্তমানে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধও প্রকল্প বাস্তবায়ন বিঘ্নিত করছে। তবে সব ধরনের প্রতিকূলতা কাটিয়ে আমরা ধারাবাহিকভাবে রেলের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি। এ উন্নয়ন যাত্রায় ৩০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনাকে আমরা একটি গাইডলাইন ধরে এগোচ্ছি।’
শামীম রাহমান