পরিবেশ অধিদপ্তরের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ফরিদগঞ্জ উপজেলার বালিথুবা গ্রামে কৃষি জমিতে ইটের ভাটা নির্মাণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে আশপাশের কয়েক শ’ একর কৃষি জমি মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে এবং সামগ্রিকভাবে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, চাঁদপুরের জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে প্রেরিত এলাকাবাসীর অভিযোগপত্র সূত্রে এবং সরজমিনে ইটভাটা নির্মাণের স্থান পর্যবেক্ষণ ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, ফরিদগঞ্জ উপজেলার ২নং বালিথুবা (পূর্ব) ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের পূর্ব বালিথুবা গ্রামে কৃষি জমিতে একটি ইটের ভাটা নির্মাণ কাজ চলছে। একই গ্রামের মোঃ কামাল হোসেন ২.০৪ একর আবাদযোগ্য কৃষি জমিতে উক্ত ইটের ভাটা নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন। ইটের ভাটা চলমান থাকলে পার্শ্ববর্তী তিন ফসলী জমির চাষাবাদ নষ্ট হওয়া এবং ঘনবসতিপূর্ণ এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্টের আশঙ্কায় স্থানীয় এলাকাবাসী ইটভাটা নির্মাণ প্রক্রিয়া বন্ধের জন্যে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে তাদের স্বাক্ষর যুক্ত চিঠি প্রেরণ করেন। চিঠিতে এলাকাবাসীর পক্ষে উল্লেখ করা হয়, চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের অভ্যন্তরে একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা তথা ৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৩টি বাজার, ১টি হাসপাতাল এবং সর্বোপরি সবুজ ছায়াঘেরা শান্ত পরিবেশে কৃষি জমিতে এ ধরনের ইটের ভাটা নির্মাণ বেআইনী। আরো বলা হয়, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) অনুযায়ী সরকার ঘোষিত সেচ প্রকল্পের অধীনে কৃষি জমিতে কোনোরূপ ইটের ভাটা নির্মাণ এবং পরিচালনা করা সম্পূর্ণ বেআইনী, শাসত্দিযোগ্য অপরাধ।
জনস্বাস্থ্যের প্রতি মারাত্মক হুমকিস্বরূপ এমন প্রকল্প বন্ধে এলাকাবাসীর আবেদনের প্রেক্ষিতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের পরিবেশ শাখা-৩ হতে সিনিয়র সহকারী সচিব হাবিবুর রহমানের স্বাক্ষরে চলতি সালের ৩১ মার্চ এক পত্রে ইট ভাটা নির্মাণের বিষয়টি সরজমিনে তদন্ত পূর্বক পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নিকট প্রতিবেদন চাওয়া হয়। তারপরও মালিক পক্ষ ইটভাটা নির্মাণ অব্যাহত রাখার প্রেক্ষিতে এলাকাবাসীর পক্ষে সমপ্রতি ৫১০ জনের স্বাক্ষর সম্বলিত আরো একটি আবেদনপত্রে চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের কাছে ইট ভাটা নির্মাণ বন্ধের আবেদন করা হয়। এ আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ২৬ সেপ্টেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তর চাঁদপুর জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোঃ আরেফিন বাদল স্বাক্ষরিত এক পত্রে ইট ভাটার মালিক মোঃ কামাল হোসেনকে তার ভাটার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ পাওয়ায় পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। অন্যথায় পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও বিধিমালা অনুসারে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরসহ আইনানুগ ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে বলে পত্রে জানানো হয়। কিন্তু বাসত্দবতা হলো উক্ত ব্রিক ফিল্ড নির্মাণ কাজ অব্যাহত রয়েছে। এ কর্মকর্তাই (সহকারী পরিচালক) চলতি বছরে একই এলাকার মেসার্স কবির এন্টারপ্রাইজ (ব্রিক ফিল্ড)কে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদান না করণ প্রসঙ্গে পত্র দিয়েছেন। তাতে তিনি বলেছেন, আপনার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উপস্থাপনকৃত সকল কাগজপত্র পর্যালোচনাপূর্বক দেখা যায়, প্রসত্দাবিত প্রতিষ্ঠানটি সরকার ঘোষিত সেচ প্রকল্পের অভ্যন্তরে বিদ্যমান এবং বিদ্যমান জায়গাটি তিন ফসলি কৃষি জমি হওয়ায় পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত-২০১০) অনুযায়ী সরকার ঘোষিত সেচ প্রকল্পের অধীন কৃষি জমিতে কোনোরূপ ইটভাটা নির্মাণ এবং পরিচালনা করা সম্পূর্ণ বেআইনি ও শাসত্দিযোগ্য অপরাধ। এমতাবস্থায়, সেচ প্রকল্পের অভ্যন্তরে কৃষি জমিতে প্রসত্দাবিত ব্রিক ফিল্ডের অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে বিধি নিষেধ থাকায় অনুমোদনের সুপারিশ করা যাচ্ছে না। সুতরাং সেচ প্রকল্পের অভ্যন্তরে উক্ত ব্রিক ফিল্ড নির্মাণ এবং নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে বিরত থাকার জন্যে অনুরোধ করা হলো। অন্যথায় আপনার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করার কারণ জানতে চাইলে ব্রিক ফিল্ডের স্বত্বাধিকারী মোঃ কামাল হোসেন জানান, সরকারের সকল বিভাগের অনুমোদন নিয়েই আমরা ইটের ভাটা নির্মাণ করছি। পরিবেশ অধিদপ্তরের চিঠির জবাবও আমরা দিয়েছি। তিনি বলেন, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের অনাপত্তিপত্র নিয়েই আমি কাজ শুরু করেছি। পর্যায়ক্রমে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স লাইসেন্স, কুমিলস্না সামাজিক বন বিভাগ ও উপজেলা কৃষি অফিসের ছাড়পত্র, জেলা প্রশাসক কার্যালয় হতে ইটভাটা নির্মাণ ও পরিচালনার লাইসেন্স নিয়ে এবং ব্যবহৃত জমির মালিকদের সাথে চুক্তিপত্র করে আমি কাজে হাত দিয়েছি। তিনি বলেন, আধুনিক জিগজাগ কিলন পদ্ধতিতে নির্মিতব্য এই ইটের ভাটার মাধ্যমে আমার এলাকার কোনো ক্ষতি তো হবেই না, উল্টো কয়েক শ’ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এতে একটি পক্ষ অযথাই এই উদ্যোগটিকে বাধাগ্রসত্দ করতে চাচ্ছে। ভুক্তভোগী এলাকাবাসী কামাল হোসেনের এ বক্তব্যে মন্তব্য করেন, তিনি যে সকলকে ‘ম্যানেজ’ করে কথিত ছাড়পত্র এনেছেন তা’ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, তিনি যে জায়গায় ব্রিক ফিল্ড করতে চাচ্ছেন তা তো সেচ প্রকল্পের অভ্যন্তরেই, তার জন্যে কবির এন্টারপ্রাইজের মতো উপরোক্ত নিষেধাজ্ঞাই প্রযোজ্য।
সরজমিনে নির্মাণাধীন ব্রিক ফিল্ডের স্থানে গিয়ে দেখা যায়, একদিকে ফসলি জমিতে পানি সেচের পাম্প চলছে। আর ওই সবুজে ঘেরা ফসলি জমির মধ্যখানে ইটের ভাটা নির্মাণের কাজ চলছে। ফলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই ইট ভাটা নির্মাণের ফলে এ অঞ্চলের শ’ শ’ একর ফসলি জমি গ্রাস হবে এবং গ্রামের একমাত্র চলাচলের রাসত্দাটি ইট পরিবহনের ট্রাক্টর চলাচলের ফলে মারাত্মক ক্ষতিগ্রসত্দ হবে। সেই সাথে ঘনবসতিপূর্ণ এই স্থানটির পরিবেশগত বিপর্যয় তো হবেই। সরেজমিনে গিয়ে আরো দেখা যায়, ইতিমধ্যে ব্রিক ফিল্ডের চিমনি নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনের ফলে রাসত্দার বেহাল দশা হয়ে গেছে। ব্রিক ফিল্ড চালু হলে এ রাসত্দা যে আর চলাচলের উপযোগী থাকবে না এটা অনেকটা নিশ্চিত বলে এলাকাবাসী মনে করেন।