ডা.এস.জামান পলাশ:
পিত্তথলিতে পাথর রোগটি কোনো লক্ষণ ছাড়াই নীরবে বাসা বাঁধতে পারে শরীরে। পিত্তথলিতে পাথর হলে ক্যান্সারসহ বেশ কিছু জটিলতা তৈরি হতে পারে।
পিত্তথলি বা গলব্লাডার দেহের ভেতর একটি ছোট থলির মতো অঙ্গ, যা যকৃতের নিম্নভাগে (পেটের ভেতর ওপরের দিকে ডান অংশে) থাকে। এর প্রধান কাজ পিত্তরস সংক্ষরণ ও সরবরাহ করা। পিত্তথলি নিজে রস তৈরি করে না। পিত্তরস তৈরি হয় যকৃতে। পরে তা সূক্ষ্ণ নালির মাধ্যমে পিত্তথলিতে পৌঁছে। পিত্তথলিতে পিত্তরস থেকে কিছু পানি শোষণ করে। এতে পিত্তরসের ঘনত্ব কিছুটা বৃদ্ধি পায়।
যখন খাদ্য গ্রহণ করা হয় তখন বিভিন্ন মাধ্যমে (যেমন-হরমোন, স্নায়ু) পিত্তথলির মাংসপেশি সংকুচিত হয় এবং পিত্তথলির অপেক্ষাকৃত ঘন পিত্তরস সংকোচনের ফলে খাদ্যনালিতে প্রবেশ করে, যা পরে খাদ্যদ্রব্য হজমে (বিশেষ করে চর্বিজাতীয় খাবার) বিশেষ ভূমিকা রাখে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য কিছু পরিমাণ পিত্তরস সরাসরি যকৃৎ থেকে সূক্ষ্ণ নালির মাধ্যমে খাদ্যনালিতে প্রবেশ করে।
পিত্তথলির পাথর কিঃ-পিত্তথলির ভেতর ছোট ছোট বালুর দানার মতো হতে শুরু করে মটরশুঁটির দানা বা তার চেয়েও বড় আকৃতির শক্ত দানাদার বস্তু হিসেবে পিত্তথলির পাথর পাওয়া যায়। এগুলো সাধারণত পিত্তরসের সঙ্গে মেশানো অবস্থায় থাকে।
কেন হয় পাথরঃ-কি কারণে পিত্তথলিতে পাথরের সৃষ্টি হয়, এ নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও নিম্নলিখিত কিছু কারণকে এই পাথর সৃষ্টিতে সহায়ক ও নিয়ামক হিসেবে মনে করা হয়, যেমন-লিঙ্গঃ-এ ক্ষেত্রে মেয়েরা পুরুষের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ মাত্রায় বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। সাধারণত মেয়েদের দেহে অধিক মাত্রায় ইস্ট্রোজেন হরমোনের উপস্থিতি পিত্তরসে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং পিত্তথলির সংকোচন-প্রসারণের মাত্রা কমিয়ে দেয়।
পারিবারিক ইতিহাসঃ-অনেক সময় ধারণা করা হয়, জিন বা ক্রোমোজমের মাধ্যমে এ সমস্যা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে প্রবাহিত হয়।
ওজনঃ-বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, অধিক ওজন, এমনকি অনেক সময় মাঝারি ওজনের মানুষেরও এই পাথর হয়। এর প্রধান কারণ হলো, স্থূল ব্যক্তিদের পিত্তরসের মধ্যে পিত্তলবণ বা বাইসল্ট পরিমাণে কম থাকে, যা অনেক সময় পিত্তরসে কোলেস্টেরলের বা চর্বির মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে পাথর সৃষ্টির ঝুঁকি অনেক বাড়ায়।
খাদ্যতালিকাঃ-খাদ্যতালিকায় যদি অতিরিক্ত চর্বি থাকে এবং আঁশজাতীয় খাবারের পরিমাণ কম থাকে, তবে তা পাথর সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
খুব দ্রুত ওজন কমে যাওয়াঃ-দীর্ঘদিন ধরে কম খাওয়া বা অন্য কোনো কারণে দেহের ওজন যদি খুব দ্রুত কমে যায়, তবে সেই সময় যকৃৎ পিত্তরসের মাধ্যমে অতিরিক্ত চর্বি নিঃসরণ করে। ফলে এ সময় পিত্তপাথর তৈরির ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
বয়সঃ-৬০ বছরের বেশি হলে পুরুষ ও মহিলা উভয়ের ক্ষেত্রে পাথর সৃষ্টির ঝুঁকি যুবক বয়সের তুলনায় বেশি থাকে। কারণ বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পিত্তরসের মাধ্যমে চর্বির নিঃসরণের মাত্রাও বেড়ে যায়।
ডায়াবেটিসঃ-ডায়াবেটিক রোগীর রক্তে চর্বির পরিমাণ সাধারণত বেশি থাকে। তাই অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসকে পিত্তপাথর সৃষ্টির এক গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকি বলে মনে করা হয়।
টাইফয়েডঃ-অনেক সময় এই জীবাণু পিত্তথলিতে বাসা বেঁধে দীর্ঘদিন সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে, যা পাথর সৃষ্টিতে সহায়তা করে। তাই এ জ্বরে আক্রান্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক ওষুধ সেবন করা খুব জরুরি।
কিভাবে পাথরের সৃষ্টি হয়ঃ-নিচের কারণগুলো পিত্তপাথর সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে বলে মনে করা হয়।পিত্তরসে অধিক চর্বি থাকলে যকৃৎ থেকে যে নির্দিষ্ট পরিমাণ চর্বি পিত্তরসের মাধ্যমে নিঃসৃত হয় তা সাধারণত পিত্তরসে অবস্থিত এনজাইম দিয়ে প্রতিদিন দ্রবীভূত হয়। যদি কোনো কারণে এই রসে সাধারণ মাত্রার অধিক চর্বি থাকে তবে তা নির্দিষ্ট মাত্রার এনজাইম দিয়ে পরিপূণরুপে দ্রবীভূত হয় না। ফলে এই অদ্রবীভূত মিশ্রণগুলো পরে ধীরে ধীরে পাথর সৃষ্টিতে বিশেষ সহায়তা করে বলে মনে করা হয়।
পিত্তরসে অধিক বিলিরুবিন থাকলেঃ-রক্তের লোহিত কণিকা ১২০ দিন পর ভেঙে যকৃতে বিলিরুবিন সৃষ্টি করে, যা পিত্তরসের মাধ্যমে দেহ থেকে নিঃসৃত হয়। তাই অধিক বিলিরুবিন সৃষ্টিকারী কিছু অবস্থা যেমন-লিভার সিরোসিস, পিত্তনালির সংক্রমণ, রক্ত ভাঙা রোগ থ্যালাসেমিয়া ইত্যাদির সময় পিত্তপাথর সৃষ্টির ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
পিত্তথলি সঠিকভাবে সংকোচন-প্রসারণ না হলেঃ-এ রকম পরিস্থিতিতে পিত্তথলি থেকে পিত্তরস নিঃসরণে সামঞ্জস্যতা বজায় থাকে না, ফলে অনেক সময় সাধারণ মাত্রার অধিক পরিমাণ পিত্তরস থলিতে জমা হয়ে পাথর সৃষ্টিতে সহায়তা করে।
পিত্তপাথর কয় ধরনেরঃ-কোলেস্টেরল পিত্তপাথর : সাধারণত ৮০ শতাংশ রোগীর এ-জাতীয় পাথর হয়ে থাকে। এই পাথরগুলো সংখ্যায় কম, কালো বর্নের এবং আকৃতিতে সামান্য বড় হয়।রঞ্জিত পাথর : ১৫ শতাংশ রোগীর এ ধরনের পাথর হয়ে থাকে। এ পাথরগুলো দুই ধরনের। কালো ও বাদামি। দেহে বিলিরুবিনের সামঞ্জস্যের তারতম্য ঘটলে কালো পাথর সৃষ্টি হয়। এটি সংখ্যায় অধিক ও আকারে ছোট হয়। আবার পিত্তথলির সংকোচন-প্রসারণে সমস্যা হলে অথবা পিত্তপ্রবাহে কোনো কারণে বাধার সৃষ্টি হলে (পিত্তনালির সংক্রমণ) বাদামি পাথরের সৃষ্টি হয়।
রোগ নির্ণয়ঃ-আলট্রাসাউন্ড বা আল্ট্রাসনোগ্রাম : এর মাধ্যমে ডাক্তার খুব সহজেই পিত্তপাথর নিরূপণ করতে পারেন। পিত্তপাথরের সঙ্গে সঙ্গে এ পদ্ধতিতে পেটের ভেতর অন্যান্য অঙ্গ যেমন-যকৃৎ, প্লীহা, কিডনি, জরায়ু, প্রস্টেট ইত্যাদির বিভিন্ন জটিলতা নিরূপণ করা যায়।
সিটি স্ক্যান : পিত্তপাথর দীর্ঘদিন থাকার ফলে কোনো ধরনের জটিলতা দেখা দিলে সাধারণত ব্যয়সাপেক্ষ পরীক্ষা করা হয়।
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাঃ-পিত্তপাথর অপসারনের জন্য হোমিও বেশ কিছিু ঔষধ আছে তা কিছুদিন নিয়মিত সেবন করলে পাথর ভেঙ্গে চুরে বের হয়ে আসবে অতঃপর আল্টাসোনোগ্রাম করলে বুঝা যাবে পাথর আছে কি নাই।পাথর সম্পূর্ন নিমূল না হওয়া পর্যন্ত হোমিও ঔষধ সেবন করতে হবে।
এ্যালপ্যাথি চিকিৎসাঃ-সাধারণত সার্জারি বা শল্য চিকিৎসার মাধ্যমে এ সমস্যার চিকিৎসা করা হয়। সার্জারি দুইভাবে করা হয়। পেট কেটে বা ওপেন কোলেসিস্টেক্টমির মাধ্যমে অথবা ফুটো করে বা ল্যাপারোস্কোপিক কোলেসিস্টেক্টমির মাধ্যমে। বর্তমানে দ্বিতীয় পদ্ধতিতে সবচেয়ে বেশি রোগীর চিকিৎসা করা হয়। পেটের উপরিভাগে চারটি ফুটো করে মেশিনের সাহায্যে এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করলে রোগীকে যেমন কম দিন হাসপাতালে থাকতে হয়, তেমনি পেটে কোনো রকম দাগও থাকে না। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পিত্তপাথরের ফলে জটিলতা সৃষ্টি হলে এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা নাও করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রথম পদ্ধতিটি অবলম্বন করা হয়।
পিত্তপাথরের জটিলতাঃ-পিত্তপাথর অনেক ধরনের জটিলতা তৈরি করতে পারে, এমনকি যথাসময়ে চিকিৎসা না করা হলে ক্যান্সারও হতে পারে। সাধারণত নিচের জটিলতাগুলো দেখা যায়।
পিত্তথলিতে প্রদাহ : অনেক সময় পাথর থলিতে আটকে গিয়ে পিত্তথলিতে প্রদাহ সৃষ্টি করে। ফলে পেটে তীব্র ব্যথা ও জ্বর হতে পারে।
পিত্তনালিতে প্রদাহ : জন্ডিস, জ্বর বা পেটে ব্যথা হতে পারে।
অগ্ন্যাশয়ের নালিতে পাথর আটকে যাওয়া : এতে বদহজম ও পেটে ব্যথা হতে পারে।
প্রতিরোধঃ-* অতিরিক্ত ওজন ধীরে ধীরে কমানো * অধিক শ্বাসযুক্ত খাবার গ্রহণ যেমন-শাকসবজি, ফলমূল ইত্যাদি* অধিক পরিমাণ উদ্ভিজ্জ তেল বা ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ তেল গ্রহণ যেমন-সূর্যমুখী তেল, অলিভ অয়েল, অধিক প্রাণিজ চবি গ্রহণ এড়িয়ে চলা
* ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ২.৫-৩ লিটার পানি পান করা
(প্রাপ্ত বয়স্কদের)* নিয়মিত দৈহিক ব্যায়াম করা।
*পিত্তথলিতে পাথরের লক্ষণঃ-অনেকেই তীব্র ব্যথা নিয়ে ডাক্তারের কাছে আসেন তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের লক্ষণ থাকে না। সাধারণত দেখা যায়, অন্য কোনো স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় (যেমন আল্ট্রাসনোগ্রাম) হঠাৎ এই সমস্যা ধরা পড়ে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই নিচের লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে দেখা যায়।
* হঠাৎ করে ওপর পেটে তীব্র ব্যথা, বিশেষ করে রাতের বেলায় অধিক চর্বিজাতীয় খাবার গ্রহণ করার পর এ ব্যথা অনুভূত হয়ে থাকে। এ ব্যথা ১৫ মিনিট থেকে পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
* নড়াচড়া কম করা বা বিছানায় কোনো নির্দিষ্টভাবে শোয়ার মাধ্যমে এ ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। * কখনো কখনো এই ব্যথা ওপরের পেটে মাঝ বরাবর বা পিঠের দিকে ডান কাঁধের নিচ বরাবর অনুভূত হয়ে থাকে।* বমি বমি ভাব বা তীব্র বমি হতে পারে।
* পেটের মধ্যে অধিক গ্যাস সৃষ্টি হতে পারে।* বদহজম হবে * খাবারে অরুচি হতে পারে।
তবে পিত্তথলিতে পাথরের সঙ্গে যদি নিচের লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়, তবে তাড়াতাড়ি ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে : * অতিরিক্ত ঘাম হওয়া * খিঁচুনি * জ্বর
* চামড়া বা চোখ হলুদ বর্ণ ধারণ* ফেনা ফেনা পাতলা পায়খানা ইত্যাদি।
লেখক পরিচিতিঃ- ডাঃ এস.জামান পলাশ
জামান হোমিও হল
মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট,চাঁদপুর
০১৭১১-৯৪৩৪৩৫
শিরোনাম:
বৃহস্পতিবার , ২৭ মার্চ, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ১৩ চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।