চাঁদপুর শহরের পুরাণবাজার পশ্চিম জাফরাবাদ এলাকায় সিরাজ খানের ছেলে ফজলুর রহমান খান অচেনা, অজানা এক স্মৃতিশক্তিহীন পাগলকে সাড়ে ৫ বছর পরিচর্যা করে প্রকৃত পরিবারের সন্ধান পেয়ে মায়ের বুকে ফিরিয়ে দিয়ে মানুষ মানুষের জন্য এটাই প্রমাণ করলেন মহান ব্যক্তিত্ব। স্মৃতি শক্তিহীন পাগল যার প্রকৃত নাম ছিলো রফিক। নারায়নগঞ্জ বুইঘর এলাকা থেকে ৮ বৎসর পূর্বে হঠাৎ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে অজানা জায়গায় হারিয়ে যায়। ছেলে হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে পাগল রফিকের বাবা আব্দুল লতিফ শেখ ছেলের চিন্তায় একসময় মৃত্যুবরণ করেন। দীর্ঘ ৮ বৎসর সকল জায়গায় খোঁজ করার পর অবশেষে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিশক্তিহীন রফিকের সন্ধান পায় তার পরিবার। ছুটে আসে চাঁদপুর শহরের পুরাণবাজার পশ্চিম জাফরাবাদ এলাকায়। মায়ের অন্তরে জেগে উঠে এই সেই ছেলে। যে এতদিন নিখোঁজ ছিল। তার চাল-চলন, মুখমন্ডলে চিহ্ন দেখে মা নিলুফা ইয়াছমিন ছেলেকে চিনতে পারে। কিন্তু স্মৃতি শক্তিহীন পাগল রফিক তার মা ও বোন আয়শাকে দেখেও চিনতে পারেনি। অবশেষে রফিকের পরিচর্যাকারী মহান ব্যক্তি ফজলু রহমান খানের সন্ধানে ওই এলাকার সাবেক মেম্বারকে সাথে নিয়ে তার বাড়িতে যায়। রফিকের পুরনো ছবি দেখিয়ে তার মা ছেলেকে দেয়ার জন্য অনুরোধ জানায়। রফিকের পুরনো চেহারা, আর বর্তমান চেহারার সাথে রয়েছে আকাশ-পাতাল তফাত। কারণ তার পুরনো চেহারায় ছিলোনা কোন গোফ ও দাঁড়ি। হারিয়ে যাওয়ার পর থেকেই তার মুখমণ্ডলে দাঁড়ি উঠে। তাই একমাত্র মা ছাড়া প্রথমত তাকে কেউ শনাক্ত করতে পারেনি। দীর্ঘ সাড়ে ৫ বছর পূর্বে রফিক চাঁদপুর শহরে এসে পুরাণবাজার পশ্চিম জাফরাবাদ এলাকায় আশে। এসময় তাকে ভদ্র বেশি পাগল ভেবে নিজের সন্তানের মত বুকে টেনে নেয় সিরাজ খানের ছেলে ফজলুর রহমান খান। প্রতিদিন সকালে, দুপুরে ও রাতে নিজের হাতে খাবার খাইয়ে দিতেন তিনি। ফজলুর রহমান খানের ছোট মেয়ে ওয়াই ডব্লিউসি স্কুলের নার্সারীর ছাত্রী ফাইযা তাসনিম ইবতিদা ছিল স্মৃতিশক্তিহীন রফিকের শিক্ষক। স্মৃতিশক্তি হীন রফিককে আব্দুল কাদের নাম রাখে তার পরিচর্যাকারি ফজলুর রহমান খান। তার শিক্ষক ইবতিদা প্রতিদিন রাতে আব্দুল কাদের বলে সম্বোধন করে ঘরে এনে চেয়ারে বসিয়ে আদর্শ লিপি বই পড়াতেন ও হাতের লেখা শিখাতেন। তখন বাড়ির সবাই ইবতিদাকে পাগলের মাস্টার বলে সম্বোধন করত। স্মৃতিশক্তিহীন রফিক রাতের খাবার খেয়ে ও পড়াশুনা শেষে ঘুমানোর জন্য সোনাখনের বাড়ির সামনে জামে মসজিদের পাশে মুসাফির খানায় চলে যেতো। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সে দোকান ঘর বেড়ি রাস্তার উপরে নির্জন জায়গায় একাচিত্তে দাঁড়িয়ে থাকতেন। বিকেলে লোহার পুল এলাকায় মক্কা মেইলের সামনে একটি মাচার উপর বসে থেকে সময় কাটাতেন। সে কারো সাথে কোন কথা বলতোনা। কেউ তাকে কিছু ভিক্ষা দিত চাইলেও নিতেন না। সে ছিল ভদ্র বেশি মানসিক স্মৃতিশক্তিহীন পাগল। এলাকার সবাই তাকে খুবই আদর করতো এবং আব্দুল কাদের বলে সম্মোধন করতেন। হঠাৎ সাড়ে ৫ বছর পর তার ছেলে হারা সন্তানের খোঁজে রফিকের মা নিলুফা ইয়াছমিন, বোন আয়শা তাদের এক প্রতিবেশী মহিলাকে নিয়ে তার খোঁজে চাঁদপুরে আসেন। ওইদিন সকালে রফিকের পরিচর্যাকারী ফজলুর রহমান খানকে ওই এলাকার সমাজ সেবক নামে পরিচিত এক ব্যক্তি ডেকে নিয়ে বলেন, কেন এত বৎসর পরিচর্যা করে যাচ্ছ। কি তোমার স্বার্থকতা? পাগলকে না খাইয়ে হুজুরকে খাওয়ালে লাভ হবে। পাগলের সামনে তার পরিচর্যাকারী ফজলুর রহমানকে এই কথা বলার পরে উভয়েই কান্না শুরু করে। মানসিক স্মৃতিশক্তিহীন পাগল রফিক ওই ভদ্রবেশি সমাজ সেবকের কথা শোনার পরেই তার বিছানা পানিতে ফেলে দেয়। ঠিক কিছুক্ষণ পরেই আল্লার অশেষ রহমতে প্রকৃত মা রফিকের সন্ধানে পশ্চিম জাফরাবাদে এসে ছেলেকে দেখতে পায়। পরিচর্যাকারী ফজলুর রহমান খানে কাছে রফিকের মা গিয়ে সব কিছু খুলে বলাল পর রফিকের দাড়ি চুল কেটে তার পুরনো দাগ ও ছবির সাথে মিল খুঁজে পায়। গত শুক্রবার দুপরে মানসিক স্মৃতিশক্তিহীন রফিককে নেয়ার জন্য তার মা, বোন ও ভগনীপতি মোশারফ অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়।
এসময় তার মা নিলুপা ইয়াছমিন জানায়, নারায়নগঞ্জ বুইঘর এলাকায় থাকাবস্থায় রফিক ৮ বৎসর পূর্বে হঠাৎ ঘর থেকে বেড়িয়ে আর ফিরে আসেনি। সে ঢাকা ইসলামপুরে একটি কাপড়ের দোকানে চাকুরি করত। হয়তোবা কেউ তাকে কিছু খাইয়ে দিয়ে বা কবিরাজের মাধ্যমে কুপুরি করে শত্র“তাবশত পাগল করে ঘর ছাড়া করেছে। তাকে এতোদিন কোথাও খোঁজাখুজি করে না পাওয়ায় বিভিন্ন ওজা, বৌদ্ধে ও কবিরাজের কাছে গিয়েও কোন লাভ হয়নি। অবশেষে চঁদপুর গুণরাজদীর এক মহিলা বর্তমানে বিক্রমপুর লৌহজং থানার শাতগাঁও গ্রামে শ্বশুড় বাড়ি থাকাবস্থায় তার সাথে পরিচয় হয়ে ছেলে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা বলার পর তিনি চাঁদপুরে দেশের বাড়িতে এশে রফিককে দেখে খবর দেয়। তার তথ্য অনুযায়ী এসে রফিকের সন্ধান মিলে। ছেলের শোকে তার বাবা লতিফ শেখ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তারপর থেকে নারায়নগঞ্জ ছেড়ে বিক্রমপুর পাঁচগাও স্ব-পরিবারে এসে বসবাস শুরু করি। আল্লার অশেষ রহমতে অবশেষে তার সন্ধান মিলে। রফিককে নিয়ে যাওয়ার সময় তার পরিচর্যাকারী ফজলুর রহমান খান, তার স্ত্রী স্কুল শিক্ষিকা ফাতেমা সুলতানা মনি ও মেয়ে ইফদিতা অঝোড় ধারায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তাকে অ্যাম্বুলেন্সযোগে নেয়ার সময় ওই এলাকার শ’শ’ মানুষ রফিককে একবার দেখার জন্য ভিড় জমায়। বর্তমানে স্মৃতিশক্তিহীন রফিক ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছে।
শিরোনাম:
রবিবার , ৩ নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ , ১৯ কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।