দেশে আগাম জাতের মুড়িকাটা পেঁয়াজ এরই মধ্যে ঘরে তুলেছেন কৃষক। মূল মৌসুমের পেঁয়াজ বাজারে আসতে সময় বাকি আরো প্রায় এক মাস। এর মধ্যেই আরেক দফায় বাড়তে শুরু করেছে পেঁয়াজের দাম। গত দুই দিনে খুচরা বাজারে কৃষিপণ্যটির দাম বেড়েছে কেজিতে ২০-৩০ টাকা। রাজধানীর খুচরা বাজারে এখন প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৩০ টাকায়। পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকাকে পণ্যটির মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, এক সপ্তাহ আগেও রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশী পেঁয়াজের দাম ছিল ৮০-৯০ টাকা। এ হিসাব অনুযায়ী গত এক সপ্তাহে এখানে খুচরায় পণ্যটির দাম বেড়েছে কেজিতে ৩০-৪০ টাকা।
রাজধানীতে গত বছরের এ সময়ে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ৩০-৪০ টাকা। অর্থাৎ এক বছরে পণ্যটির দাম বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পেঁয়াজের দাম বাড়ছে গত বুধবার থেকে। পাইকারিতে গতকাল প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১১০-১১৬ টাকায়। বৃহস্পতিবার এ দাম ছিল ১০০-১১০ টাকা। আর বুধবার তা ছিল ৮৫-৯০ টাকা।
কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী মো. বাবুল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পেঁয়াজের দাম গত দুই দিনে কেজিপ্রতি ২০-৩০ টাকা বেড়েছে। আড়তে দাম বেশি। এ কারণে আমাদের বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। গতকালের চেয়েও আজ আরো বেশি দামে কিনতে হয়েছে।’
ডলার সংকটে পেঁয়াজ আমদানি এক প্রকার বন্ধ থাকায় বাজারে পণ্যটির সরবরাহ ঘাটতি রয়েছে বলে দাবি করছেন পেঁয়াজের আড়তদার ও পাইকাররা। বিষয়টিকে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে দায়ী করে তারা বলছেন, কৃষিপণ্যটির আমদানি শুরু করা গেলে এ সংকট অনেকটাই কেটে যাবে।
রাজধানীর শ্যামবাজারের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মাজেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভারত পেঁয়াজ রফতানি করছে না। ডলারের বিনিময় হার বেশি হওয়ায় অন্যান্য দেশ থেকেও আমদানি হচ্ছে না। সামনে রমজান। এ সময় সরকারি উদ্যোগে পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। কিছু পেঁয়াজ আমদানি না করলে সংকট দেখা দেবে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, চলতি বছর ২ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে ৩৬ লাখ ৭৩ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নেয়া হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৬ লাখ ৭৩ হাজার টন। এর মধ্যে ২৭ লাখ ২৮ হাজার টন চারা পেঁয়াজ, ৮ লাখ ১৯ হাজার টন কন্দ পেঁয়াজ ও ৫৬ হাজার টন পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নেয়া হয়েছে।
দেশে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ৩০ লাখ টন। সর্বশেষ গত অর্থবছরে দেশে ৩৪ লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিল। তবে সাধারণত মাঠ থেকে ভোক্তা পর্যন্ত যেতে এক-চতুর্থাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয় কিংবা শুকিয়ে কমে যায়। গত বছরের মার্চেও প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল ৩০-৩৫ টাকায়। পরে এপ্রিলের মাঝামাঝিতে দাম বাড়তে শুরু করে নিত্যপণ্যটির। জুনের শুরুতে গিয়ে দাম ঠেকে প্রতি কেজি প্রায় ১০০ টাকায়। ৫ জুন থেকে দেশে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। এরপর থেকে গত ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১৯ লাখ ৯৩ হাজার ২৯১ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। তবে এর বিপরীতে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ৭ লাখ ৫ হাজার ৪৩৭ টন।
গত বছর বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার পর মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারিভাবে কয়েক দফায় উদ্যোগ নেয়া হলেও খুব বেশি কার্যকর হয়নি। ১৪ সেপ্টেম্বর পেঁয়াজের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য বেঁধে দেয় সরকার। প্রতি কেজি দেশী পেঁয়াজ ৬৪-৬৫ টাকায় বিক্রির জন্য বলা হয়। যদিও এরপর থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি। বর্তমানে সরকার নির্ধারিত দামের দ্বিগুণে বিক্রি হচ্ছে পণ্যটি।
দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দরেও এখন দাম বাড়তে শুরু করেছে পেঁয়াজের। দুইদিনের ব্যবধানে এখানে খুচরা পর্যায়ে কৃষিপণ্যটি বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১১০ টাকায়। আর পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি ৮৫ থেকে ১০৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়েছে কেজিতে ৪০ টাকা। ব্যবসায়ীরা জানান, মোকামে পেঁয়াজের সরবরাহ হঠাৎ করে কমে গেছে।
হিলি বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী মনিরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পাইকারিতে প্রতি মণ পেঁয়াজের দাম ছিল ৩ হাজার ২০০ টাকা। কিন্তু হঠাৎ সেটা ৪ হাজার টাকা হয়ে যায়। সরবরাহ কম, এ কারণে দাম বেড়ে গেছে। ২০ টাকা করে সব পর্যায়ে দাম বেড়েছে।’
কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা বুঝে ফেলেছে সরকারি তদারকি খুব বেশি কাজে আসছে না। এ কারণে তারা তাদের ইচ্ছামতো এখন সব পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। সামনে রমজান। নতুন করে পেঁয়াজ উঠতে আরো মাসখানেক অপেক্ষা করতে হবে। এর মধ্যে এভাবে দাম বাড়তে থাকলে রমজানে ভোক্তারা কষ্টে পড়বেন। ভারত থেকে পেঁয়াজ আনার কথা চলছে। ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি হলে আবার দাম কমতে পারে।’