প্রতিনিধি =
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন কে পাচ্ছেন এ নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি উদ্বেগও রয়েছে। একই সাথে বর্তমান এমপি বিএনপি থেকে দুঃসময়ে জেলায় একমাত্র দলের এমপি নির্বাচিত হওয়ায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা তিনিই মনোনয়ন পাচ্ছেন এমন নিশ্চিত হলেও বসে নেই তার প্রতিন্দ্বন্দ্বীরা। মনোনয়ন পরিবর্তন করে নিজেদের দিকে নিয়ে আসতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চাঁদপুর জেলার ৫টি আসনের মধ্যে ফরিদগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত আসনটি ছাড়া বাকি আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিজয়ী হন। ১৯৭৩ সালের পর অদ্যাবধি এ আসনটিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়ী হতে পারেনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তীরে তরি ডুবেছে আওয়ামী লীগের। আওয়ামী লীগ প্রার্থী অল্প ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। আর এটিই ছিলো ৭৩ সালের পর থেকে ফরিদগঞ্জে আওয়ামী লীগ-বিএনপি জয়-পরাজয়ের মধ্যে সবচে’ কম ভোটের ব্যবধান। অবশ্য এ নিয়ে প্রধান দু’ মনোনয়ন প্রত্যাশী নির্বাচনের পর থেকে বিগত দু্’ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া সাংবাদিক শফিকুর রহমান এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়ার পৰের লোকজনের মধ্যে রয়েছে বিরোধ। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী পরাজয়ের জন্য এক পৰ অপর পৰকে দায়ী করেছে। এ নিয়ে উভয় পৰের মধ্যে দ্বন্দ্ব আরো তীব্রতর হয়েছে।
এদিকে বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোট এখনো নির্বাচনে আসবে কিনা তা নিশ্চিত না হলেও নির্বাচন এগিয়ে আসার সাথে সাথে বিএনপির মধ্যে থাকা অভ্যনত্দরীণ দ্বন্দ্ব দিন গড়ানোর সাথে সাথে প্রকাশ্য রূপ নিচ্ছে। ইতিমধ্যেই গত নির্বাচনে বিএনপির টিকেটে এ আসন থেকে বিজয়ী কেন্দ্রীয় কমিটির প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক ও উপজেলা বিএনপির সভাপতি সংসদ সদস্য লায়ন হারুনুর রশিদের বিরুদ্ধে বিএনপি থেকে নির্বাচিত উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হাজী মোজাম্মেল ও শিল্পপতি এমএ হান্নান (বিএনপি থেকে ইতিপূর্বে বহিষ্কৃত) থানায় জিডি করেছেন। আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও উপজেলা বিএনপির সম্পাদক মোতাহার হোসেন পাটওয়ারী এখন পর্যনত্দ প্রকাশ্যে কিছু না বললেও সংসদ সদস্য লায়ন হারুনুর রশিদের সাথে তার বিরোধ রয়েছে। ফলে সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জমে উঠেছে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের দৌড়-ঝাঁপ।
প্রায় ৫ লাখ লোকের আবাসস্থল এবং প্রবাসী অধু্যষিত ফরিদগঞ্জ উপজেলায় ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের এমপি হিসেবে সর্বশেষ নির্বাচিত হন এম সফিউলস্না। এরপরর্ দীঘদিন জিয়াউর রহমান ও এরশাদের শাসনামলে ফরিদগঞ্জে একচেটিয়া দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক ও জমিয়াতুল মোদার্রেছিনের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক ত্রাণ ও ধর্ম মন্ত্রী মাওঃ এমএ মান্নানের যুগ ছিলো। ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি জাকারিয়া চৌধুরী, বিএনপি থেকে মনোনয়ন পান তৎকালীন কেন্দ্রীয় যুবদল নেতা আলমগীর হায়দার খান। এ নির্বাচনে আলমগীর হায়দার খান নির্বাচিত হওয়াসহ পর পর চার বার নির্বাচিত হয়ে ফরিদগঞ্জ উপজেলাকে বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তুলেন বলে বিএনপির দাবি। ২০০২ সালে আলমগীর হায়দার খান গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে আসনটি দলের অন্য মনোনয়ন প্রার্থীদের কাছে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে নানা নাটক মঞ্চস্থ হয়। সর্বশেষ মাত্র ৩ দিন পূর্বে ধানের শীষের প্রতীক নিশ্চিত করে মাত্র সাড়ে ৭ হাজার ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়ে সকলকে চমকে দেন বর্তমান সংসদ সদস্য লায়ন মোঃ হারুনুর রশিদ। ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের জাকারিয়া চৌধুরী মনোনয়ন পাওয়ার পর ১৯৯৬ সালে মনোনয়ন পান সাবেক এমপি এম সফিউলস্না। ২০০১ সালে বিশিষ্ট সাংবাদিক মুহাম্মদ শফিকুর রহমান মনোনয়ন পেলেও তিনি আলমগীর হায়দারের কাছ থেকে আসনটি পুনরুদ্ধার করতে পারেন নি। এরপর ২০০৬ সালের ১১ জানুয়ারির নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়া মনোনয়ন পেলেও ওয়ান ইলেভেনের কারণে সেই নির্বাচন বাতিল হয়ে যায়। পরবর্তীতে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়ার পরিবর্তে আবারো মনোনয়ন পান সাংবাদিক মুহম্মদ শফিকুর রহমান।
২০১৪ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে আবারো মনোনয়ন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। পরপর দুই বারের মনোনীত প্রার্থী সাংবাদিক মুহম্মদ শফিকুর রহমানের সমর্থকরা জানান, তিনি গত দু’ বার মনোনয়ন না চাইলেও নেত্রী দেয়ায় তিনি নির্বাচন করেছেন। এবার তিনি নিজেই মনোনয়ন চাইবেন। অন্যদিকে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়া ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন না পাওয়ায় ফরিদগঞ্জ উপজেলার রাজনীতি নিয়ে প্রথমাবস্থায় তেমন মাথা না ঘামালেও তার বাড়ি ফরিদগঞ্জে হওয়ায় পরবর্তীতে তিনি ফরিদগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগসহ অঙ্গ-সংগঠনগুলোকে ঢেলে সাজাতে শুরু করেন। ইতিমধ্যে তিনি আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ের সম্মেলন শেষে নতুন কমিটি গঠন করে নেতা-কর্মীদের মনোবল সুদৃঢ় করেছেন বলে তার সমর্থকরা জানান। গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে প্রতিটি ইউনিয়নে বর্ধিত সভা করাসহ নানাভাবে মাঠ গোছানোর কাজ শুরু করেন। ক’দিন পূর্বে যুবলীগের মান-অভিমানের পালা সমাধান করেছেন। ফলে তার সমর্থকরা ধরেই নিয়েছেন আগামী সংসদ নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন পাচ্ছেন। তাছাড়া আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে তিনি সঠিক ও যোগ্য লোক মনোনয়ন দিলে আগামী সংসদ নির্বাচনে এ আসনটি উপহার দেয়ার চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করায় অনেকটাই উজ্জীবিত তার সমর্থকরা। এদিকে এই দু’জনের বাইরে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে অ্যাডঃ নূর হোসেন বলাই ব্যানার ফেস্টুন দিয়ে ফরিদগঞ্জ উপজেলার আনাচে-কানাচে তার অবস্থান জানান দেয়ার পাশাপাশি মাঝে মাঝে এলাকায় ঘুরে মনোনয়ন যুদ্ধে শরিক হয়েছেন। তার বিশ্বাস এবার নতুন প্রার্থী আসবে এ আসনে। এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ও বিএমএ’র সভাপতি ডাঃ হারুনুর রশিদ সাগর উপজেলার প্রতিটি এলাকায় জনগণের মাঝে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের মাধ্যমে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের কাতারে নাম লিখিয়েছেন। তিনিও নানাভাবে গণসংযোগ ও সভা-সমাবেশ করে মনোনয়ন যুদ্ধে আছেন। ফরিদগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগকে চাঙ্গা করতে কাজ করা চাঁদপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপু মনির ফুফাতো ভাই সাবেক এমপি মরহুম অ্যাডঃ সিরাজুল ইসলাম পাটওয়ারীর ছেলে জাহিদুল ইসলাম রোমানের নাম আলোচনায় রয়েছে। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর সাথে তৃণমূলের বৈঠকে দেয়া জরিপে আরো ক’জনের নাম রয়েছে বলে জানা গেছে। সর্বশেষ গত ১০ নভেম্বর থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র বিতরণ শুরু হওয়ায় মাঠে নূ্যনতম অবস্থান রয়েছে এর বাইরেও আরো ক’জন মনোনয়নপত্র ক্রয় করেছেন। তবে অনেকেই আবার মূল প্রার্থীর (তাদের কাঙ্ক্ষিত) ড্যামি হিসেবেও দলের মনোনয়নপত্র ক্রয় করেন। যাকে পরবর্তীতে নিজে সর্মথন দিয়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে পারেন।
অন্যদিকে বিএনপি নির্বাচন করলে এ আসনে বিএনপি থেকে নির্বাচিত বর্তমান সংসদ সদস্য কেন্দ্রীয় কমিটির প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক ও উপজেলা বিএনপির সভাপতি লায়ন হারুনুর রশিদের মনোনয়ন পাওয়া নিশ্চিত বলে তার সমর্থকরা জানান। বিগত সংসদ নির্বাচনে তিনি বিজয়ী হওয়ার পর থেকে উপজেলার প্রতিটি প্রানত্দরে দিনের পর দিন ঘুরে ঘুরে বিএনপির নেতা-কর্মী ও সাধারণ জনগণের মধ্যে নিজের অবস্থান চিহ্নিত করতে পেরেছেন। উপজেলা বিএনপির কমিটি গঠনের পর নিজে সভাপতি হিসেবে থেকে দলকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করছেন। নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠনের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই তিনি যুবদলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার সৃষ্টি করেছেন। প্রতিটি মিছিল-সমাবেশেই তাদের উপস্থিতি লৰ্যণীয়। গত ২৫ অক্টোবরের ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত তিন নেতাই যুবদলের সক্রিয় কর্মী। তবে ছাত্রদলকে এখনো পুরোপুরি সাজাতে পারেননি সংসদ সদস্য। গত ৫ বছরে দলের নতুন মুখ হয়েও দলের কাণ্ডারী হিসেবে নিজেকে পরিণত করার ফলে আগামী সংসদ নির্বাচনে তার মনোনয়ন না পাওয়ার ৰেত্রে কোনো কারণ থাকতে পারে বলে বিশ্বাস করেন না উপজেলা বিএনপির নেতা-কর্মীরা। অপর দিকে এ নির্বাচনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য মাঠে থাকার পাশাপাশি জোর তদবির করে যাচ্ছেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও উপজেলা বিএনপির সম্পাদক মোতাহার হোসেন পাটওয়ারী, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী মোজাম্মেল, বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত বিশিষ্ট শিল্পপতি এমএ হান্নান, জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশনের সভাপতি হুমায়ুন কবির বেপারী। তবে লায়ন হারুনুর রশিদ মনোনয়ন পেলে স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন বলে ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন এমএ হান্নান। বিএনপি নির্বাচনে এখনো যাবে কি না সেটি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে মনোনয়ন নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধ ক্রমশ প্রকাশ্য রূপ নিচ্ছে। শারদীয় দুর্গোৎসব ও পরবর্তীতে ঈদুল আযহায় এমপির সাথে এমএ হান্নানের ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হাজী মোজাম্মেলের বিরোধ তুঙ্গে উঠে। এর বাইরে উপজেলা বিএনপির সম্পাদক মোতাহার হোসেন পাটওয়ারীর সাথে পৌরসভার নির্বাচনকে নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ দিন দিন ভারী হচ্ছে। এছাড়া পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ঝুলিয়ে পুরো উপজেলায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন হুমায়ুন কবির বেপারী। আরো বেশ ক’জন প্রার্থী রয়েছেন যারা মাঠে অবস্থান না করলেও দলের মনোনয়ন চাইতে পারেন। জাতীয় পার্টি থেকে এ পর্যনত্দ কোনো প্রার্থীর নাম শোনা না গেলেও এককভাবে নির্বাচন করলে কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মোতাহার পাটওয়ারী, সিপিবি ও বাসদ থেকে বাসদের উপজেলা সমন্বয়ক হারুন-অর রশিদের নাম আলোচনায় রয়েছে।