ফরিদগঞ্জ (চাঁদপুর) প্রতিনিধি ঃ
ফরিদগঞ্জে সরকারী বিধি লংঘন করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, লোকালয়, এলজিইডি ও ইউনিয়ন পরিষদের রাস্তার পার্শ্বে গড়ে ওঠা ইটভাটার ভয়াবহ ক্ষতিকর প্রভাবে ধ্বংস হচ্ছে আবাদী জমি, ফসল, সম্পদ, ফল-ফলাদি ও গাছপালা। মারাত্মক হুমকিতে রয়েছে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ। উপজেলার বিভিন্ন ইটভাটায় কয়লার স্থলে জাহাজের পোড়া মবিল ও কাঠ পোড়ানো হয় দেদারছে। ধংশাত্মক এ কর্মকান্ড প্রতি বছরই চলে আসছে। শুরুতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় ইটভাটার মালিকরা এখন পরিবেশ অধিদপ্তরকে তোয়াক্বা করছে না। ফলে, নবায়ন বিহীন ৩০টি ইটভাটার বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী প্রশাসন এখন অসহায় দর্শক। বর্ষা শেষে আর কিছু দিনের মধ্যেই শুরু হতে যাচ্ছে ইটভাটায় ইট পোড়ানোর প্রস্তুতি। এমনিতর অবস্থায় ভয়াবহ ক্ষতির শিকার এলাকাবাসী রামপুর বাজারে ভূইয়া ব্রিক্স এর ‘আর.বি.বি’ নামক ইটভাটা বন্ধের দাবীতে লিখিত আবেদন করেছেন ফরিদগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর।
সরেজমিন বিভিন্ন ইটভাটায় ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার ত্রিশটি ইটভাটার প্রত্যেকটিই ফসলের মাঠে, লোকালয়ে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এলজিইডি ও ইউনিয়ন পরিষদের রাস্তার পার্শ্বে স্থাপিত। এসব ইটভাটায় কয়লা পোড়ানোর নির্দেশনা থাকলেও অনেকেই তা মানছেন না। অধিকাংশ ইটভাটায় জাহাজের পোড়া মবিল, টায়ারসহ কাঠ পোড়ানো হয়। সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীর অভিযোগ, পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই অবৈজ্ঞানিক ও অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটাগুলো চলছে। গোড়াতেই গলদের ফলে বিধিবহির্ভূত এ ইটভাটাগুলো গড়ে উঠতে পেরেছে বলে এলাকাবসীর অভিমত।
১৪৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ উপজেলায় প্রায় ৫ লক্ষাধীক জনগোষ্ঠী। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে তিন হাজার মানুষ। ফলে, পরিবেশ নীতিমালা অনুযায়ী এ উপজেলায় ইটভাটা স্থাপন করা বাস্তবে অসম্ভব। এমনই মত প্রকাশ করেছেন, এলাকাবাসী ও বিজ্ঞজনরা।
এদিকে, এমনি অবস্থায় ফরিদগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবরে দেয়া অভিযোগে জানা গেছে, উপজেলার রামপুর বাজারের পার্শ্বে লাড়–য়া গ্রামে ঘনজনবসিতপূর্ণ লোকালয়ে স্থাপিত ভুইয়া ব্রিকস এর ‘আর.বি.বি’ নামক ইটভাটা। এর চতুপার্শ্বে কয়েক গজের মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয়, ফাজিল মাদ্রাসা, এতিমখানা, হাফিজিয়া মাদ্রাসা, ব্যাংক, মসজিদ, রামপুর বাজার ইত্যাদি অবস্থিত। এসব প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে প্রতিদিন কয়েক হাজার শিশুসহ শিক্ষার্থী, শিক্ষক, নারী-পুরুষ, ক্রেতা বিক্রেতা, চাকরীজীবি ও মুসল্লীর সমাগম ঘটে। ইটভাটা লাগোয়া এলাকার বাড়ীঘরে হাজারও মানুষের স্থায়ী বসবাস। রয়েছে হাজারও গাছপালা ও বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। ব্রিক ফিল্ডের পাশ ঘেঁষেই এলজিইডি’র গ্রোথ সেন্টারের রাস্তা। বিধি মোতাবেক এমনি এলাকায় ব্রিক ফিল্ড স্থাপন বেআইনি।
রামপুর বাজার এলাকায় সরজমিন উপস্থিত হয়ে দেখা গেছে, ভূইয়া ব্রিকস এর আর.বি.বি নামক এ ইটভাটার ক্ষতিকর প্রভাবে ও বায়ুদূষণের কারণে গাছের ডালপালা, লতাপাতা, ফসলাদি ও শাক-সবজী জ্বলে-পুড়ে বিপুল ক্ষতিসাধন হচ্ছে। ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় বাড়ছে শ্বাসকষ্টের রোগীর সংখ্যা। শিশু ও বৃদ্ধরা রয়েছে সবচেয়ে বেশী হুমকীতে। ব্যাহত হচ্ছে ফলদ ও সবজি ফসল উৎপাদন।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, ইটভাটার মালিকপক্ষগণ প্রভাবশালী। ভূক্তভোগী জনসাধারণ তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অভিযোগ করার সাহস পাচ্ছে না। অন্যদিকে, আইন প্রয়োগকারী প্রশাসন দেখেও পর্দার অন্তরালেই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে আসছে বছরের পর বছর।
ইটভাটার ভয়াবহ হুমকীর শিকার এলাকাবাসীর পক্ষে ছালামত উল্লা, মোঃ মিনহাজ, মোঃ লিটন, আব্দুল করিম, আব্দুর রহিম স্বাক্ষরিত এক আবেদনে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রয়োজনীয় তদন্ত সাপেক্ষে ভূইয়া ব্রিকস এর ‘আর.বি.বি’ নামক ইটভাটাটি স্থায়ীভাবে বন্ধের আবেদন জানিয়েছেন। তারা এ ব্যপারে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র, বাণিজ্য বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ কামনা করেছেন।
ইট পোড়ানো (নিয়ন্ত্রণ) সংশোধন আইন-২০০১-এর ৩ (চ) ৫ ধারা অনুযায়ী, আবাদি জমি ও ফলের বাগান থেকে তিন কিলোমিটার এলাকার ভিতরে কোনো ইটভাটা স্থাপন করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এই আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়েই ভুইয়া ব্রিকস এর ‘আর.বি.বি’ নামক ইটভাটাসহ ফরিদগঞ্জে ব্যাঙ্গের ছাতার ন্যায় গড়ে উঠেছে ৩০টি ইটভাটা।
এ ব্যপারে চাঁদপুর সরকারী কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের প্রধান ওয়াহিদুজ্জামান বলেছেন, মানুষ শ্বাসকষ্টে ভোগাসহ ইটভাটা থেকে নির্গত ছাই আশপাশের গাছপালা ও ফসলের মারাত্মক ক্ষতি করে। ছাই ও বস্তুকণা গাছের পাতার পত্ররন্ধন বন্ধ করে দেয়, উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ ও শোষণ প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। ধানসহ নানাবিধ ফসলের ফুলের রেণুকে বিনষ্ট করে এবং ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে যায়। বাতাসে মিশে থাকা কার্বন পার্টিকেল, সালফার, নাইট্রোজেনসহ অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান মানবদেহ ও পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি করে।
এদিকে, সাংবাদিকরা ভুইয়া ব্রিকস এর ইটভাটার বর্তমান মালিক মুরাদ ভূঁইয়া সঙ্গে যোগাযোগ করলে, তিনি রাজনৈতিক দলের এক নেতার নাম উচ্চারণ করে বলেন, তার সাথে কথা হয়েছে।
অন্যদিকে ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি সফিকুর রহমান এর মুঠো ফোনে কল দিলে তিনি কল রিসিভ করেননি।
“সমস্যা রয়েছে বিধায় উপজেলার ত্রিশটি ইটভাটার একটিরও নবায়ন করা হয়নি” বলেছেন- পরিবেশ অধিদপ্তর, চাঁদপুর জেলার সিনিয়র ক্যামিস্ট কাজী সুমন। এগুলো বন্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেনো, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, ইটভাটার মালিক প্রত্যেকে মহামান্য হাইকোর্টে রিট করেছেন। রিটের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত আমরা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছি না। ‘রিটের আদেশে কি আছে’ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমার জানা নেই।
সাহিত্য কর্মী আবুল হাসান মন্তব্য করেন, মহামান্য হাইকোর্টে দায়েরকৃত রিট নিষ্পত্তিতে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলগণের গাফিলতি থাকা অসম্ভব কিছু না। তবে, এ থেকে পরিত্রাণ পেতে ঐসব রিট দ্রুত নিষ্পত্তিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্তাব্যক্তিদের কার্যকরী উদ্যোগ কামনা করেছেন ভূক্তভোগী এলাকাবাসী।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ডক্টর মোঃ সহিদ হোসেন চৌধুরী বলেছেন, রামপুর বাজার সংলগ্ন আরবিবি নামক ইটভাটা বন্ধের একটি আবেদন পেয়েছি। এসি (ল্যান্ড)কে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির রিপোর্ট দেখে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।