প্রতিনিধি
ভাই এবং ভাবীদের জড়িয়ে ধরে কোন অসহায় প্রতিবন্ধী বোন বা ননদের বুকফাটা কান্নার দৃশ্য দেখলে মানুষ মাত্রই বিচলিত হয়ে উঠবে। তার মধ্যে বোন যদি হয় প্রতিবন্ধী এবং ৬ বোন তিন ভাইয়ের মধ্যে সকলের ছোট। ফরিদগঞ্জের পূর্ব লাউতলী গ্রামের মিজি বাড়ির মরহুম আব্দুল মতিন মিজির সর্বকনিষ্ঠ সন্তান প্রতিবন্ধী লিপি (২৩)-কে একটু ভালো এবং শান্তিতে থাকার আশায়, দেখে শুনে একই গ্রামের সিরাজী মিজি বাড়ির অসহায় পরিবারের মৃত খোরশেদ আলমের বড় ছেলে ওয়ালিফের কাছে বিয়ে দেয়া হয় পাঁচ বছর আগে। ভেবেছিলেন ধনী পরিবারে প্রতিবন্ধী বোনকে বিয়ে দিলে হয়তো সেখানে তাকে অবহেলা, অবজ্ঞা আর বিভিন্ন ধরনের বঞ্চনা সহ্য করতে হবে। তাই আদরের ছোট বোনকে সহায় সম্বলহীন ওয়ালিফের নিকট বিয়ে দিয়েছিলেন দুই পরিবারের সম্মতি ও এলাকাবাসীর উপস্থিতিতে। বেকার ওয়লিফকে ব্যবসা করার জন্য নগদ দেড় লাখ টাকা ও একটি দুধের গাভী দেয়া হয়েছিল বিয়ের সময়। কিছুদিন পরই গাভীটি বিক্রয় করে দেয় এবং নগদ টাকাও খরচ করে ভবঘুরের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকে ওয়ালিফ। ইতিমধ্যে এক বছরের মাথায় লিপির কোলে একটি মেয়ে সন্তান এলেও অসুস্থতার কারণে সন্তানটি মারা যায়। লিপির উপর নির্যাতনের মাত্রা আস্তে আস্তে ক্রমশঃ বাড়তে শুরু করলে বোনের সুখের কথা চিন্তা করে আবারও বেকার ভগ্নিপতি ওয়ালিফকে সাড়ে তিন লাখ টাকা দিয়ে বিদেশ (সৌদি আরব) পাঠিয়ে দেন লিপিরি তিনভাই। ভোবছিলেন হয়তো বেকারত্ব দূর হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। লিপির প্রতি স্বামীর ভালোবাসা এবং দায়িত্ব কর্তব্যের অবহেরা হবেনা। কিন্তু ওয়ালিফকে বিদেশ পাঠানো হিতে বিপরীত হলো। তিন বছরে কখনো ফোন করেও স্ত্রীর খোঁজ-খবর করেনি ওয়ালিফ। ওয়ালিফের মা এবং ছোট দু’ভাই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে থাকলে লিপিকে ভাবীরা নিজেদের সংসারে নিয়ে রাখতেন বেশিরভাগ সময়। মাঝে মধ্যে ওয়লিফদের বাড়িতে পাঠাতেন। তিন বছর পর গত কোরবানীর ঈদের পরের দিন ছুটিতে ওয়ালিফ প্রবাস থেকে বাড়ি পৌঁছান। পরের দিন ওয়ালিফের মা রেজিয়া(৫০) লিপিকে বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আসেন। বাড়িতে এসেই লিপিকে বিভিন্ন অজুহাতে প্রতিদিনই কম বেশি শারীরিক নির্যাতন করতে থাকে তার বখাটে স্বামী। লিপির পরিবারের অভিযোগ ওয়লিফ বাড়ি এলে লিপি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। গত এক সপ্তাহ পূর্বে তার দু’মাসের গর্ভের সন্তান নষ্ট করার জন্য জোরপূর্বক (গ গ শরঃ) গর্ভ বিনষ্টকারী পিল খাইয়ে দেয়। এত তার গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। পিল খাওয়ানোর এক পর্যায় লিপিকে বেদম মারধর করা হয় যা বাড়ির অনেকেই প্রত্যক্ষ করেছে।
গতপরশু সরেজমিনে লাউতলী গ্রামে লিপির স্বামীর বাড়ি গিয়ে দেখা গেল লিপির মুখোম-লে ছ্যাকা দেয়ার মতো অনেকগুলো ক্ষত চিহ্ন। ভাই এবং ভাবীদের জড়িয়ে ধরে লিপি তোতলিয়ে তোতলিয়ে নির্যাতনের বিষয়গুলো জানাতে চেষ্টা করছে। এ প্রতিনিধি লিপিকে তার মুখোম-লের চিহ্ন ও আরো কিছু বিষয়ে জানতে চেষ্টা করে প্রথমেই বুঝা গেল সে কানে শুনেনা এবং ঠিকমত কথাও বলতে পারেনা। তারপরও সে বুঝাতে চেষ্টা করলো তাকে প্রতিনিয়ত শারীরিক নির্যাতন করা হয়। তাকে ঠিকমত কাপর চোপড় ও কিছুই দেয়া হয়না।
ওয়ালিফকে খুঁজে না পাওয়ার কারণে মোবাইল ফোনে তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে সে ফোন কেটে তাৎক্ষণিক সুইচ অফ করে দেয়। ওয়ালিফের মা রেজিয়া বেগমের সাথে কথা হলে তিনি ঘুরিয়ে পেচিয়ে বলেন। আমরা গরীব ও ছিলাম বলে লিপির পরিবার আমার ছেলেকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা করেছে সত্য, তবে টাকার পরিমান সম্পর্কে আমি জানিনা। আমি লিপিকে আমার মেয়ের মতই জানি তবে, বার বার ডাকাডাকির পরও সে যখন সাড়া দেয় না তখন জিদ করে তাকে গালমন্দ করি। বউয়ের উপর ছেলের নির্যাতন ঔষধ খাওয়ানোর ব্যাপারে তিনি জানান, প্রতিনিয়ত নয় মাঝে মধ্যে তাকে শাসন করা হয় আর লিপিকে যে ঔষধ খাওয়ানো হয়েছিল তা তার মুখের ঘা এর জন্য। লিপি খাইতে চায় নাই বলে তাকে কয়েকটি থাপ্পড় দেয়া হয়েছিল মাত্র। তার মুখের উপরের ক্ষতগুলো কিভাবে হলো আমার জানা নেই। বললেন ছেলে তার আত্মিয়ের বাড়ি পার্শ্ববর্তী রামগঞ্জ উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামে বেড়াতে গিয়েছে। ওয়ালিফের ছোট ভাই দিনমজুর রাজু জানায়, বিয়ের পর হতেই ভাই ও ভাবীর মধ্যে ঝগড়া। বিষয়টি নিয়ে মায়ের সাথে ঝগড়া করে আমি আমার স্ত্রীকে তার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। এ ব্যাপারে আমি আর কথা বলতে চাইনা। সে আরো বলে, প্রতি মাসেই একবার করে শাসনের ছলে আমার স্ত্রীকে মারধর করি। আমার মনে হয় শান্তির জন্য আমার ভাই তার স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা সংসার করা উচিৎ।
৬নং গুপ্টি ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার মাসুদ জানায় ওয়ালিফ একটা লোভী ও বখাটে প্রকৃতির ছেলে। আমি এলাকার গণ্যমান্যরাসহ বহুবার তাকে শালীসের মাধ্যমে শাসিয়েছি। গত সপ্তাহে লিপির উপর যে নির্যাতন করেছে তার চিহ্নও আমি দেখেছি। তার শাস্তি হওয়া উচিৎ। প্রয়োজনে উভয় পরিবার একত্রিত হয়ে একটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যও পরামর্শ দিয়েছি। লিপির পরিবার মানলেও ওয়ালিফ আরো কিছু নেশাখোর ও বখাটেদের পাল্লায় পড়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। মাসুদের সাথে উপস্থিত আরো অন্ততপক্ষে দশজন এলাকাবাসী জানায়, সে বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর রঙ্গিন স্বপ্ন দেখছে। এখন আর প্রতিবন্ধি স্ত্রী ভালো লাগছেনা। লিপির পরিবারের টাকা দিয়ে বিদেশ গিয়ে উপার্জিত টাকা এখন কিছু বখাটে যুবকের নেশার খোরাক মেটাচ্ছে।
ভুক্তভোগী লিপির পরিবার প্রশাসন ও সমাজের নিকটের সুরাহা দাবি করছে। সুন্দরী প্রতিবন্ধি লিপির ভাগ্যে কি শান্তি আর সুখ আসবেনা? কেউ কি নেই এর প্রতিবাদ করার জন্য? লিপির অসহায় চাহনী আর বাকরুদ্ধতা এর উত্তর খুঁজে ফিরে।
শিরোনাম:
মঙ্গলবার , ১৪ জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ১ মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।