রাজীব আহমেদ
– বাবুল ভাই, ও বাবুল ভাই।
ভেতর থেকে কোনো সাড়া নেই।
আবারও হাঁক দিলাম- বাবুল ভাই, ভাত খাইছেন?
এবার ভেতর থেকে জবাব মিলল, তবে এমন মিনমিনে গলায়, যার কিছুই বোঝা গেল না। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, পুলিশ আগেই ধমকে দিয়েছে। ফলে গ্যাস লিক করা বেলুনের মতো একেবারে চুপসে আছেন বাবুল ভাই।
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসভবনের দুই পাশের রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরিতে যে ট্রাকগুলো রাখা হয়েছিল তারই একটির চালক আমাদের এই বাবুল ভাই। বালু নিয়ে নিশ্চিন্তে যাচ্ছিলেন গন্তব্যে। কিন্তু বিধির বিধান- তার বদলে ঠাঁই হয়েছে এখন গুলশানে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনের রাস্তায়।
গতকাল দুপুর ২টার দিকে তিনি ট্রাকের দরজা, জানালা আটকে ভেতরে শুয়ে ছিলেন। মাঝেমধ্যে বের হয়ে চা পান করতে যান শুধু। তিন বেলা খাবার জোগান আসে পুলিশের কাছ থেকে। সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁর কথা বলা বারণ।
২৯ ডিসেম্বর থেকে থাকা পাঁচটি বালুভর্তি ট্রাকের দুটিকে মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এর বদলে নতুন আরেকটিকে ধরে আনা হয়েছে। সব মিলিয়ে গতকাল মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত খালেদা জিয়ার বাসভবনের রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে ছিল চারটি ট্রাক। এর তিনটি বালুভর্তি। অন্যটি খালি।
খালেদা জিয়ার বাসভবনের আশপাশে নিয়মিত হাজির থাকছেন সাংবাদিকরা। সঙ্গে পালা করে থাকছে পুলিশ। মাঝেমধ্যে উৎসুক লোকজনের উঁকিঝুঁকি। আর থাকছেন ওই চার ট্রাকচালক। ট্রাকগুলো বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে এনেছে পুলিশ।
গুলশান-২ নম্বর চত্বর থেকে পাকিস্তান হাইকমিশনের দিকে এগোলেই ডান পাশে খালেদা জিয়ার বাসভবন। মূল রাস্তার পাশে সাংবাদিকদের দিনভর জটলা। অন্য পাশেও এত দিন সাংবাদিকদের যাওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু রবিবার দেয়াল টপকে খালেদা জিয়ার বাসভবনে ঢুকে যাওয়ায় সেখানে যাওয়ার অধিকার হারিয়েছেন তাঁরা।
অন্য পাশের ট্রাকচালকদের দিনে দু-একবার ব্যস্ত হয়ে উঠতে হয়। সোমবার ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন দেখা করতে গেলে ট্রাক সরিয়ে তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয়। গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাব্লিউ মজিনা এলেও একই ব্যবস্থা করা হয়।
কিন্তু এ পাশের ট্রাকচালক বাবুল ও খলিলুর রহমানের কোনো ব্যস্ততা নেই। খলিলুর নতুন। গতকাল দুপুরে ট্রাকের জানালা দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন তিনি খালেদা জিয়ার বাসভবনের দিকে। বিরোধীদলীয় নেতাকে এখন পর্যন্ত সামনাসামনি দেখেননি তিনি। সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে একঝলক দেখার চেষ্টায় আছেন কি না, জানতে চাইলে খলিলুর রহমানের বিষণ্ন হাসি। এই বিষণ্নতার কারণও জানা যায় একটু পরেই। আটকে থাকা নিয়ে তাঁর কোনো অভিযোগ নেই, তাঁর কষ্টের কারণ স্ত্রী-সন্তানের দেখা না পাওয়া।
চার সন্তানের জনক খলিল ২৪ বছর ধরে ট্রাক চালাচ্ছেন। বাংলাদেশের প্রায় সব জেলা তাঁর একাধিকবার ঘোরা। যখন মহাসড়কে ট্রাক চালানোর কথা, তখন এক জায়গায় ঠায় বসে থাকতে আর ভালো লাগে না। তবু থাকতে হচ্ছে। তবে পুলিশ সদস্যরা তাঁকে খাবার দিয়েছেন। সোমবার রাতে প্রথম আসার পরে দিয়েছে খিচুড়ি। সকালে পরোটা।
২টা পর্যন্ত দুপুরের কিছু খাওয়া হয়নি। আশা করছিলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে খাবার আসবে। না এলেও সন্ধ্যার আগে বের হওয়ার উপায় নেই। খেতে যেতে হবে গুলশান-২ নম্বর চত্বরে। কারণ আশপাশে কোনো সস্তার হোটেলও নেই। সন্ধ্যার সময় সহকারী (হেলপার) এলে তিনি খেতে যাবেন। মালিকের ট্রাক ফেলে এখনই যেতে পারেন না। সেই দায়িত্ববোধও তাঁর প্রবল।
খলিলুর রহমানের চার সন্তানের মধ্যে দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট ছেলে স্কুলে পড়ে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন শরীয়তপুরের গ্রামের বাড়িতে। বড় ছেলে দুবাই থাকে। নিজের বেতন ১৬ হাজার টাকা। বাড়তি কিছু আয়ও হয়। সংসারে অভাব নেই।
খলিল জানান, তাঁর ট্রাকটি স্টিল মিলের। পুলিশ নিয়ে আসার পর মালিকের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। মালিক বলেছেন, গুলশানে থাকতে। এর বেশি কিছু বলতে তিনি রাজি হননি।
কয়েকজন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে ট্রাক প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তাঁরা মুখ খোলেননি। আর ট্রাকচালকরাও জানেন না তাঁরা কবে ছাড়া পাবেন।
ট্রাকগুলো থাকায় সুবিধা হয়েছে টেলিভিশন সাংবাদিকদের। কেউ কেউ ট্রাকের ওপর উঠে পিটিসি (পিস টু ক্যামেরা) দিচ্ছেন। মজিনা কখন আসবেন, তা নিশ্চিত হতে কেউ কেউ আবার ট্রাকের ওপর নির্ভর করছেন। কারণ রাষ্ট্রদূত আসার কিছুক্ষণ আগে ট্রাকের ইঞ্জিন চালু হয়ে যায়। সাংবাদিকরাও আগাম ইঙ্গিত পেয়ে যান।
কিন্তু শহরে-বন্দরে ঘুরে ঘুরে যার দিন কাটে তার কি মন ভালো লাগে গুলশানের আরোপিত আভিজাত্যে পড়ে থাকতে। জানতে চেয়েছিলাম, ট্রাকটি কি মালিক স্বেচ্ছায় দিয়েছে? সতর্ক খলিলুরের জবাব, ‘কেউ কি তা দেয়?’
শিরোনাম:
মঙ্গলবার , ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ , ২ আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।