মরিয়ম চম্পা
সুপার এডিটিংয়ের মাধ্যমে ‘আপত্তিকর ভিডিও’ তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ায় সম্প্রতি রাজধানীর সবুজবাগে ষষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। গত রোববার রাতে বাসার সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় তার মরদেহ পাওয়া যায়। এ বিষয়ে নিহত শিক্ষার্থীর বাবা সবুজবাগ থানায় শামিম ও ফাহিম নামে দুই যুবকের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করেছেন। শিক্ষার্থীর চাচা জানায়, শামিম দীর্ঘদিন ধরে মেয়েটিকে অনৈতিক প্রস্তাব দিয়ে আসছিল। প্রস্তাবে ব্যর্থ হয়ে ফাহিমকে সঙ্গে নিয়ে শিশু শিক্ষার্থীর ছবি ও ভিডিও এডিট করে ব্ল্যাকমেইল শুরু করে। পরবর্তীতে ফেসবুকে সেই ভিডিও ছড়িয়ে দিয়ে তারা মেয়েটির কাছে টাকা দাবি করে। না দিতে পারলে ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। এই ঘটনা জানার পর পরিবার থেকে মেয়েটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে ওই দিন রাত ৮টার দিকে মেয়েটি আত্মহত্যা করে।
এদিকে বরিশালের বরগুনায় গত মাসের শুরুর দিকে যৌন হয়রানি সইতে না পেরে মায়ের কাছে চিঠি লিখে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী।
বরগুনা শহরের কলেজ রোডের বাসার বাথরুম থেকে তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। কিশোরীর আত্মহত্যার জন্য দায়ী জামাল হোসেনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। জানা যায়, কিশোরীকে নিয়ে তার মা দ্বিতীয় স্বামী রাশেদের সঙ্গে কলেজ রোডে আবুল বাশারের বাসায় ভাড়া থাকেন। আবুল বাশারের ছেলে জামাল হোসেনের স্ত্রী সন্তান থাকা সত্ত্বেও কিশোরীকে প্রায়ই উত্ত্যক্ত করতো। একাধিকবার শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছে। এরপর ওই কিশোরী ও জামালকে জড়িয়ে প্রতিবেশীরা অনৈতিক সম্পর্কের কথা বলে বেড়ায়। এ ঘটনায় মা ছাড়া সবাই তাকে গালমন্দ করলে অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা করে।
অলনাইনে যৌন হয়রানি নিয়ে সম্প্রতি এক গবেষণা জরিপ প্রকাশ করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। এতে বলা হয়, করোনাকালে দেশে ৩০ শতাংশ শিশু অনলাইনে নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। নিপীড়নের শিকার হওয়া শিশুদের ৫২ দশমিক ২৫ শতাংশ মেয়ে শিশু। ৪৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ ছেলে শিশু। করোনাকালে অনলাইনে শিশু নির্যাতন বিষয়ক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে অনলাইনে শিশু নিপীড়নের ধরন সম্পর্কে বলা হয়, শিশুদের ব্যক্তিগত ও সংবেদনশীল তথ্য ইন্টারনেটে প্রকাশ, যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন, অশালীন প্রস্তাব, সাইবার বুলিং, ব্ল্যাকমেইলিং, পর্নোগ্রাফি এবং কোনো না কোনোভাবে যৌনতা বিষয়ক ছবি ও তথ্য দেখতে পাওয়া। করোনাকালে শিশুদের প্রতি সহিংসতা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়াতে শঙ্কা প্রকাশ করেছে সমাজ এবং অপরাধ বিজ্ঞানীরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, সামাজিক অবক্ষয়, স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কোথাও নৈতিকতার শিক্ষা না দেয়া, এমনকি পারিবারিক শিক্ষার অভাব থেকে এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। এখনই শিশুদের সঙ্গে হওয়া সাইবার বুলিং না কমাতে পারলে ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে বলে আশঙ্কা তাদের। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, দেশের তিন-চতুর্থাংশ নারী এবং শিশু সাইবার বুলিংয়ের শিকার। প্রায় ১২ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে উল্লেখ সংখ্যক নারী-শিশু অনলাইন ব্যবহার করতে গিয়ে প্রায় হেনস্তার শিকার হচ্ছে। ইউনিসেফের ২০১৯ সালের এক জরিপ অনুযায়ী, দেশে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া ৩৮ শতাংশ ১০ থেকে ১৩ বছর বয়সের, ৩৬ শতাংশ ১৪ থেকে ১৫ বছর এবং ১৬ থেকে ১৭ বছর বয়সী ২৫ শতাংশ। ঢাকায় অনলাইনে হয়রানির শিকার নারীদের ৭০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, করোনার কারণে আমাদের শিক্ষার্থীদের অনলাইনে এখন বেশি সময় দিতে হচ্ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই অনলাইন সাইবার অপরাধ বেড়ে গেছে। যৌন হয়রানি থেকে শুরু করে সাইবার সংক্রান্ত যে ধরনের অপরাধ আছে সেগুলো বেড়ে গেছে। এখন আমাদের কোভিডের বাইরেও সাইবার অপরাধ যেভাবে বেড়েছে সে তুলনায় সরকার এবং অপরাধ তদন্ত বিভাগের নজরদারি ওভাবে বাড়েনি। পুলিশ কাজ করছে। কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এই ধরনের অপরাধ যে পর্যায়ে চলে গেছে নজরদারিটা সেই জায়গায় না নেয়া গেলে এর ভবিষ্যৎ ফলাফল খুব বেশি ইতিবাচক পাওয়া যাবে না। শিশুদের নিরাপদ রাখতে এবং এ ধরনের অপরাধ কমাতে পরিবারকে যেমন সচেতন হতে হবে, একইভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও আরও তৎপর হতে হবে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ শরীফুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, অনলাইনে সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমাদের সার্বক্ষণিক মনিটরিং ব্যবস্থা চালু রয়েছে। আমাদের শিশুরা অনলাইনে কি করছে, কাদের সঙ্গে মিশছে এ বিষয়ে বাবা-মাকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। অনলাইনে ক্লাসের নামে শিশুর হাতে স্মার্ট ফোন দিয়ে দিলাম আর দায়িত্ব শেষ হয়ে গেল এমনটা নয়। অনলাইনে ক্লাস বা অন্যান্য শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডের বাইরে সে আবেগের তাড়নায় ব্যক্তিগত কোনো তথ্য-ছবি বা অন্য কিছু আদান-প্রদান করছে কিনা তা নিয়মিত নজরদারি করতে হবে। অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পেলে শিশুকে বোঝানোর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি জানাতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা সন্তানকে বেশি বেশি সময় দিতে হবে।