মেরিনা শাহীন: দেশে বেড়েই বলছে নকল ও ভেজাল ওষুধের রমরমা ব্যবসা। সেই সাথে বিদেশ থেকে আমদানি হচ্ছে নকল ও ভেজাল ওষুধ। বাড়ছে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা। সরকারি নিষেধাজ্ঞা, অনুমোদন নেই- তবুও কেউ থামছে না। সারা দেশ সয়লাব এখন নিষিদ্ধ ও অনুমোদনহীন ওষুধে। অনেক ফার্মেসি প্রকাশ্যে বিক্রি করছে এসব ওষুধ। কিন্তু এসব যেন দেকার কেই নেই !
মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ ডাক্তারের ফি ও টেস্টের (রোগ নির্ণয়) খরচের আতঙ্কে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যান কম, বেশিরভাড় ক্ষেত্রেই তারা সরাসরি চলে যান ওষুধ বিক্রেতার কাছে। তার কাছে রোগের বিবরণ দিয়ে ওষুধ কিনে নিয়ে আসেন। শুধু তাই নয়, কেনার সময়েও খোঁজেন কম দামি ওষুধ। আর এরই সুযোগ নিচ্ছে ভেজাল ওষুধ প্রস্তুতকারীরা।
বাজারে ভেজাল ও অনুমোদনহীন ওষুধ বিক্রি ঠেকাতে ভূমিকা রাখতে পারছে না সরকারের কোন বিভাগই। এই সুযোগে পকেট ভারি ও সাধারণ রোগীকে প্রতারণার ষোলকলা পূর্ণ করে চলেছেন লাইসেন্সধারী ওষুধ ব্যবসায়ীরা। দেশের প্রায় প্রত্যেক ফার্মেসিতেই বিক্রি হচ্ছে বেজাল ও অনুমোদনহীন ওষুধ। দেশের প্রখ্যাত স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. এবিএম আবদুল্লাহ’র ভাষায়- ওষুধের ভেতরে আসলে কি আছে, ওষুধের নামে ভেতরে ময়দা নাকি চালের গুঁড়ো ঢুকানো- তা জানা যাচ্ছে না। ফলে কি ওষুধ খাচ্ছেন রোগীরা তা তারা জানেন না। মাঝে-মধ্যে এসবের বিরুদ্ধে অভিযানে নামলেও কখনই উদ্দেশ্য সফল করতে পারে না কর্তৃপক্ষ। দু-একটি দোকানে অভিযান শুরু করে সবকিছু গুটিয়ে আবার ফিরে আসেন। প্রভাবশালী মহল ও আন্দোলনের হুমকির কারণে তারা কখনই বাজার নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারেন না।
এ প্রসঙ্গে গণস্বাস্থ্য জনহিতকর দাতব্য ট্রাস্ট্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী বলেন, ভেজাল ওষুধ দুই ধরনের। একটি হচ্ছে, সাব-স্ট্যান্ডার্ড। প্রয়োজনীয় উপাদান পরিবর্তন করে এ ধরনের ওষুধ তৈরি করা হয়। দ্বিতীয় হচ্ছে, নকল বা কাউন্টারফিট ওষুধ।
সাব-স্ট্যান্ডার্ড ওষুধ ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি একভাবে তৈরি করে আর ভেজালকারীরা তা বাজারজাত করে অন্যভাবে। যেমন একটি ওষুধে এক চামচ চিনি দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হয় আধা চামচ ইত্যাদি।
নিম্নমান ও নকল ওষুধের ক্ষেত্রে ওষুধের জেনারেশন পরিবর্তন করা হয়। বলা হলো, এটি থার্ড জেনারেশনের ওষুধ। অথচ ভেতরে দেওয়া হয়েছে ফার্স্ট জেনারেশনের উপাদান।
নকল ওষুধের ক্ষেত্রে দুই ধরনের ব্যাপার ঘটে। ভেজাল ওষুধ তৈরি করে অন্য কোম্পানির নামে চালানো হয়। আবার একটি বড় কোম্পানির মোড়কে ওষুধ তৈরি করলে, তা ধরে কে? দেশে একটিমাত্র কারখানা রয়েছে যেখানে খালি ক্যাপসুল (এমটি হার্ড জিলোটিন ক্যাপসুল) তৈরি করা হয়। এক বাক্স খালি ক্যাপসুলের দাম ১২ হাজার ৬৭৫ টাকা। এটা বাজারে কিনতে পাওয়া যায়।
image_1386_341171.gif_1834_0
বিএনপি সরকারের গত মেয়াদে শেষের দিকে তৈরি ওষুধনীতিতে বলা হয়, ১১৭টি ওষুধের দাম বাড়বে। এছাড়া কোনো ওষুধের দাম বাড়বে না (ইনডিকেটিভ প্রাইস)। সরকার ওষুধের দামের স্বীকৃতি দিলেই কেবল তা বাজারে ছাড়া যাবে। অথচ কেউ-ই মানছে এ নীতি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ মুহূর্তে ওষুধের মূল্য নির্ধারণে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এতে একই ওষুধ ভিন্ন ভিন্ন উৎপাদনকারী নানা দামে বাজারজাত করছে। যেমন ওমিপ্রাজল (২০ এমজি) আলবিয়ন (আলবিয়ন ল্যাবরেটোরিজ লি.) বাজারজাত করছে লোটিল-২০ নামে, দাম মাত্র এক টাকা। একই ওষুধ প্রোবিটর-২০ নামে বাজারজাত করছে স্যানডোজ, দাম সাত টাকা। অন্যান্য উৎপাদনকারীদের কেউ তিন টাকা, কেউ চার টাকা, কেউ পাঁচ টাকায় বিক্রি করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার বাজারে প্রতি ১০টি ওষুধের প্রায় তিনটিই নকল।
অল্প খরচে বেশি লাভ হওয়ায় প্রতারকদের কাছে ভেজাল ওষুধ ব্যবসার আকর্ষণ বাড়ছে। ভেজালকারীরা শুধু ট্যাবলেট ও ক্যাপস্যুল ভেজাল করতে বেশি পছন্দ করে। কারণ এগুলো শুকনো ওষুধ ও ঝামেলা কম।
ভেজাল সম্পর্কে ফার্মাসিস্ট মো. খলিলুর রহমান বলেন, “যেসব ওষুধ তরল প্রিজারভেটিভ মিশিয়ে বোতলজাত করতে হয়, বেশি মুনাফা লাভের জন্য সেগুলোয় ক্ষতিকর ও কম দামি প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয়। যেমন, চোখের ড্রপ উৎপাদনে প্রিজারভেটিভ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্ষতিকর বেনজাইল ক্লোরিয়াম ক্লোরাইড। অথচ প্রিজারভেটিভ হিসাবে ব্যবহার করা প্রয়োজন সোডিয়াম পারবোরেট।
তিনি বলেন, “দেশে এখন থার্ড জেনারেশনের অ্যান্টিবায়োটিক বাজারজাত হচ্ছে। তবে থার্ড জেনারেশনের লেবেল লাগিয়ে ভেজালকারীরা যদি সেকেন্ড কিংবা ফার্স্ট জেনারেশনের ওষুধ বাজারজাত করে, তা দেখার কেউ নেই। ভোক্তাকে ওষুধ উৎপাদনকারীদের লেবেলে আস্থা ও বিশ্বাস করে ওষুধ খেতে হবে। যেমন সেকেন্ড জেনারেশনের সেফিক্সাইমের নামে কোনো উৎপাদনকারী যদি ফার্স্ট জেনারেশনের অ্যামোক্সিসিলিন বাজারজাত বা বোতলজাত করে, তা দেখার বা তদারকি করার কেউ নেই। ভেজালকারীদের পাশাপাশি অনেক সময় উৎপাদকারীরাও এই ধরনের কাজ করে থাকেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।
ওষুধের ওজন দেখারও কেউ নেই। বেশিরভাগ উৎপাদনকারীর ১৫০ এমজির রেনিটিডিনের ওজন ১১০ এমজি। অর্থাৎ দুই টাকা দাম নিয়ে তারা ভোক্তাকে দিচ্ছে দেড় টাকার রেনিটিডিন।
কী কী ওষুধ ভেজাল হচ্ছে এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, থার্ড জেনারেশনের অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে এজিথ্রোমাইসিন, সেফিক্সাইম, সেফট্রিয়াক্সন অন্যতম।
গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের মধ্যে ওমিপ্রাজল, ইসোমিপ্রাজল, প্যান্টাপ্রাজল অন্যতম। এসব ওষুধই চিকিৎসকরা বেশি লেখেন এবং রোগীরা বেশি পছন্দ করেন। জ্বর ও ব্যথা নিবারণের সবচেয়ে জনপ্রিয় ওষুধ প্যারাসিটামল। ট্যাবলেট আকারে পূর্ণবয়স্ক মানুষের এবং সিরাপ আকারে শিশুদের জন্য এটি তৈরি করা হয়।
এছাড়া ওষুধ কোম্পানিগুলো শিশুদের ব্যবহারের জন্য প্যারাসিটামল তৈরি করে থাকে। প্যারাসিটামল পানিতে মেশে না। তাই সিরাপ তৈরি করতে সাধারণত প্রপাইলিন গ্লাইকল (দ্রাবক হিসেবে) ব্যবহার করা হয়। ইথাইলিন গ্লাইকল ও ডাই-ইথাইলিন গ্লাইকল হচ্ছে প্রপাইলিন গ্লাইকলের সমগোত্রীয়, তবে ক্ষতিকারক। প্রপাইলিন গ্লাইকলের দাম বেশি হওয়ায় একশ্রেণির অসাধু ওষুধপ্রস্তুতকারী শিশুদের ওষুধে এসব (ইথাইলিন গ্লাইকল ও ডাই-ইথাইলিন গ্লাইকল) বিষ মেশায়। এর ফলে প্রতি বছর অসংখ্য শিশু কিডনি রোগে মারা যায়।
এছাড়াও নকল করা হচ্ছে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত রোগে ব্যবহার করা কেভিনটল ট্যাবলেট। নকল কাঁচামাল দিয়ে তৈরি হচ্ছে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ হাইড্রোকরটিসন ইনজেকশন (এন্টি-অ্যালার্জিটিক)।
মাত্র ৩০ টাকা মূল্যের অ্যান্টিবায়োটিক অ্যামোক্সিসিলিন ড্রাই সিরাপের বোতলে দামি অ্যান্টিবায়োটিক ড্রাই সিরাপের লেবেল লাগিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে বেশি দামে।
৮ থেকে ১০ টাকার জন্মনিয়ন্ত্রক ওষুধ ডিপোপ্রোভেরার লেবেল বদলে ৮০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে ভেজাল ডিপোমেট্রাল। এসব ভেজাল ওষুধ খেয়ে মাতৃত্ব হারাচ্ছেন বহু নারী।
আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ রফিকেক্সিব গ্রুপের ওষুধও বিক্রি হচ্ছে (ব্যথার ওষুধ) অনেক মফস্বলে। চিকিৎসকদের মতে, এসব ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় প্রাণহানিরও আশঙ্কা রয়েছে।
এছাড়া জীবনরক্ষাকারী আরও বেশকিছু নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের উপাদানে তৈরি ওষুধ বাজারে বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এর মধ্যে রয়েছে রক্ত স্বল্পতাজনিত সমস্যায় দেওয়া হয় আয়রন হিমোগ্লোবিন সিরাপ, ট্রাইডাল ইনজেকশন (চর্ম রোগ সংক্রান্ত সমস্যায়), জেনটোমাইসিন গ্রুপের জেনটোসিনাস ইনজেকশন (ঘা শুকানোর জন্য), গ্রাইপ ওয়াটার সিরাপ (পেট ব্যথার জন্য), সালবিউটামল গ্রুপের ওষুধ ভেনটোলিন (শ্বাস কষ্টের জন্য), অ্যান্টিবায়োটিক মাইসেফ, ডাইক্লোফেনাক সোডিয়াম গ্রুপের ওষুধ ডাইক্লোফেনাক (ব্যথার জন্য দেওয়া হয়), বেটনোভেট (চর্ম রোগের জন্য দেওয়া হয়), মেথারজিন ট্যাবলেট (ব্যথার ওষুধ), ডায়াবেটিসের ইনসুলিন, নিউরোবিওন (ভিটামিন বি১ বি১২ বি৬), ভিটামিন বিটেক্স (ভিটামিন বি১ বি১২ বি৬), রেনিটিডিন গ্রুপের ওষুধ গ্যাসের জন্য দেওয়া হয় রেনিটিডিন, জেনটামিনসহ (ইনফেকশনের মলম) বিভিন্ন মোড়কের সিরাপ ও ক্যাপসুল। এছাড়াও রয়েছে ক্যানিকিড ইনজেকশন, ইনফেরন ইনজেকশন ইত্যাদি।
ওষুধ প্রশাসন সূত্র জানায়, সারা দেশে এলোপ্যাথি ওষুধ কোম্পানি রয়েছে ২৪৬টি, ইউনানী ২৬১টি, আয়ুর্বেদিক ১৬১টি ও হোমিওপ্যাথি ওষুধ কোম্পানি ৭৭টি।
একটি ওষুধ একাধিক কোম্পানির তৈরির অনুমতি আছে। যেমন, শুধু প্যারাসিটামল ট্যাবলেট তৈরি করে ১০৬টি কোম্পানি এবং প্যারাসিটামল সিরাপ তৈরি করে ২১টি কোম্পানি।
এদিকে, এই ওষুধ বাজারজাত করা হচ্ছে দেশের প্রায় সোয়া দুই লাখ ওষুধের দোকানে। এর মধ্যে লাইসেন্স রয়েছে মাত্র ৬০ হাজার দোকানের।
বাকি দোকানগুলোর কোনো লাইসেন্স নেই। ফলে গুণগত মানসম্পন্ন ওষুধের পরিবর্তে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের এন্টিবায়োটিক, স্টেরয়েড বা অন্যন্য ওষুধ বিক্রি হচ্ছে যা খেলে জীবন বিপন্ন হতে পারে।
বর্তমানে দেশে বছরে ওষুধ বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার কোটি টাকার। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, এর মধ্যে আড়িইশ কোটি টাকার ওষুধ ভেজাল হচ্ছে। ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কোম্পানিই ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করছে।
সম্প্রতি একটি খবরের কাগজে দেওয়া সাক্ষাতকারে বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান স্বীকার করেন, “বাজারে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। ভেজাল ওষুধ খেয়ে মানুষ মারাও যাচ্ছে।”