রনি আচার্যী
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া দলটির নাম বিএনপি। জাতীয়তাবাদের চেতনায় উজ্জীবিত দল বিএনপি। রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানের সততাই মূলত মূল পুঁজি এ দলটির। বাকশাল কায়েম করে একনায়কতন্ত্র চালু করার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যখন শূন্যতা বিরাজ করছিল তখন খন্দকার মোশতাকের দৃশ্যতঃ বেঈমানি দেখে জাতি রীতিমত স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল। শিশু রাসেলকেও খুনিরা রেহাই দেয়নি। অথচ বঙ্গবন্ধু জানতেন তাঁকে হত্যা করার পরিকল্পনার কথা। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা বহুবার বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করা সত্ত্বেও তিনি সতর্ক হননি। কিন্তু যখন তিনি সপরিবারে নিহত হলেন তখন দেশ এক ক্রান্তিকাল পার করছিল। যদিও আওয়ামী লীগ বলে যে, মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর খুনি। কিন্তু আদৌ এ কথা সত্য নয়। কোনো পরিকল্পনার কথা জানা বা জানতে পারা আর খুন করা এক কথা নয়। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্যে এ কথা বলে নেতা-কর্মীদের বিএনপির বিরুদ্ধে উদ্দীপ্ত করে। সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকা অবস্থায় রক্ষী বাহিনীর বিভিন্ন অপকর্ম ও আওয়ামী লীগারদের সোচ্চার হওয়া বঙ্গবন্ধু তথা খোদ আওয়ামী লীগের অনেক বড় ক্ষতি করেছিল। রক্ষী বাহিনীর অত্যাচারের বর্ণনা দিতে গিয়ে ‘দেয়াল’ বইতে হুমায়ুন আহমেদ লিখেছেন যে, তাদের বাড়িটি রক্ষী বাহিনী দখল করে নিয়েছিল। তখন হুমায়ুন আহমেদের মা, ভাই-বোনসহ ওনারা নিচতলায় কোনো রকম দিনাতিপাত করতেন। শেষে বঙ্গবন্ধু যখন নিহত হন তার পরের দিনই রক্ষী বাহিনীর ওই সদস্যরা তাদের গৃহ ত্যাগ করে পলায়ন করে।
তো চরম এক সংকটকময় মুহূর্তে জেনারেল জিয়া স্বপ্রণোদিত হয়ে গঠন করেন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ দল বিএনপি। অধ্যাপক ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ভাষ্যমতে, জিয়াউর রহমান ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার ২৪ বছরে যে সংখ্যক সভা করে তিনি তার তুলনায় বেশি করায় বিভিন্ন পত্র পত্রিকা তখন জিয়াউর রহমানের স্তুতি করে সংবাদ প্রকাশ শুরু করে। একটা লাল টাই পরে কবি শামসুর রহমানকেও জিয়ার খাল কাটার অনুষ্ঠানে দেখা গিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যেমন জানতেন তাঁকে হত্যা করার পরিকল্পনার কথা তেমনি জিয়াউর রহমানও জানতেন চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে মেজর মঞ্জুর তাঁকে হত্যা করতে পারেন। এ কথা শুনে মেজর জিয়া বলেছিলেন ‘আমাকে মেরে ওর কী লাভ? ওতো ক্ষমতা পাবে না।’ বীরদর্পে তিনি গেলেন চট্টগ্রামে। বীরের বেশেই শহীদ হলেন এই দেশপ্রেমিক। হুমায়ুন আহমেদের ‘দেয়াল’ বইতে তিনি লিখেছেন, জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর আগে এরশাদকে চট্টগ্রাম সেনা ক্যাম্পে দেখা গিয়েছিল হঠাৎ। একদিনের সফরে অতি দ্রুত তিনি চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন মঞ্জুরের সাথে দেখা করতে। ভাগ্যের কী পরিহাস! মঞ্জুর এক সময় জিয়াউর রহমানের ভালো বন্ধু ছিলেন। জিয়ার আদর্শে বলীয়ান হয়ে কর্নেল অলিসহ অন্যরা বিএনপিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বেগম জিয়াকে রাজনীতিতে এসে দলের হাল ধরতে অনুরোধ করেন। দ্বিগুণ অথবা সম পরিমাণ সভা-সমাবেশ মাত্র ২ বছরে করেন। আমরা সবাই একটা কথা জানি কিন্তু তা স্বীকার করিনা যে, বঙ্গবন্ধুর সাথে জিয়াউর রহমানের সুসম্পর্ক ছিল।
জিয়াউর রহমান তাঁর জীবদ্দশায় কোনোদিন শেখ মুজিবের বিরুদ্ধাচরণ করেননি। বঙ্গবন্ধু যে সময়টাতে খুন হন, সে সময় সেনাবাহিনীর মধ্যে দুটি গ্রুপ বা দল সৃষ্টি হয়। একটি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের অনুসারী আর একটি দল ছিল হাসানুল হক (ইনু)র বড় ভাই কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন। যা-ই হোক, বিএনপি ক্ষমতায় এলে জিয়াউর রহমানের নিষ্ঠা ও সততার ফুল ফুটতে থাকে। ব্যক্তি জীবনে জিয়াউর রহমান সৎ ছিলেন এ কথা সর্বজনবিদিত। খাল কাটায় ব্যাপক উন্নয়নের জোয়ারে সমগ্র জাতিকে ভাসালেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। চারদিকে তাঁর গণজোয়ার। দেশের মানুষ যেন এক সঠিক ও বহু কাক্সিক্ষত রাষ্ট্রনায়ক পেয়েছে। বাকশাল ভেঙ্গে গিয়ে এ দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন করেন জিয়াউর রহমান। উল্লেখ্য, জিয়াউর রহমানের শাসনামলেই তিনি স্বউদ্যোগে শেখ হাসিনাকে এদেশে ফিরে আসার আশা দিয়ে আশ্বস্ত করেন। ধানমণ্ডির ৩২নং বাড়ি তাঁর কাছে বুঝিয়ে দিলে শেখ হাসিনা লেখেন ‘বুঝিয়া পাইলাম।’ তারপর এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া এক হয়ে পতন ঘটান স্বৈরশাসনের। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়। বিএনপি তার রাজনীতির মাঠ দাপুটে বেড়ায়। ১৯৯১-এর নির্বাচন, ২০০১-এর নির্বাচন, ২০০৬ সালের নির্বাচনসহ ১/১১ পর্যন্ত বহাল তবিয়তেই ছিল দলটি।
মধ্যখানে ‘হাওয়া ভবন’ কেলেঙ্কারি, দশ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার মামলা, ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা সব মিলিয়ে একটা তালগোল পাকিয়ে যাওয়া অবস্থা। ক্ষমতা থেকে নামার পর এ পর্যন্ত একবার সম্মেলন হয়। দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। মরহুম সেক্রেটারী খন্দকার দেলোয়ার হোসেন এক সফল সম্মেলন করেন। তিনি প্রয়াণের পর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় ক্লিন ইমেজের ব্যক্তিত্বের অধিকারী জনাব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের হাতে। সরকার পতনের আন্দোলনের ডাকে যখন সারা দেশ উত্তাল তখন কেন্দ্র ঢাকা নির্বিকার। কেন্দ্রীয় নেতারা গা ঢাকা দেন। বিফল হয় সব চেষ্টা। তারপর এইতো সেদিন মহানগর আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। কিন্তু এই কমিটির ভেতরও দ্বন্দ্বের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। বিএনপি অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এসেছে। কিন্তু দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে এ মুহূর্তে দেশে ফিরিয়ে আনা মানে মামলায় জড়ানো। এদিকে এ সরকার মুখে তারেক রহমানকে ইন্টারপোলের সাহায্যে দেশে ফিরিয়ে আনার কথা বললেও কার্যত তা আর হচ্ছে না। কারণ ব্রিটিশ সরকার তারেক রহমানকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে। পাশাপাশি তিনি মৎববহ পধৎফ-ও পেতে যাচ্ছেন। এমতাবস্থায় দেখতে হবে সামনে কী হয়। বিএনপি কি তার পুরানো শক্তি সঞ্চয় করে সরকার পতনের আন্দোলনে সফল হতে পারে কিনা! বিএনপির সামনে এখন এটাই সবচে’ বড় চ্যালেঞ্জ।
লেখক : রনি আচার্যী কবি, সাংবাদিক, ছাত্রদল নেতা, চাঁদপুর।