* ১০ দফার রূপরেখা ঘোষণা
* প্রথম কর্মসূচি হবে গণমিছিল
* বাধা মানেননি নেতাকর্মীরা
ঢাকার সমাবেশকে কেন্দ্র করে বাধা, সংঘর্ষ, বিএনপি মহাসচিবসহ দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারে কয়েক দিন ধরে উত্তাপ ছড়ানো নানা ঘটনায় সবার মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত রাজধানীর গোলাপবাগে শান্তিপূর্ণভাবে গণসমাবেশ শেষ করেছে দলটি।
সমাবেশ থেকে হরতাল-অবরোধের মতো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি আসতে পারে—এমন গুঞ্জন থাকলেও সে পথে হাঁটেনি বিএনপি। সরকার পতনের লক্ষ্যে ১০ দফা দাবি আদায়ে আগামী ২৪ ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা করা হয়েছে।
ওই দিন ঢাকাসহ সারা দেশে গণমিছিল করবে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতসহ সরকারবিরোধী সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো একই দাবিতে একই কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এর মাধ্যমে যুগপৎ আন্দোলনের যাত্রা শুরু হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নেতারা।
সমাবেশে প্রধান অতিথি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন ১০ দফা দাবি ও নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ‘এই ১০ দফা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দফা। এই দাবি জনগণের দাবি। উপস্থিত নেতাকর্মীদের হরতাল-অবরোধের স্লোগানের মুখে তিনি বলেন, সময়মতো এ ধরনের কর্মসূচিও দেওয়া হবে। ’
এ সময় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও দলের কর্মীদের হত্যার প্রতিবাদে আগামী ১৩ ডিসেম্বর সারা দেশে গণবিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণাও করেন খন্দকার মোশাররফ। এটি বিএনপির একক দলীয় কর্মসূচি।
এ সমাবেশে জ্যেষ্ঠ নেতারা কী বক্তব্য দেবেন কিংবা কী কর্মসূচি আসবে তার চেয়েও বেশি আলোচনায় ছিল—কী হবে ১০ ডিসেম্বর? সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর সবার নজর ছিল এই সমাবেশের দিকে। বিএনপি সমাবেশস্থলে অবস্থান নিয়ে সরকার পতনের ডাক দেবে—এমন গুঞ্জনও ছিল। দিন শেষে শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি শেষ হওয়ায় সবাই স্বস্তি প্রকাশ করেন।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ বিভিন্ন দাবিতে সব বিভাগীয় শহরে সমাবেশ করেছে বিএনপি। গতকাল ঢাকার সমাবেশের মধ্য দিয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে গণসমাবেশের কর্মসূচি শেষ হয়।
তবে সমাবেশ শেষে সব কিছু ছাপিয়ে বিএনপির সাত সংসদ সদস্যের পদত্যাগের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বেশি। সাত এমপির পাঁচজন মঞ্চে ছিলেন। একজন বিদেশে আছেন। আরেকজন অসুস্থতার কারণে আসতে পারেননি।
সমাবেশস্থল নিয়ে কয়েক দিনের নাটকীয়তা শেষে গত শুক্রবার অনুমতি পাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে গোলাপবাগ মাঠ প্রায় ভরে যায়। গতকাল ভোর থেকে নেতাকর্মীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে মাঠের দিকে যাত্রা করেন। মাঠ পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর আশপাশের সড়কে ছড়িয়ে পড়েন নেতাকর্মীরা।
সমাবেশ ঘিরে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে রাস্তার মোড়ে মোড়ে জলকামান, সাঁজোয়া যান, প্রিজন ভ্যান নিয়ে সতর্ক পাহারায় ছিল পুলিশ।
সমাবেশে আসা নেতাকর্মীদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছিলেন ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলার নেতাকর্মী। অন্য বিভাগের চেয়ে এই সমাবেশে নারীদের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। শ্রমজীবীরাও অংশ নিয়েছেন কর্মসূচিতে।
১০ দফা রূপরেখা
সমাবেশে ঘোষিত যুগপত্ আন্দোলনের ১০ দফা হলো—১. সংসদ বিলুপ্ত করে সরকারের পদত্যাগ, ২. ১৯৯৬ সালের সংবিধান মতে নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন, ৩. সবার গ্রহণযোগ্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করে আরপিও সংশোধন, ইভিএম পদ্ধতি বাতিল ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল, ৪. খালেদা জিয়াসহ সব বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক ও আলেমদের সাজা বাতিল ও মামলা প্রত্যাহার, ৫. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮, সন্ত্রাস দমন আইন ২০০৯ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪-সহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী সব কালা-কানুন বাতিল, ৬. বিদ্যুত্, জ্বালানি, সার, পানিসহ জনসেবা খাতগুলোতে মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিল, ৭. নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনা, ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত, শিশুশ্রম বন্ধ এবং কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা, ৮. গত ১৫ বছর বিদেশে অর্থপাচার, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, বিদ্যুত্-জ্বালানি খাত, শেয়ারবাজারসহ রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্নীতি চিহ্নিত করতে কমিশন গঠন, ৯. গত ১৫ বছরে গুমের শিকার সব নাগরিককে উদ্ধার এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনার আইনানুগ বিচার, ১০. আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, প্রশাসন ও বিচার বিভাগে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ও স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ নিশ্চিত করা।
বাধা মানেননি নেতাকর্মীরা : মোশাররফ
সমাবেশে খন্দকার মোশাররফ সরকারের দমন-পীড়নের চিত্র তুলে ধরে বলেন, ‘অতীতে ৯টি সমাবেশ করেছি, সেগুলোতেও সরকার বাধার সৃষ্টি করেছে। ঢাকার সমাবেশেও বাধা এসেছে। সাধারণ মানুষ সমাবেশে অংশ নিয়ে সরকারের রক্তচক্ষুর জবাব দিয়েছে। ’
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, নয়াপল্টনে সমাবেশ করলে জনদুর্ভোগ হবে বলে সরকার অনুমতি দেয়নি। অথচ ওই রাস্তা গত চার দিন ধরে বন্ধ করে রেখেছে সরকার। তাহলে জনদুর্ভোগ কে সৃষ্টি করল?
সভাপতির বক্তব্যে মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ বলেন, সমাবেশ সফল করে আপনারা সরকারকে সমুচিত জবাব দিয়েছেন।
মহানগর দক্ষিণের সদস্যসচিব রফিকুল আলম মজনু ও উত্তরের সদস্যসচিব আমিনুল হকের সঞ্চালনায় সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকার, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুল্লাহ আল নোমান, বরকতউল্লা বুলু, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, আহমেদ আযম খান, ফরহাদ হালিম ডোনার, মাহবুব উদ্দিন খোকন, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, জয়নাল আবেদীন, রুমিন ফারহানা, মোশাররফ হোসেন, উকিল আবদুস সাত্তার, আমিনুল ইসলাম, জাহিদুর রহমান, জি এম সিরাজ, আবদুস সালাম আজাদ, নাসির উদ্দিন অসীম, সালাহউদ্দিন আহমেদ, মীর শরাফত আলী সপু, শিরিন সুলতানা, আফরোজা আব্বাস, হাবিবুর রশীদ হাবিব, বেনজীর আহমেদ টিপু, সাইফুল আলম নীরব, তাবিথ আউয়াল, ইশরাক হোসেন, ওমর ফারুক শাফিন, আকরামুল হাসান, কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণ প্রমুখ বক্তব্য দেন।
সমাবেশে হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ, শাহজাহান ওমর, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, মোহাম্মদ শাহজাহান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, শামসুজ্জামান দুদু, নিতাই রায় চৌধুরী, মিজানুর রহমান মিনু, আবুল খায়ের ভুঁইয়া, জয়নুল আবদিন ফারুক, তাজমেরী এস ইসলাম, হাবিবুর রহমান হাবিব, এস এম ফজলুল হক, সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুল, হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, মাহবুবুর রহমান পিংকু, গোলাম কবির কামাল, আবুল সালেহ চৌধুরী, মঞ্জুর এলাহীসহ কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি ও গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে সমাবেশ এলাকায় প্রাইভেট কারে ঘুরতে দেখা গেছে।