অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে নিঃস্ব করে দিয়েছে
গতকাল বৃহস্পতিবার অনলাইন পত্রিকা চাঁদপুর নিউজে ‘বিশেষ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন : অ্যাডঃ আনোয়ার গাজী এ যাবৎ ৫বার জেল হাজত খাটেন! সংখ্যালঘু ব্যবসায়ীর ২০ লাখ টাকা ও কাঠ ব্যবসায়ীর ৩০ লাখ টাকা আত্মসাৎ, ঠিকাদারের ১ লাখ টাকা ছিনতাই, পুলিশ পিটানো ও ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রকাশ্যে হুমকির অভিযোগ’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদটি সর্বস্তরে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তার অত্যাচারের শিকার অনেক সাধারণ মানুষ এখন মুখ খুলতে শুরু করেছে। চেয়ারম্যানঘাট এলাকার অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে আনোয়ার গাজী নিঃস্ব করে দিয়েছে বলে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে।
গতকালের সংবাদটি পড়ার পর বিভিন্ন পাঠকের কাছ থেকে প্রকাশ পেতে থাকে বিতর্কিত আইনজীবী আনোয়ার গাজীর চেম্বার নামক ‘টর্চার সেল’ -এর অভ্যন্তরে সংঘটিত নানা ভয়াবহ ঘটনা। সে সময় লোমহর্ষক ঘটনার নির্মম বর্ণনা দিয়ে অনেকেই শিউরে উঠেন। সে সাথে থলের বিড়ালের ন্যায় ধীরে ধীরে বেরিয়ে পড়ে তার চেম্বারের অভ্যন্তরে টর্চার সেলে সাধারণ, অসহায় ও নিরীহ লোকজনকে নির্মম নির্যাতনের অপ্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে এ প্রতিবেদক সরজমিনে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে বিস্তারিত জানতে পারে।
বিতর্কিত আইনজীবী আনোয়ার গাজী বেশ ক’বছর আগে ষোলঘর চেয়ারম্যানঘাটস্থ দক্ষিণ জিটি রোড এলাকার স্থায়ী নিবাসী মাওলানা কাজী সাদেক মোঃ ফারুকের মালিকানাধীন মার্কেটটির দ্বিতীয় তলা তার চেম্বারের জন্য ভাড়া নেন। তখন এ ফ্লোরটির অর্ধেকে চাঁদপুরের অতিরিক্ত পিপি অ্যাডঃ মোঃ মজিবুর রহমান ভূঁইয়াও ছিল। আনোয়ার গাজী তার চেউয়া বাহিনী ও সন্ত্রাসীদের দিয়ে বিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে মজিব ভূঁইয়াকে চেম্বার ছেড়ে যেতে বাধ্য করেন। এরপরই তার চেম্বারের নামে গড়ে তোলা হয় টর্চার সেলের রামরাজত্ব। অবশ্য বর্তমানে ওই চেম্বারে ২/৩জন ভদ্র আইনজীবীও রয়েছেন। কিন্তু তাঁরা মানসম্মানের কথা চিন্তা করে ভয়ে কিছুই বলতে সাহস পান না। মুখ বুঁজে সবকিছুই সহ্য করছেন তারা।
বিতর্কিত আইনজীবী আনোয়ার গাজীর এক সময়ের খুবই বিশ্বস্ত তারই ভাতিজা মিন্টু গাজীকে (৩২) এই টর্চার সেলে আনোয়ার গাজীর হাতে বেদম পিটুনি খেয়ে ও চরম লাঞ্ছিত হয়ে বিদায় নিতে হয়েছে। মিন্টু গাজী সাংবাদিকদের জানান, আমার অপরাধ ছিল চাচা আনোয়ার গাজী তার শ্বশুরের মাধ্যমে তার বন্ধুর মামলার ৬০ হাজার টাকা প্রতারণা করে আত্মসাৎ করে যা আনোয়ার গাজীর স্ত্রী (চাচী)-এর কাছে ফাঁস করে দিয়েছিলাম। চাচা-ভাতিজা নয়, কোনো মানুষ মানুষকে এভাবে মারে না বলে সে অঝোরে কেঁদে ফেলে। আনোয়ার গাজীর আরেক বিশ্বস্ত পিচ্চি আনিছকেও (১৬) বেধড়ক পিটুনি খেতে হয়েছে ওস্তাদ আনোয়ার গাজীর হাতে এ টর্চার সেলেই। এছাড়া আনিছের বড় ভাই আরিফকেও (২৪) চেম্বার নামক এ টর্চার সেলে ডেকে এনে বেদম পিটায় আনোয়ার গাজী। তার অপরাধ ছিল সে ২৩ হাজার টাকা (ফ্ল্যাক্সিলোডের) বাকি থাকার পরও কেনো আনোয়ার গাজীকে মোবাইলে ২ হাজার টাকা লোড দিতে রাজি হয়নি। এমনকি তাদের বৃদ্ধ পিতা মজিব (৬৫) নামক চায়ের দোকানদারকেও চায়ের বিল নিয়ে মারাত্মকভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে আনোয়ার গাজীর হাতে এ চেম্বারেই। তিনি দুঃখ করে সাংবাদিকদের জানান, ‘উনি আসলে আনোয়ার গাজী না জানোয়ার গাজী। সব উকিল সাহেব ওনাকে ঠিকমতই বোতল গাজী বলেন। কেননা উনি তো সারাদিন বোতল নিয়েই পড়ে থাকেন। এমনকি কোর্ট চলাকালীন আমার ছেলে আনিছের কাছ থেকে ডাইল (ফেন্সিডিল) নিয়ে গব গব করে পান করেন। কেউ দেখে ফেলে জিজ্ঞেস করলে উনি বলেন, আমার কাশ হয়েছে, কাশের সিরাপ খাচ্ছি। তাহলে আপনারাই বলুন, ওনাকে বোতল গাজী বললে অসুবিধা কোথায়? আমার ছেলে আনিছকে উনি নষ্ট করে ফেলেছেন, আমার ছেলেকে দিয়ে মাদকদ্রব্য আনা-নেয়া করে এবং মাদকদ্রব্য তার কাছে রাখে। এই গাজী সাহেব প্রতিদিন ৩৫-৪০ কাপ চা তার চেম্বারে নিয়ে পয়সা দেন মাত্র ৫/৬ কাপের। এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে তিনি আমাকে তার চেম্বারে ডেকে নিয়ে উচ্চস্বরে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে লাঞ্ছিত করেন। আল্লাহ্পাক ওনাকে এত বেইজ্জতি করেন অথচ ওনার একটুও লজ্জা-শরম নাই এবং হুঁশ হয় না। এসব বলে বৃদ্ধ চা-দোকানীও সাংবাদিকদের সামনে কেঁদে দেন। এছাড়া তার চেম্বারের পশ্চিম পাশে নিচে ফেনসিডিলের খালি বোতলের স্তূপ দেখা যায়। তার চেম্বারে গভীর রাত পর্যন্ত শহরের চিহ্নিত মাদকসেবীদের আড্ডা বসতো বলে এলাকার দোকানদাররা জানান।
বিতর্কিত আইনজীবী আনোয়ার গাজী গত বছরের পবিত্র রমজান মাসে গোয়েন্দা বিভাগের ভয়ে তার চেম্বারে বসে ডাইল (ফেন্সিডিল) খাওয়া বন্ধ রেখে তার চেম্বারের সামনের ভবনের দীপালী লন্ড্রির মালিক পলাশের দোতলার কক্ষে গিয়ে দলবল নিয়ে ডাইল খাওয়া শুরু করে। সে এ সবের প্রতিবাদ করায় তাকে তার চেম্বারে ডেকে নিয়ে মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলে। পরে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে হয়। এলাকার মা জুয়েলার্স-এর মালিকের কাছ থেকে আনোয়ার গাজী ২২ হাজার টাকা মূল্যের ২টি স্বর্ণের আংটি ১ বছর যাবৎ বাকি নিয়ে দেই-দিচ্ছি বলে ঘুরিয়ে অবশেষে এলাকাবাসীর চাপে ১৫ হাজার টাকা দিতে বাধ্য হন। এ নিয়েও তিনি পাওনাদারের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করেন। এমনকি এলাকার ভ্রাম্যমাণ ফ্ল্যাক্সিলোড ব্যবসায়ী অন্ধ হাফেজ ইব্রাহিম খলিলের সাথেও তিনি চরম দুর্ব্যবহার করেন ‘টর্চার সেল’ নামক এই চেম্বারেই। এছাড়া চেয়ারম্যান ঘাট এলাকার ভেন্ডার, ফলের দোকান, মুদী দোকান, ফ্ল্যাক্সিলোড ব্যবসায়ীসহ ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীও আনোয়ার গাজীর কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা পাবে।
আনোয়ার গাজী চাঁদপুর কোর্ট স্টেশন এলাকার নিরীহ ও দরিদ্র ফলব্যবসায়ী জুলহাস বেপারীকে (৬০) তার দোকানের জায়গা ঠিক করে দেয়ার কথা বলে প্রতারণা করে ১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। তিনি এই টাকা চাইতে গেলে চেম্বারে আনোয়ার গাজীর হাতে হেনস্থা হতে হয়। চাঁদপুর সদর উপজেলার হাপানিয়া গ্রামের মিজি বাড়ির মৃত আঃ রাজ্জাক মিজির অসহায় কন্যা ফরিদা ইয়াসমিন রোজীকে তার স্বামী-সংসার ঠিক করে দেয়ার কথা বলে প্রতারণা করে তার কাছ থেকে বিভিন্ন সময় নগদ ৮০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন আনোয়ার গাজী। তিনি এ ব্যাপারে গত বছর চাঁদপুরের সাবেক পুলিশ সুপারের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ করেছিলেন। তিনি কেনো প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন, এজন্য তাকেও এই চেম্বারের টর্চার সেলে বিভিন্ন সময় আনোয়ার গাজী মানসিকভাবে লাঞ্ছিত করেছেন। শাহরাস্তির জনৈক বৃদ্ধা ও পুত্রকে মামলা সংক্রান্তে অনেক হেনস্থা হতে হয়েছে আনোয়ার গাজীর হাতে এই চেম্বারেই। অসহায় বৃদ্ধা অনেক কষ্টের বিনিময়ে ধার-দেনা করে এবং সুদের বিনিময়ে ১ লাখ টাকা এনে আনোয়ার গাজীর হাতে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি প্রতারণা করায় এলাকার তাফাজ্জল ডাক্তার উদ্যোগ নিয়ে জামিন করান। পরে হতভাগ্য পুত্র অসহায় মায়ের ধার-কর্জের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অবশেষে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়।
সবচে’ আশ্চর্যের ঘটনা হচ্ছে, ফরিদগঞ্জের চরবড়ালী গ্রামের রব ডাক্তারের পুত্র হারুনের স্ত্রীর মামলায় আনোয়ার গাজী তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় ২ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েও কোনো কাজ না করে মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছর ঘুরিয়ে মারাত্মক প্রতারণা করে। শুধু তাই নয়, এর প্রতিবাদ করায় আনোয়ার গাজী বাবুরহাটের মোবাইল ব্যবসায়ী মিজানকে তার টর্চার সেলে ধরে এনে বেদম পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করে হাসপাতালে পাঠায়। এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় রব ডাক্তার ও হারুনসহ ক’জনকে চরম হেনস্থা করে আনোয়ার গাজী তার টর্চার সেলে। এভাবে অনেক মক্কেলকে ধরে এনে আনোয়ার গাজী তার টর্চার সেলে নির্মমভাবে মারধর করে খুলনার এরশাদ সিকদারের ন্যায় অত্যাচারের রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। এছাড়া বিতর্কিত এই আনোয়ার গাজী চাঁদপুরের আদালত অঙ্গনে বিভিন্ন সময় বাপ-দাদাতুল্য শতাধিক সিনিয়র আইনজীবীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে লাঞ্ছিত করে পবিত্র আদালত এলাকায় আইয়্যামে-জাহেলিয়াতের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন।