বিদ্যুতের খুচরা দাম বাড়ানোর তোড়জোড় চলছে। এ মাসেই দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসতে পারে। গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়লে নতুন করে আবারো সব কিছুতে এর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমনিতেই বাজারে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী অবস্থায় নাভিশ্বাস জনজীবনে। ফের বিদ্যুতের দাম বাড়লে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে পড়বে মধ্যবিত্তরা। গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে শিল্প-কারখানায় উৎপাদন খরচ এবং মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। এতে নিম্ন আয়ের মানুষ আরও দুর্ভোগে পড়বে বলেও জানান তারা। করোনাকালেও মানুষ ছিল অর্থনৈতিকভাবে ভীষণ কষ্টের মধ্যে। সে মন্দাভাব কাটিয়ে ওঠার আগেই জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে মানুষকে আঘাত করা হচ্ছে। গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১৫ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গঠিত কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি।
এর আগে গত মাসে বেশির ভাগ খাদ্যদ্রব্যের দাম স্থিতিশীল থাকায় ডিসেম্বরে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি আরও কমে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশে নেমে এসেছে বলে জানায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)।
গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়লে ২০২৩ সালের মূল্যস্ফীতিকে তা উস্কে দেবে বলে মন্তব্য করেছেন ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম। রোববার বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয়ে গণশুনানিতে অংশ নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি, সিস্টেম লস, অনিয়ম বন্ধে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না সরকার। অন্যদিকে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে জনগণের কষ্ট বাড়ছে। বিদ্যুতের গ্রাহক পর্যায়ে দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে কথা বলেন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) এর সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ ও বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান। বিসিআই সভাপতি বলেন, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতি বাড়াবে। এতে নিম্ন আয়ের মানুষ আরও ভোগান্তিতে পড়বে। বিপিডিবি যদি দুর্ভোগ বাড়াতে না চায়, তবে তাদের কার্যদক্ষতা বাড়াতে হবে। দাম বাড়িয়ে লাভ হয় না, বরং কার্যদক্ষতা বাড়িয়ে হয়। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা চলছে। এমন সময়ে যখন রপ্তানি টিকিয়ে রাখাই চ্যালেঞ্জ তখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে কারখানাগুলোতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে।
অপচয় কমানোর পাশাপাশি মূল্য সংযোজন কর ও অন্যান্য কর কমাতে হবে। শিল্প-কারখানা যাতে টিকে থাকতে পারে এবং নিম্ন আয়ের মানুষ যাতে ভোগান্তিতে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে বলেও জানান তিনি। বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, যখন বিশ্বব্যাপী মন্দার উদ্বেগ বাড়ছে, তখন বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে কারখানার উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। দাম বাড়ানোর চেয়ে, তাদের উচিত সিস্টেম লস কমানো। এখনো অনেক অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। তাই সরকার যদি অবৈধ সংযোগগুলো বিচ্ছিন্ন করে তাহলে যে খরচ বেড়েছে তা কিছুটা সামাল দেয়া যাবে। এদিকে, শুনানিতে বিইআরসি’র কারিগরি কমিটি প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের খুচরা মূল্য ১ টাকা ১০ পয়সা বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে।
সেই হিসাবে খুচরা বিদ্যুতের মূল্য গড়ে ৭ দশমিক ১৩ পয়সা থেকে বেড়ে ৮ দশমিক ১৩ পয়সা করার সুপারিশ করেছে। এতে গড়ে দাম বাড়তে পারে ১৫ দশমিক ৪৩ ভাগ। গত ২১শে নভেম্বর বিদ্যুতের পাইকারি দাম ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বৃদ্ধি করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এরপর বিদ্যুতের খুচরা দাম বৃদ্ধির আবেদন করে বিতরণ কোম্পানিগুলো। সবগুলো প্রতিষ্ঠান বলছে পাইকারি দাম বৃদ্ধির পর খুচরা দাম না বাড়ালে তারা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে। সর্বশেষ ২০২০ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের বিদ্যুতের গণশুনানির ফলাফল সাধারণত ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে দেয়া হয়ে থাকে। তবে এবারের গণশুনানির ফলাফল চলতি মাসেই দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিইআরসি’র চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল। গণশুনানির সমাপনী বক্তব্যে চেয়ারম্যান বলেন, সবাইকে খুশি করা কঠিন। তবে ভোক্তাও যাতে ক্ষুব্ধ না হয়, আবার কোম্পানিগুলোও যাতে চলতে পারে সেভাবে সিদ্ধান্ত দেয়া হবে।
এখন পর্যন্ত কমিশনের আদেশে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, হয়তো মুনাফা কিছুটা কমেছে। কমিশনের দেয়া আদেশে এখনো কেউ বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। আব্দুল জলিল বলেন, ১৯৭১ সালে বাজারে কাপড় ছিল কিন্তু কেনার লোক ছিল না। দাম বাড়িয়ে দিলেন কিন্তু দেখা গেল শিল্প বন্ধ হয়ে গেল, তাহলে কী হবে? ভোক্তার দিকটাও বিবেচনায় নিতে হবে। সাবধানে পা ফেলতে হবে আগামী দুই বছর। বিতরণ কোম্পানিগুলোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিইআরসি’র কারিগরি কমিশন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের খুচরা ট্যারিফ ৮.৭৪ টাকা, পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ডের ক্ষেত্রে ৭.৬৩ টাকা, ডিপিডিসি’র ক্ষেত্রে ৯.৪৩ টাকা, ডেসকো’র ক্ষেত্রে ৯.৪১ টাকা, ওজোপাডিকো’র ক্ষেত্রে ৮.৫৪ টাকা এবং নেসকো’র ক্ষেত্রে ৮.১৬ টাকা করার সুপারিশ করে। শুনানিতে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) তাদের প্রস্তাবে জানায়, দাম না বাড়ালে তাদের ক্ষতি হবে ১ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। একইভাবে পিডিবি ২৩৪ কোটি, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ১ হাজার ৫৫১ কোটি, ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) ১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা, নর্দান ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) বলছে তাদের ৫৩৫ কোটি টাকা লোকসান হবে। ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) কোনো আর্থিক অঙ্ক দাঁড় না করালেও বলছে দাম না বাড়ালে তাদের ক্ষতি হবে।