নিজস্ব প্রতিবেদক :দেশের ২৬ হাজার ১৯৩টি রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের ঐতিহাসিক চূড়ান্ত ঘোষণা আজ। এর মাধ্যমে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক লাখ তিন হাজার ১৯২ জন শিক্ষকের চাকরি সরকারি হবে। তবে পুরো প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা হবে তিন ধাপে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকালে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের মহাসমাবেশ থেকে যুগান্তকারী এ ঘোষণা দেবেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী ডা. আফছারুল আমীন গতকাল সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় ঐতিহাসিক ঘটনা। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষক সমাজের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হবে। সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন ও গণশিক্ষা সচিব এমএম নিয়াজউদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।
ডা. আফছারুল আমীন জানান, এমপিওভুক্ত রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ২২ হাজার ৯৮১টি, স্থায়ী নিবন্ধনপ্রাপ্ত ৩৮৮টি, অস্থায়ী নিবন্ধনপ্রাপ্ত ৩৬১টি, পাঠদানের অনুমতিপ্রাপ্ত ৭২০টি, এমপিওবহির্ভূত কমিউনিটি ৬৫৩টি, এমপিওবহির্ভূত এনজিও বিদ্যালয় ১৩০টি, পাঠদানের অনুমতির সুপারিশপ্রাপ্ত ১৫১টি এবং পাঠদানের অনুমতির অপেক্ষায় থাকা ৮০৯টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ হচ্ছে। বর্তমানে এসব বিদ্যালয়ে এক লাখ তিন হাজার ১৯২ জন শিক্ষক কর্মরত আছেন।
জাতীয়করণের এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত হবে বলেও মনে করেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব (ভারপ্রাপ্ত) এমএম নিয়াজউদ্দিন। তিনি বলেন, সরকারি প্রাথমিক ও রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে বৈষম্য ছিল। বেসরকারি বিদ্যালয় জাতীয়করণের ঘোষণার মধ্য দিয়ে তা দূর হবে।
তিন ধাপে জাতীয়করণ
এমপিওভুক্ত ২২ হাজার ৯৮১টি বিদ্যালয়ের ৯১ হাজার ২৪ জন শিক্ষক প্রথম ধাপে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে জাতীয়করণের আওতায় আসবে। এ বিষয়ে গণশিক্ষামন্ত্রী আরও জানান, এর জন্য ২০১২-১৩ অর্থবছরে সরকারের অতিরিক্ত খরচ হবে ১০০ কোটি টাকা।
তিনি জানান, দ্বিতীয় ধাপে স্থায়ী-অস্থায়ী নিবন্ধনপ্রাপ্ত, পাঠদানের অনুমতিপ্রাপ্ত, কমিউনিটি এবং সরকারি অর্থায়নে এনজিও কর্তৃক নির্মিত-পরিচালিত দুই হাজার ২৫২টি বিদ্যালয়ের ৯ হাজার ২৫ জন শিক্ষককে ১ জুলাই থেকে জাতীয়করণের আওতায় আনা হবে। আর তার জন্য ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সরকারের অতিরিক্ত ৩৭১ কোটি টাকা খরচ হবে।
এছাড়া পাঠদানের অনুমতির সুপারিশপ্রাপ্ত এবং পাঠদানের অনুমতির অপেক্ষায় থাকা ৯৬০টি বিদ্যালয়ের তিন হাজার ৭৯৬ জন শিক্ষককে ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয়করণের আওতায় আনা হবে। এ বিষয়ে গণশিক্ষামন্ত্রী বলেন, তৃতীয় ধাপ বাস্তবায়নে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সরকারের অতিরিক্ত খচর হবে ৬৫১ কোটি টাকা।
বঙ্গবন্ধুর ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনা
জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে ৩৬ হাজার ১৬৫টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। ওই সময় এসব বিদ্যালয়ের এক লাখ ৫৫ হাজার ২৩ জন শিক্ষকের চাকরি সরকারি হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে আরও এক হাজার ৫০৭টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়।
শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের ঐতিহাসিক ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন।
দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ফল
১৯৯১ সালে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। একই দাবিতে ১৯৯৭ সালে ঢাকার ওসমানী উদ্যানে শিক্ষকরা আমরণ অনশন করেন। শিক্ষকদের কর্মসূচির নবম দিনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া শিক্ষকদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে তাদের অনশন ভাঙান। এরপর ২০০০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ওসমানী উদ্যানে শিক্ষকরা শিক্ষক মহাসমাবেশের আয়োজন করেন। ওই সমাবেশে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া উপস্থিত থেকে শিক্ষকদের দাবি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্তির ঘোষণা দেন। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার শিক্ষকদের দাবি বাস্তবায়নে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এরপর শিক্ষকদের আন্দোলন ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে।
২০১১ সালের নভেম্বরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী ডা. আফছারুল আমীন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণে সরকারের কোন পরিকল্পনা নেই। এ খবরে শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে একই দাবিতে ওই বছরের ২১ থেকে ২৭ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মহাসমাবেশ, অবস্থান ধর্মঘট, অনশনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন সারাদেশের বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কয়েক হাজার শিক্ষক। এরপরও দাবি আদায় না হওয়ায় গত বছরের ১৫ ও ১৬ জানুয়ারি দেশের সব বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে ধর্মঘট পালন করেন তারা। পরে দাবি আদায়ে ১৭-১৯ জানুয়ারি কর্মবিরতি পালন করেন শিক্ষকরা।
এতেও সরকার তাদের অবস্থানে অনড় থাকলে শিক্ষকরা গত বছরের ১৩ থেকে ১৮ মে পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান ফের কর্মসূচি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রা, স্মারকলিপি প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। এসব কর্মসূচি পালনের সময় শাহবাগে পুলিশের পিটুনিতে গুরুতর আহত এক শিক্ষক মারা যান। এরপর শিক্ষকদের আন্দোলন আরও জোরালো হতে থাকে। একপর্যায়ে গত বছরের ১৬ মে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাসে কর্মসূচি স্থগিত করেন শিক্ষকরা।
২০১২ সালের ১৮ মে শিক্ষকরা ৩১ মের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শিক্ষক নেতাদের বৈঠকের সময় বেঁধে দেন। এ সময়ের মধ্যে ঘোষণা না এলে শিক্ষকরা একই বছরের ১৬ জুন থেকে দেশের সব বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনিদির্ষ্টকালের জন্য তালা ঝুলানোর হুমকি দেন। একপর্যায়ে গত বছরের ২৭ মে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শিক্ষকদের ১৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল সাক্ষাৎ করেন। প্রধানমন্ত্রী তাদের আশ্বাস দেন শীঘ্রই শিক্ষক মহাসমাবেশ থেকে বেসরকারি প্রাথমিকের শিক্ষকদের জাতীয়করণের ঘোষণা দেয়া হবে। শিক্ষকদের প্রায় দুই দশকের আন্দোলন সংগ্রামের ঐতিহাসিক পরিসমাপ্তি ঘটছে আজ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার মধ্য দিয়ে।
শিরোনাম:
শুক্রবার , ২৫ এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ১২ বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।