দেশের খুচরা বাজারে (কার্ব মার্কেট) হঠাৎ করেই ডলারের দরপতন হয়েছে। মানি এক্সচেঞ্জগুলোয় প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য নেমে এসেছে ১১০ টাকা ৫০ পয়সায়। যদিও এর বিপরীত চিত্র ব্যাংকে। দেশের কোনো কোনো ব্যাংক আমদানিকারকদের কাছ থেকে ডলারপ্রতি ১১৫-১১৬ টাকাও নিচ্ছে। ডলার সংকটের কারণে দেশের বেশকিছু ব্যাংক ঋণপত্রের (এলসি) দায় পরিশোধেও ব্যর্থ হচ্ছে। কার্ব মার্কেটে ব্যাংকের চেয়েও কম দামে ডলার বেচাকেনার ঘটনা এর আগে দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রতি বছরই হজের মৌসুমে দেশের কার্ব মার্কেটে ডলারের চাহিদা তীব্র হয়। এ চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে ডলারের দাম। কিন্তু এবার কার্ব মার্কেটের চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। গত এক মাস দেশের মানি এক্সচেঞ্জগুলোয় ডলারের সরবরাহ বাড়ছে। গতকাল রাজধানীর মানি এক্সচেঞ্জগুলোয় প্রতি ডলারের বিক্রয় মূল্য ছিল ১১০ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১১১ টাকা। যদিও গত বছরের অক্টোবরে কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার ১২০ টাকায়ও বেচাকেনা হয়েছিল।
হঠাৎ করে দেশের কার্ব মার্কেটে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করেছে বণিক বার্তা। এক্ষেত্রে সরকারি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার পর্যবেক্ষণ ও মানি এক্সচেঞ্জ সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য—দেশের কার্ব মার্কেটের একটি অংশ সবসময়ই ভারতনির্ভর। প্রতিবেশী দেশ থেকে অবৈধ পথে আসা ডলার কার্ব মার্কেটে লেনদেন হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত থেকে ডলার আসার প্রবণতা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। দেশের বিমানবন্দরগুলোকে কেন্দ্র করে পরিচালিত স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে কার্ব মার্কেটে ডলার সরবরাহের একটি সম্পর্ক রয়েছে। স্বর্ণ চোরাচালান নির্বিঘ্ন হলে ভারত থেকে ডলার সরবরাহ বাড়ে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম কমে যাওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে দেশের ব্যাংক খাতে ডলারের সংকট কমেনি। ব্যাংকগুলো এখনো আমদানি দায় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। বিদেশী ব্যাংকগুলো ঋণসীমা (ক্রেডিট লাইন) কমিয়ে দিচ্ছে। বেসরকারি খাতে আসা বিদেশী ঋণের মেয়াদ বাড়ানো যাচ্ছে না। এ কারণে ব্যাংকগুলোতে ডলারের সংকট কমছে না। শিগগিরই এ সংকট কেটে যাবে এমনটাও ভাবার কোনো কারণ নেই।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদিত দর অনুযায়ী, গতকাল দেশের ব্যাংক খাতে প্রতি ডলারের সর্বোচ্চ বিনিময় হার ছিল ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা। কিন্তু এ দরে দেশের আমদানিকারকরা ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে পারেননি। ব্যাংকগুলোও রফতানিকারকদের কাছ থেকে ঘোষিত দরের চেয়ে অনেক বেশি টাকায় ডলার কিনতে বাধ্য হচ্ছে। রেমিট্যান্স হাউজগুলোর কাছ থেকে ডলার কিনতেও বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা।
দেশের তৃতীয় প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী জানান, চলতি মাসে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান উন্নয়নকাজের বিল হিসেবে বিদেশী প্রতিষ্ঠান থেকে ৪০ লাখ ডলার পায়। দেশের ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি প্রতি ডলার ১১৬ টাকা দরে ব্যাংকের কাছে বিক্রির প্রস্তাব করে। কিন্তু ব্যাংক ১০৮ টাকার বেশি দিতে অস্বীকৃতি জানালে গ্রাহক অন্য ব্যাংকে ডলার সরিয়ে নেয়ার কথা জানায়। শেষ পর্যন্ত দরকষাকষির পর ব্যাংকটির একজন আমদানিকারক ১১৫ টাকায় ৪০ লাখ ডলার কিনে নেয়। এভাবে অন্য আমদানিকারকরাও দরকষাকষি করে রফতানি আয় কিনে নিচ্ছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকার হিসেবে তাদের কিছু করার থাকছে না।
তবে কিছু ব্যাংক গ্রাহকদের কাছে সরাসরি ১১৫-১১৬ টাকায় ডলার বিক্রি করছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চলতি মাসের শুরুতে একটি বড় এলসি দায় পরিশোধের চাপে ছিলাম। কোনো ব্যাংকই ঘোষিত দরে ডলার বিক্রি করতে রাজি হয়নি। বাধ্য হয়ে ব্যাংকের কাছ থেকে ১১৪ টাকা ৫০ পয়সা দরে ডলার কিনে এলসি দায় পরিশোধ করতে হয়েছে।’
দেশে ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষে রয়েছে টিকে গ্রুপ। ডলার সংকটের কারণে আমদানির দায় পরিশোধে এ গ্রুপটিকেও চাপের মুখে পড়তে হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে টিকে গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ মুস্তাফা হায়দার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে ডলারের সংকট আছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর যেকোনো সংকটের সময় নির্ধারিত দরে কিছু পাওয়া দুষ্কর হয়ে যায়। টিকে গ্রুপ দেশের ভোগ্যপণ্যের উল্লেখযোগ্য অংশের জোগান দেয়। এ কারণে ব্যাংকগুলো আমাদের এলসি দায় পরিশোধে হয়তো কিছুটা উদারতা দেখায়।’
দেশে ডলারের খুচরা বাজার বা কার্ব মার্কেট মূলত মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। বর্তমানে দেশে ২৩৫টি মানি এক্সচেঞ্জের লাইসেন্স রয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগসহ (সিআইডি) বিভিন্ন সংস্থার অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে এক হাজারেরও বেশি মানি এক্সচেঞ্জ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। মানি এক্সচেঞ্জগুলোর বড় একটি অংশ অবৈধ হুন্ডি তৎপরতার সঙ্গে জড়িত। কিছু মানি এক্সচেঞ্জের নেটওয়ার্ক এতটাই বিস্তৃত যে বিশ্বের যেকোনো দেশে যেকোনো পরিমাণ ডলার মুহূর্তে সরবরাহ করতে পারে।
একাধিক মানি এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তা জানান, দেশে বৈধ মানি এক্সচেঞ্জগুলো মূলত মানুষের বিদেশ ভ্রমণের সময় ডলারের জোগান দেয়। আবার বিদেশ থেকে ফিরে অনেকে মানি এক্সচেঞ্জগুলোয় ডলার বিক্রি করে। কিন্তু দেশে বড় মাপের হুন্ডি তৎপরতার সঙ্গে অনেক ‘রাঘববোয়াল’ জড়িত। তারা দেশে-বিদেশে বসে হুন্ডির বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ রেমিট্যান্সের প্রধান উৎসের দেশগুলোয় প্রভাবশালীদের বিস্তৃত হুন্ডির নেটওয়ার্ক রয়েছে। তাদের নিয়োগকৃত এজেন্ট প্রবাসীদের কাছ থেকে বিদেশী মুদ্রা সংগ্রহ করছে। আর দেশে তাদের প্রতিনিধিরা ব্যাংকসহ অন্যান্য উৎস থেকে সংগৃহীত নগদ অর্থ প্রবাসী পরিবারগুলোর হাতে পৌঁছে দিচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার জন্য ব্যবসায়ীরা আমদানি পর্যায়ে পণ্যের দাম কম দেখাচ্ছেন। এক্ষেত্রে ঋণপত্রে উল্লেখিত পণ্যের মূল্য যাচ্ছে ব্যাংকিং চ্যানেলে। বাকি অর্থ পাঠানোর জন্য বেছে নেয়া হচ্ছে হুন্ডিকে। অবৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করার জন্যও হুন্ডি ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশীরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাড়ি-গাড়িসহ সম্পত্তি কিনছেন। এক্ষেত্রেও দেশ থেকে বড় অংকের অর্থ যাচ্ছে হুন্ডিতে। আবার উচ্চশিক্ষা বা বিভিন্ন কারণে বসবাসকারী ব্যক্তিদের কাছে অর্থ পাঠানোর জন্যও হুন্ডিকে বেছে নেয়া হচ্ছে।
গত ছয় মাসে সিআইডির পক্ষ থেকে অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়। ওইসব অভিযানে ডজনখানেক মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার পাশাপাশি অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে আটকও করা হয়। কিন্তু এর পরও দেশে হুন্ডি তৎপরতা কমানো যায়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
মানি এক্সচেঞ্জগুলোর সংগঠন ‘মানি চেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’-এর সভাপতি একেএম ইসমাইল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মানি এক্সচেঞ্জগুলোয় এখন চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত ডলার পাওয়া যাচ্ছে। এ কারণে ডলারের দাম কমে গেছে। রোববার (গতকাল) খুচরা বাজারে ডলারের দাম ছিল ১১০ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১১১ টাকা। পবিত্র হজ উপলক্ষে দেশে সৌদি মুদ্রা রিয়ালের চাহিদা বেড়েছে। ঈদুল আজহা উপলক্ষে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী দেশে আসছেন। প্রবাসীরা তাদের সঙ্গে করে ডলারসহ বিদেশী মুদ্রা নিয়ে আসেন। সরবরাহের তুলনায় চাহিদা কম হওয়ায় ডলারের দর নিম্নমুখী।’
ভারত থেকে আসা ডলারে দেশের কার্ব মার্কেট নিয়ন্ত্রিত হওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে ইসমাইল হক বলেন, ‘ভারত সবসময়ই ডলারের বড় বাজার। দেশের তিন পাশেই ভারতের সীমান্ত। সেখান থেকে অন্যান্য পণ্যের মতো ডলার আসার পথ বন্ধ করা খুবই কঠিন। কার্ব মার্কেটে সরবরাহ বাড়ার ক্ষেত্রে ভারত থেকে আসা ডলারের ভূমিকা থাকতে পারে।’
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, খুচরা বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকের ভূমিকা রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেতৃস্থানীয় একজন কর্মকর্তা জানান, গত বছরের এ সময়ে দেশের ব্যাংকগুলোর হাতে নগদে বিক্রির মতো ডলার ছিল ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন। কিন্তু বর্তমানে ব্যাংকগুলোর হাতে নগদ বিক্রির উপযোগী ৩৫ মিলিয়ন ডলার রয়েছে। বিদেশগামী মানুষ চাইলে ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে পারছেন। এ কারণে কার্ব মার্কেটে ডলারের দর পড়ে গেছে। আবার ঈদুল আজহা উপলক্ষে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী দেশে ফিরছেন। তাদের সঙ্গে করে নিয়ে আসা বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। খুচরা বাজারে ডলারের দর কমে যাওয়ার পেছনে এটিরও ভূমিকা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল দিন শেষে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ছিল প্রায় ৩১ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর কাছে রিজার্ভ থেকে সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে। তবে গত সপ্তাহে বাজার থেকে কিছু ডলার কিনে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণপ্রাপ্তির শর্ত পূরণের জন্য নিট রিজার্ভের পরিমাণ বাড়ানোর উদ্যোগের অংশ হিসেবে বাজার থেকে এ ডলার কেনা হয়েছে।
এদিকে ডলার সংকটসহ বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে আজ (সোমবার) বৈঠকে বসছে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যাংকগুলোর সংগঠন ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)। বৈঠক থেকে সংগঠন দুটির নেতারা রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের ডলারের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেবেন বলে জানা গেছে।
হাছান আদনান