কিছু কথা না বললেই নয় আমরা একান্নভূক্ত পরিবারের বসবাস করতাম। আজও করছি আগামীতেও একত্রে সবাই মিলে বসবাস করব ইন্শাল্লাহ। আমাদের আব্বা-আম্মা খুব সাদা মনের মানুষ ছিলেন। দু’জনই ২০০০ সালে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আল্লাহ্ তায়ালা ওনাদেরকে জান্নাতবাসী করুন, আল্লাহর দরবারে এই প্রার্থনা সব সময় কামনা করছি। আমার আব্বা সরকারি চাকুরী করতেন। চাকুরি থেকে অবসরে আসার পর চাঁদপুরবাসীর কথা চিন্তা করে চাঁদপুরে জন্য প্রথম মুখপাত্র সরকারি ভাবে সাপ্তাহিক চাঁদপুর নামে একটি পত্রিকা চালু করলেন। তার সাথে একটি ছাপাখানাও চালু করলেন যার নাম দেওয়া হলো মেসার্স আনোয়ারা প্রিন্টার্স অর্থাৎ আমার আম্মার নামে।
সাপ্তাহিক চাঁদপুরের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসাবে আব্বা নিজেই দাযয়িত্ব পালন করলেন মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। তিনি সবসময় সম্পাদকীয় কলাম লিখতেন। তাছাড়া সাহিত্য অঙ্গনের পাতায় লেখালেখি করতেন আর আমার বড় দুই ভাই মিলন ভাই ও জীবন ভাই। আমি সংবাদ সংগ্রহণের কাজ করতাম। এভাবেই ১৯৮৫ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে সৃজনশীল একটি পত্রিকার চাঁদপুরের সুধিগনদের মনের মনি কোঠায় ঠাঁই করে নিয়েছিল আমাদের সাপ্তাহিক চাঁদপুর।
২০০৩ সালের পর আমরা আমাদের সাপ্তাহিক চাঁদপুর পত্রিকাটি আর চালাতে পারি নাই বিভিন্ন কারণে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আর্থিক সংকটাপন্ন অবস্থা। আমরা ছিলাম ছয় ভাই দুই বোন। আমরা ছোটরা ভাইদেরকে ডাক নাম ধরেই ভাইয়া বলে ডাকতাম। বড় ভাইকে কখন বড় ভাই বলে ডাকা হত না। নাম নিয়ে ভাইয়া বলে ডাকতাম। যেমন আমার বড় ভাইয়ার নাম ছিল জাকারিয়া মিলন আমরা ছোটরা মিলন ভাই বলে ডাকতাম। মিলন ভাই আমাদের মাঝ থেকে ২০০৬ সালে চির বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। আল্লাহ্ মিলন ভাইকে জান্নাতবাসী দান করুন এই দোয়া কামনা করি, মহান আল্লাহর দরবারে সব সময়।
মিলন ভাই ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র স্টাফ চিপ রিপোর্টার ও ক্রাইম রিপোর্টার। ক্রাইম রিপোর্টার এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বরাবর ক্রাইম রিপোর্ট লিখতেন আর জাকারিয়া মিলন নাম দিয়ে ফিচার টাইপ নিউজ করতেন বেশীর ভাগ সময়। তার কয়েক বছর পর ২০১৭ সালে আমার বড় বোন যার নাম ফরিদা ইয়াসিমিন ঝর্না যাকে ঝর্না আপা বলে ডাকতাম তিনিও চলে গেলেন ওপারে। আল্লাহ্ ঝর্না আপাকে জান্নাত বাসী করুন পরম করুনাময়ের কাছে এই প্রার্থনা করি সমসময়।
এরপর এ বছরের প্রথম মাসেই আমার প্রান প্রিয় আরেক ভাই যার নাম ইয়াহিয়া কিরণ যাকে কিরণ ভাই বলে ডাকতাম আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আল্লাহ্ তাঁকেও জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুক, আল্লাহর দরবারে এই কামনা সবসময় করি।
এটাই পৃথিবীর নিয়ম এক এক করে এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে সবাইকে চলে যেতে হবে। কিন্তু কিছু ব্যক্তির মায়া ভূলার মত নয় যে মানুষেটা ডাক্তারের কাছে যেতে চায়নি, কিছুটা মনের জোর খাটিয়ে নেয়া হল ডাক্তার এর কাছে সুস্থ্য হয়ে ফিরে আসবেন বাসায় অথচ তিনি ফিরে এলেন ঠিকই কিন্তু মৃত লাশ হয়ে। এটা কখনও কোন দিনই মেনে নেওয়ার মত নয়।
আমার যে ভাই চাঁদপুরবাসীর এত প্রাণ প্রিয় একজন মহৎ সত্যবাদী ছিলেন, তাঁর প্রতিটি কর্মে প্রতিটি কাজে চাঁদপুরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে চিহ্ন রেখে গেছেন। আমার জানামতে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কোন মানুষই তাকে ভুলার কথা নয়। যার স্মরণে স্মরণ সভায় প্রত্যেক ব্যক্তির চোখের পানি ঝড়ে পড়েছে। কেউ কেউ বুক পেটে জোরে চিৎকার দিয়ে কান্নাও করেছেন। সত্যিই আমরা আমাদের এই কিরণ ভাইকে চিনতে পারিনি কখনো। সবাইকে সব সময় হাঁসিয়ে গেছেন। নিজে যে কিভাবে ভিতরে ভিতরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছেন কাউকে কখন কিছু বলেননি। এতই মনের মাঝে কষ্ট, ব্যাথা অনুভব করতেন কারো কাছে কিছুই বলতেন না। নিরবে নিভৃতে সব ব্যাথা সহ্য করে যেতেন। সব সময় সবাইকে হাসিয়ে রাখতেন। নিজের বুকের চাপা ব্যাথাটা কাউকে বুঝতে দিতেন না। আমাদের পরিবারের প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানে আমরা সবাই যখন একত্রিত হতাম সবাইকে খুব হাসি আনন্দের মাঝে রাখতেন তিনি। ওনার কথায় বাসার এমন কেউ নাই যে, হাসত না। সবাই খুব আনন্দ করত এবং সবাইকে আনন্দ দিয়ে পুরো বাসা মাতিয়ে রাখতেন। আসলে উনার কথার মাঝেই সবাই আনন্দ পেত, আর তখনই সবাই মজা পেয়ে হাসতে হাসতে আনন্দে মুখরিত হয়ে যেত পুরো বাসা।
আমার এই কিরণ ভাইয়ের অভাব আমরা কেউই পূরণ করতে পারবো না। ভাই আমার খুবই নরম মনের মানুষ ছিলেন। খুব ভেবে চিন্তে কথা বলতেন। খুব উচ্চ স্বরে কখনো কথা বলতেন না। গত ২৮ জানুয়ারি রাত ১:১৫ মিনিটের সময় যখন আমার মেজা ভাবী অর্থাৎ মিতু ভাবী আমায় মোবাইল করে বললেন, রিপন তোমার ভাই কিরন তো আর নেই। তাৎক্ষনিক ঘুমাচ্ছন্ন অবস্থায় বিছানায় চিৎকার দিয়ে উঠে পড়ি এবং ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন বলি। আর অঝরে কান্না করতে থাকি। মনে মনে বলতে থাকি এ কি হয়ে গেলে কিরণ ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। ফজরের নামাজের আগেই বাসায় পৌঁছলাম আমার কর্মস্থল থেকে গিয়ে দেখলাম, বাসার উঠানে কিরণ ভাইয়ের মুখ খানা দেখতে পেলাম। মনে হলো শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরেই হয়তো ঘুম থেকে উঠবেন। মনে হয়নি একটা প্রাণহীন মানুষ শুয়ে আছে। কিরণ ভাইয়াকে যখন গোসল করিয়ে খাটিয়ায় শোয়ালেন তখন মনে হলো এই তো কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘুম থেকে জেগে উঠবেন। সদা হাস্যজ্জল একটি মানুষ ভাইয়াকে বার বার এ পাশ ও পাশ থেকে দেখছিলাম তরতাজা একজন মানুষ। বুঝাই যাচ্ছিলনা যে এ পৃথিবীর মায়া ছেড়ে ওপারে চলে গেছেন। আসলে ভালো মানুষ গুলো বেশী দিন চিরস্থায়ী হয় না। এরা এভাবেই কাউকে কষ্ট না দিয়ে নিরবে নিভৃতে চলে যায়।
আমার সেজো ভাই ইয়াহিয়া কিরণ যার নামের পাশে এখন মরহুম ইয়াহিয়া কিরণ লাগাতে হবে। যিনি চিরদিনের জন্যই চলে গেছেন আর ফিরে পাবো না যে ভাইকে, আর কিরণ ভাই বলে ডাকতে পারবো না। উনার একটা স্বভাব ছিলো, কিরণ ভাইয়া বলে ডাক দিলেই বলতেন, কিরে রিপণ কখন আসছিস, কেমন আসছিস। খুব নরম সুরে মায়াবী কন্ঠে বলতেন। কিরণ ভাইয়ের সেই মায়াবী কন্ঠস্বর আর শুনতে পারবো না। নিজ মনকে আর মানাতে পারছি না। যার কারনে গত কয়েকদিন ধরে ভাইয়ার সংবাদ সম্বলিত সকল নিউজ পেপারের নিউজ গুলো নিয়ে ভাইয়ার স্মৃতি অম্লান করে ধরে রাখতে একটি স্মৃতির এলবাম তৈরি করলাম আমার কিরণ ভাইয়ার প্রতি ছোট ভাইয়ের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। সবশেষে এই টুকুই বলতে চাই, কিরণ ভাইয়া আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন। যদিও ক্ষমারযোগ্য নই, তবুও ছোট ভাই হিসেবে অনেক সময় ভুল করে আপনার মনে যদি কোন কষ্ট দিয়ে থাকি, যদি কোন আঘাত দিয়ে থাকি আমার মনের অজান্তে, কারণে অকারণে আপনার মনের মাঝে কোন কষ্ট বা ব্যাথা দিয়ে থাকি, আপনি মাফ করে দিয়েন ও ক্ষমা করে দিয়েন। আল্লাহ্ আপনাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুক। এই দোয়া সব সময় কামনা করছি। আল্লাহ্ হাফেজ। আমিন।
আপনার ছোট ভাই
গোলাম রহমান জিলানী (রিপন)