ভারত যেভাবে চাইছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেভাবেই কাজ করছেন বলে মন্তব্য করেছে প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট। সাময়িকীটি বলছে, নিজ দেশের বিরোধী দলগুলোকে চিড়েচেপ্টা করতে যা যা প্রয়োজন, এর সবই করছে বাংলাদেশের সরকার। যা গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এক অশুভ সংকেত। গতকাল শুক্রবার সাময়িকীর অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত ‘ক্রাইম অ্যান্ড পলিটিকস ইন বাংলাদেশ, বাং বাং ক্লাব’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়। আজ শনিবার সাময়িকীটির প্রিন্ট সংস্করণেও প্রতিবেদনটি প্রকাশ হওয়ার কথা রয়েছে। মূলত ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায়কে কেন্দ্র করেই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অস্ত্র পেঁৗছানোর ১০ বছর পর শাস্তি দেওয়া হলো অভিযুক্তদের। ২০০৪ সালের এপ্রিলে চট্টগ্রামের বন্দর থেকে খালাসের সময় পুলিশ বিপুল পরিমাণ অস্ত্রবোঝাই একটি চালান আটক করেছিল। চালানটিতে রাইফেল, সাইলেন্সারসহ সাবমেশিনগান, ২৫ হাজার হ্যান্ড গ্রেনেডসহ প্রায় পাঁচ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ছিল। ধারণা করা হয়, চীনে তৈরি এসব অস্ত্র পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের সহায়তায় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অশান্ত আসাম রাজ্যে বিদ্রোহের জন্য (উলফার কাছে) পাঠানো হচ্ছিল।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ঘটনার পর বেশ কয়েক বছর মামলাটি থমকে ছিল। অস্ত্রের চালানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদেরও তখন চিহ্নিত করা হয়নি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া এ ঘটনায় তখন খুব একটা আগ্রহ দেখাননি। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পরই ২০০৯ সালে মামলাটির বিচারকাজ গুরুত্ব দিয়ে শুরু করে। এ ঘটনার মামলায় গত ৩০ জানুয়ারি আদালত ১৪ জন আসামিকে ফাঁসির রায় দেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের বেশির ভাগই বিরোধী দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা।
ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, উচ্চ আদালত যদি এই রায় বহাল রাখেন তবে এর রাজনৈতিক ও আইনি গুরুত্ব বিশাল। এতে খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানও বিপদে পড়তে পারেন। বর্তমানে লন্ডনে বাস করা তারেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসংক্রান্ত বেশ কয়েকটি মামলা থাকলেও দলের পরবর্তী নেতা হিসেবে তাঁকে অনেকেই মান্য করেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন তারেকের তোষামোদকারী বিএনপিদলীয় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর। এই সপ্তাহেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাঁর সরকার প্রমাণ করবে যে তারেক রহমান ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালানের বিষয়ে সব কিছু জানতেন।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বাকি আসামিদের মধ্যে রয়েছেন দেশটির সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক প্রধান, বাংলাদেশি গোয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন একজন শীর্ষ কর্মকর্তা, আসামের এক বিদ্রোহী পলাতক নেতা, যিনি একই সঙ্গে ভারত সরকারের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকাভুক্ত। তবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের তালিকায় রাজনৈতিক দিক থেকে উল্লেখযোগ্য হলেন জামায়াতে ইসলামীর নেতা মতিউর রহমান নিজামী, যাঁর দল বিএনপির সঙ্গে জোটে রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে সহায়তা করা ও যুদ্ধাপরাধের মামলায়ও পৃথক আদালতে বিচার চলছে। ধারণা করা হচ্ছে, সেখানেও তাঁর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হতে পারে।
ইকোনমিস্ট বলছে, অস্ত্র মামলার রায়ের প্রতিবাদে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে জামায়াত। রাজপথের সহিংসতায় পারদর্শী হিসেবে পরিচিতি রয়েছে দলটির, তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তার শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। জামায়াতের অনেক নেতা-কর্মী হয় বন্দি, না হয় গুলিতে মরেছে। জামায়াতের এই অবস্থা দেখে তার সঙ্গী বিএনপিও ভেঙে পড়েছে। দলটি তার সমর্থকদের শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রাজপথে নামাতে পারছে না, হোক তা আদালতের রায় অথবা নির্বাচনের বিরুদ্ধে।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন বেশ খোশমেজাজেই আছেন। বিএনপি ও জামায়াতের বর্জনের মধ্যে অনুষ্ঠিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তাঁর দল আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে। নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে যেসব দাতা এবং পর্যবেক্ষক শঙ্কিত ছিলেন, তাঁরা এখন মনে করছেন যে শেখ হাসিনা পাঁচ বছরই ক্ষমতায় থাকবেন। ব্রিটেন ও আমেরিকার সরকারি সাহায্য সংস্থার অর্থায়নে পরিচালিত একটি জরিপ জানিয়েছে, বিএনপি-জামায়াত অংশ নিলেও নির্বাচনে আওয়ামী লীগই জয়ী হতো। এই জরিপের ফল বর্তমান সরকারকে বেশ সুবিধাজনক স্থানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত এসব ঘটনায় বেশ খুশি। দেশটি শেখ হাসিনা এবং স্পষ্টভাবেই ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগের বিশেষ ঘনিষ্ঠ। জানুয়ারির নির্বাচনেও সমর্থন দিয়েছে ভারত। দেশটির কূটনৈতিক নীতিনির্ধারকরা চাচ্ছেন, বাংলাদেশ যাতে আগের মতো ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঘাঁটিতে পরিণত না হয়। পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশে যাতে ইসলামী চরম পন্থার বিকাশ না হয়, তাও চায় ভারত। দেশটি চায় কাজের সন্ধানে বাংলাদেশিদের অবৈধভাবে প্রবেশ সীমিত রাখতে।
সব শেষে বলা হয়, ভারত সরকারের লক্ষ্যকে সামনে রেখেই কাজ করে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। এর জন্য দেশের বিরোধী দলগুলোকে চিড়েচেপ্টা করতে যা যা প্রয়োজন এর সবই করছে তাঁর সরকার। এটি গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার জন্য এক অশুভ সংকেত। বিরোধী দলের ওপর সরকারি দলের নিপীড়ন এবং আদালত, রাজপথ ও সংসদে বিরোধী দলের কোণঠাসা অবস্থায় প্রতীয়মান হচ্ছে যে দেশটি কিছুদিন ‘শান্ত’ থাকতে পারে।
সুত্রঃ কালের কণ্ঠ ।
শিরোনাম:
মঙ্গলবার , ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ২৯ মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।