
শাহরিয়ার খান কৌশিক ঃ মতলব উত্তর বদরপুর (বেলতলী) গ্রামে সোলেমান লেংটার মাজারে শুরু হয়েছে ৭দিন ব্যাপি ৯৬তম ওরস ও মেলা। ৩১ মার্চ ১৭ চৈত্র উরশ ও মেলা শুরু হয়। এই মেলাকে কেন্দ্রকরে চলছে পাগলের পাগলামি, মাদক বিক্রি, সেবন, জুয়া, ও অশ্লীলতা। মাদক সেবন সেখানে ওপেন সিক্রেট। অনুসন্ধানে জানা যায়, সাত দিন মেলা উপলক্ষে প্রায় কোটি টাকার চাঁদাবাজীর বানিজ্য। মাদক বিক্রি, আস্তানা ভাড়া, মাজারে দান-অনুদানের নামে কোটি কোটি টাকার বানিজ্য হলেও প্রশাসন এ ব্যাপারে নিশ্চুপ।
উরশ ও মেলা সাতদিনের হলেও মাসব্যাপি চলে এর কার্যক্রম।
সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, মাজারের আয়ের কোটি কোটি টাকা যায় কোথায়! জানা যায়, ৭ দিনের এ মেলায় আগত দোকান থেকে অনুপাতে ২ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। মাজারে মানতে দেয়া হচ্ছে গরু, ছাগল, নগদ অর্থ, আগরবাতি ও মোমবাতি। মাজারে প্রতিদিন উঠছে লাখ লাখ টাকা। সবমিলে এখানে বাণিজ্য হচ্ছে কয়েক কোটি টাকা। এ টাকার কোনো রাজস্ব পাচ্ছে না সরকার। এ টাকায় অনেকেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন। সারাবছর এ মাজারটি অর্থ পাওয়ার সেক্টরে পরিণত হয়েছে। এ টাকা ভাগাভাগি নিয়ে সংঘর্ষ ও মামলা হয়েছে। কমিটির কজনকে দেখে মনে হয় মাজারের আয়ের টাকায় তারা ভালোই আছে। সচেতন মহল জানান মাজারের টাকায় মাজার এলাকার কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না। মাজারের টাকা ভাগাভাগি করে খেয়ে ফেলা হয়। অনেকে বলেন, মাজার কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় যে তারা ভাগাভাগি করে খেয়ে ফেলবে। মাজারের অর্থ ও মাজারের উন্নয়ন বিষয়ে সরকারি নজরদারি প্রয়োজন এবং মাজারের সার্বিক ব্যবস্থাপনা সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা উচিত।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারো এখানে শুরুহয়ে গেছে মাদক বিক্রি, সেবন ও অশ্লীলতা। জানা যায়, সকল প্রকার মাদকদ্রব্যই পাওয়া যায় এ মেলায়। নেশাখোরদের দেখলেই মনে হয় মেলা প্রাঙ্গণ যেনো নেশার স্বগ্ররাজ্য ও নিরাপদ স্থান। দলে দলে আস্তানা বানিয়ে সেবন করছে মাদকদ্রব্য। মেলা প্রাঙ্গণের বাতাসে বইছে গাঁজার গন্ধ। লেংটার মেলাকে গাঞ্জিকাসেবীদের মিলনমেলা হিসেবে অনেকেই মন্তব্য করছেন।
সোমবার সকালে মাজার প্রাঙ্গণে মিলাদ ও দোয়ার মাধ্যমে ওরস শরীফের উদ্বোধন করা হয়। মাজার কমিটির সভাপতি সিনিয়র সহকারী সচিব আলহাজ এসএম আবদুর রশিদ ও সাধারণ সম্পাদক আলহাজ এসএম সৈয়দ হোসেন, সহ-সভাপতি আশরাফুল ইসলামসহ এলাকার বিশিষ্টজন, ভক্ত-আশেকানরা উপস্থিত ছিলেন।
সোলেমান লেংটা উপমহাদেশের একজন খ্যাতিমান আউলিয়ার দাবিদার। বাংলা ১২৩০ সালে কুমিল্লা জেলার মেঘনা উপজেলার গোবিনাদপুর ইউনিয়নের আলীপুর গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে শাহ্ সুফি সোলেমান লেংটা জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আলা বক্স ভূঁইয়া। তার জীবনের অধিকাংশ সময়ই কাটিয়েছেন মতলবের বিভিন্ন অঞ্চলে। সোলেমান লেংটা কখনো পোশাক পরিধান করতেন না। তাই তার মাজারটি লেংটার মাজার হিসাবেই পরিচিত।
লেংটা ১৮ বছর বয়সে প্রেম করে বিয়ে করেন। পরে নারায়ণগঞ্জের বক্তাবলির রাধানগরে এক নারীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এখন সেখানে তার আওলাদরা আছে বলে দাবি উঠেছে এবং তারা প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সময় ওরসের ডাক দিচ্ছে।
শাহ্ সুফি সোলেমান লেংটার ফকিরি লাভ সম্পর্কে জানা যায়, ইমাম উদ্দিন মিয়ারা ছিল তিন ভাই। তিন ভাই নৌকা করে ভাদ্র মাসের এক অমাবস্যা রাতে সোনারগাঁয়ে তাদের পীরের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। নৌকার মাঝি ছিলেন সোলেমান শাহ। পথিমধ্যে বৃষ্টি হয়, তিন ভাই আরাম করে নৌকার ভেতর। সোলেমান শাহ ভিজে ভিজে নৌকা চালায় এবং গন্তব্যে হাজির হয়ে যায়।
নির্দিষ্ট সময় পীর আসে এবং এ দৃশ্য দেখে রাগ হয়। পীর তখন তিন ভাইকে উলঙ্গ হয়ে আসতে বলে। তিন ভাই চিন্তায় পড়ে যায়। আপন মায়ের পেটের তিন ভাই কীভাবে উলঙ্গ হবে একে অপরের সামনে আসবে। পীর সাহেব মাঝি সোলেমানকে উদ্দেশ্য করে কাছে আসতে বলে। সোলেমান কাছে যায়। পীর তাকে হা করতে বলেন এবং মুখে ফুঁক দেয়। সেখান থেকেই সোলেমান লেংটা হয়ে বাড়ি ফিরে।
সোলেমান লেংটার অনেক অলৌকিক ঘটনা রয়েছে। তার মধ্যে সোলেমান লেংটা কালিপুর রমিজ উদ্দিন প্রধানীয়ার বাড়িতে যান। দেখেন নারীরা নদী থেকে ঘট পুড়িয়ে ঘর, উঠান লেপছে। তিনি তাদের পানি আনার কষ্ট দেখে তাদের চোখ বন্ধ করতে বলেন। তারা চোখ বন্ধ করলে লেংটা তার নফস টেনে প্রায় ২/৩ হাত লম্বা করে পুরো উঠান পানিতে ভিজিয়ে দেয়। এ ঘটনা তিনি বিভিন্ন গ্রামে করেছেন।
এক সময় মানুষ হজে যেত জাহাজে কিংবা পায়ে হেঁটে। অনেক দিন লাগতো, হজে যাওয়ার সময় অনেকেই লেংটাকে বদরপুর দেখে গেছে, হজ পালন করার সময় অনেকেই তাকে কাবা শরীফে দেখেছেন নামাজ আদায় করতে। এমন অসংখ্য অলৌকিক ঘটনা লোকমুখে প্রচলিত।
সোলেমান লেংটার বোনের বাড়ি বদরপুরে মাজারটি অবস্থিত। ১৩২৫ বাংলা সনের ১৭ চৈত্র শাহ্ সুফি সোলেমান লেংটা তার বোনের বাড়ি বদরপুর গ্রামে মৃত্যুবরণ করলে সেখানে কবর দিয়ে মাজার স্থাপন করা হয়। প্রতি বছর চৈত্র মাসের ১৭ তারিখে তার মৃত্যুবার্ষিকী উপলে ৭ দিনব্যাপী ওরশের আয়োজন করা হয় এবং এই উরশকে ঘিরেই মেলা বসে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ মফিজুল ইসলাম জানান, কোনো প্রকার অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া হবে না। লটারী, মৃত্যুফাঁদ, পুতুলনাচের অনুমোদন নেই। যানবাহন থেকে টাকা তোলার সময় একজনকে আটক করা হয়েছে।
মতলব উত্তর থানার অফিসার ইনচার্জ সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জানান, মেলায় সকল প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত আইনশংঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। মাদকবিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকবে।
