মানুষ ঠকানো খুব সহজ! বিশেষ করে ধর্ম ও সংস্কারকে পুঁজি করে যারা ব্যবসা করে তাদের জন্য এই কথাটা খুবই সত্য। এরা বিনা পুঁজিতে রাতারাতি কোটিপতি বনে যান।
এদের হাতের মুঠোয় আলাদিনের দৈত্য, জিন-পরী, মঙ্গল-অমঙ্গলের অশরীরি আত্মা! এরা নক্ষত্রের অবস্থান দেখে বলে দিতে পারেন ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ, বলে দিতে পারেন কারো নিয়তির উপর গ্রহের প্রভাব। আবার শনির আছর ছাড়াইতে হলে তাদেরই শরণাপন্ন হতে হবে। তারা জানেন বিভিন্ন পাথরের গুণাগুণ। বিশল্যকরণীর মতো ক্ষমতাসম্পন্ন অষ্টধাতুর রহস্য!
তাদের পরিচয় কেউ গুরু, জ্যোতিষ সম্রাট, কেউবা মুশকিলে আসান। নামের আগে পিছে নানা বিশেষণ।
তবে তাদের আসল উদ্দেশ্য মানুষ ঠকানো। এটিই তাদের পেশা। এসব ভণ্ড প্রতারকরা রাতারাতি গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। আলিশান বাড়ি, অত্যাধুনিক গাড়ি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে একাধিকবার গ্রেপ্তার পর কিছুদিন জেল খেটে আবারও তারা জায়গা পরিবর্তন করে এই প্রতারণার ব্যবসা করে। তেমনি একজন প্রতারক জ্যোতিষরাজ লিটন দেওয়ান চিশতী ওরফে লিটন দেওয়ান ওরফে পাগলা লিটন।
শিক্ষাগত কোনো যোগ্যতা না থাকলেও তিনি নিজেকে জ্যোতিষরাজ হিসেবে প্রচার করে চলেছেন। ভণ্ড আধ্যাত্মিক সাধক লিটন দেওয়ান তার ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলম ও সদস্য মো. শামিমকে গত ২০০৮ সালের ১৫ আগস্ট র্যাব-৩ গ্রেপ্তার করে। ভণ্ড ও প্রতারণার অভিযোগে এই তিনজনের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা হয়। মামলায় তারা দীর্ঘদিন জেল খেটে আবারও আগের ব্যবসা শুরু করেন।
শেষ দর্শন আজমেরী জেমস হাউজ দোকান নং ৭০, ৭১ ব্লক ডি, লেবেল-১ বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে নিজে বসে হাত দেখে পাথর বিক্রি করেন।
সূত্র জানায়, বসুন্ধরা সিটিতে ২০০৯ সাল থেকে আলিশান আস্তানা তৈরি করেছেন ভণ্ড লিটন দেওয়ান। নিজেকে তিনি জ্যোতিষরাজ ও পীর কামেল দাবি করেন। পাথর বিক্রি করে কয়েক কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। চড়েন পাজেরো গাড়িতে। তার স্লোগান ‘আর হতাশা নয়, সফলতার জন্য আসুন’।
তার দাবি যে কোনো মুশকিলের আসান তিনি করে দিতে পারেন মুহূর্তেই। এ জন্য রাশি গণনা করে পাথর দেন। এছাড়া তিনি মন্ত্রের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করে থাকেন।
১৯৯০ সাল থেকে এ প্রতারণার ব্যবসায় লিটন দেওয়ান। কোনো সার্টিফিকেট না থাকলেও তিনি জ্যোতিষরাজ। তার আস্তানায় গেলে দেখা যায়, অনেক মন্ত্রী, এমপির সঙ্গে তার ছবি দেয়ালে টাঙানো। অনেকের কাছ থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন। তার দাবি, মন্ত্রী, এমপি থেকে শুরু করে অনেক ভিআইপি তার ক্লায়েন্ট। যে কোনো মানুষের মুখ দেখেই তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারেন।
লিটন দেওয়ানের সঙ্গে সাক্ষাতের ভিজিট ৫শ টাকা। তার দাবি, ৫শ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন দামে পাথর বিক্রি করেন তিনি। বসুন্ধরা সিটিতে বর্তমান ২৪টি ভাগ্য গণনার দোকান রয়েছে। তার মধ্যে প্রথম সারির একটি দোকান ‘শেষ দর্শন আজমেরী জেমস হাউজ’।
দুই সহযোগীসহ র্যাবের হাতে আটক লিটন দেওয়ান {focus_keyword} মানুষ ঠকিয়ে কোটিপতি Liton
ভণ্ড এ প্রতারকের সঙ্গে এ প্রতিবেদক দেখা করতে গেলে ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলম ৫শ টাকা দাবি করলেন। এটা প্রথম ফি। তবে সাংবাদিক পরিচয় দেয়ায় বিনা ফিতে ঢুকতে দিলেন। ভেতরে ঢুকেই দেখা গেলো তার চারদিকে ক্রেস্ট আর মন্ত্রী, এমপি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে গ্রুপ ছবি। এগুলো দেখলে তাকে সন্দেহ করার কঠিন। সাংবাদিক পরিচয় তিনি নিজেকে সত্য স্বচ্ছ দাবি করে ভাগ্য গণনার প্রতারক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে লিখতে অনুরোধ করেন। তার ছবি তুলতে চাইলে বাধা দিলেন। বললেন, তার ছবি সব জায়গাতেই পাওয়া যায়।
দেশে জীবিত সহস্রাধিক পীর নামধারী ব্যক্তির মধ্যে এখন সবচেয়ে প্রভাবশালী লিটন দেওয়ান। তিনি নিজেকে শেষ দর্শনের
জ্যোতিষরাজ এবং বাংলাদেশের দেওয়ানে খাজা দরবার শরিফের বর্তমান গদ্দিনশিন হিসেবে দাবি করে থাকেন।
জানা গেছে, তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে লিটন দেওয়ান এখন কোটিপতি। ঢাকার শান্তিনগর ও কাকরাইলে দুটি বাড়িসহ মোট ১৪টি ফ্ল্যাট এবং ১১টি মাইক্রোবাসসহ একটি প্রাডো গাড়ি আছে তার।
লিটন দেওয়ানের বয়স এখন ৪২ বছর। বিয়েতেও কার্পণ্য করেননি! এরই মধ্যে পাঁচটি বিয়ে করেছেন। বর্তমানে আছে চার স্ত্রী।
লিটন দেওয়ানের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানার বাগবাড়ি গ্রামে। পরের জমিতে চাষাবাদ ও দিনমজুরের কাজ করতেন তিনি। গ্রামের জীর্ণ বসতিতে এখন বিশাল অট্টালিকা বানিয়েছেন। এ অট্টালিকার সামনে বানিয়েছেন মুন্সীগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী কাঠটিনের নজরকাড়া দোতলা ঘর। শানবাঁধানো বিশাল পুকুর। নবাব জমিদারের বাংলোবাড়ির আদলে নির্মিত বাড়িটি।
লিটন দেওয়ানের বড় ভাই জানান, বাড়িটি নির্মাণ করতে খরচ হয়েছে আড়াই কোটি টাকা। সেখানে বানানো হয়েছে দেওয়ান-ই খাজা শেষ দর্শন দরবার শরিফ। বাড়ির সামনে তার বাবার মাজার বানানো হয়েছে। নাম দেয়া হয়েছে, ‘আব্দুস সাত্তার দেওয়ান চিশতির মাজার শরিফ’।
তার সম্পর্কে এলাকাবাসী জানান, খুব দরিদ্র পরিবারের ছেলে লিটন। বাবা ছিলেন ফেরিওয়ালা। ফেরি করে পুরনো কাঁসা-তামার বাসন কেনাবেচা করতেন।
তিন দশক ধরে লিটন দেওয়ান এ প্রতারণার ব্যবসা চালিয়ে গেলেও তিনি এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে। হাজার হাজার মানুষ তার প্রতারণার শিকার হলেও জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দিব্যি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি উপকারী পাথর আমদানির আড়ালে হীরা চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত বলে জানা যায়।
১৯৯০ সালে মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসে নয়াপল্টনে হাতদেখার ব্যবসা শুরু করেন লিটন দেওয়ান। পুলিশের সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত পাঁচবার ডিবি পুলিশ ও র্যাব তাকে গ্রেপ্তার করেছে। হাজার হাজার নিরীহ মানুষ তার প্রতারণার শিকার হয়েও কোনো আইনি সহায়তা পাচ্ছে না।
এ বিষয়ে লিটন দেওয়ানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলামেইলকে বলেন, ‘পুলিশের কাজ পুলিশ করে, আমার কাজ আমি করি। মিডিয়ার কাজ মিডিয়া করবে। আপনি লিখে দেন আমার বিরুদ্ধে, কোনো সমস্যা নেই। আমার ব্যবসা চলবেই।’