শাহাদাৎ হোসেন মালেয়শিয়া থেকে
মালয়েশিয়ায় অবৈধ ভাবে বসবাসকারি বিদেশী শ্রমিকদের বৈধ হওয়ার জন্য ৫ম মেয়াদে বর্ধিত করা বিশেষ ক্ষমার মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২১ জানুয়ারি। অর্থাৎ রবিবার দিবাগত রাত ১২টা ১মিনিট থেকে শুরু হবে অবৈধ অভিবাসীদের ধরতে বিশেষ অভিযান। অবৈধদের ধরতে নারী পূরুষের স্বমন্বয়ে একটি বিশেষ টিম এ অভিযানে নামছে বলে খবর প্রকাশ করেছে মালয়েশিয়ায় সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক গুলো। মালয়েশিয়া সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাতদিয়ে বলা হয়, বাজার, মহা সড়ক, হোটেল মোটেল, রেষ্টুরেন্ট, দোকান এবং জন সাধারণের চলাচল আছে সম্ভাব্য এমন সব জায়গাতেই এই বিশেষ অভিযান পরিচালিত হবে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এই বিশেষ টিম বিভিন্ন জায়গায় ব্লক দিয়ে শ্রমিকদের পারমিট এবং কর্মস্থলের বৈধতা আছে কিনা সেটা যাচাই করবে। অভিবাসী আইন অমান্যকারিদের জেল জরিমানা অথবা উভয় দন্ড দেয়ার ক্ষমতা দিয়ে জেলা পুলিশ বিভাগ, বিভিন্ন পুলিশ ও নিরাপত্তা সংস্থা থেকে কর্মীদের নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এই অভিযানের আওতায় আরোও থাকবে নিরাপত্তাকর্মী এবং গাড়ি চালকরাও। অভিযান চলাকালিন সময়ে পারমিট (বৈধ কাগজ) বর্ণিত পেশা এবং নিজ কর্মস্তল ব্যতীত অন্য জায়গায় কর্মরত শ্রমিকদের অবৈধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এমনকি বাইরে কাজ করতে দেয়ার অপরাধে মালিককেও জরিমানা করা হবে বলে ভিবিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
মালয়েশিয়ায় যেখানে দিন দিন অবকাঠামো গত উন্নয় ও শিল্প কারখানা বৃদ্ধির ফলে শ্রমিকদের কর্মস্থান সৃষ্টি হচ্ছে এবং আরো বিদেশী শ্রমিক নিতে চাচ্ছে সেখানে কেন অবৈধ শ্রমিক বিতাড়িত করবে? বিভিন্ন সূত্রে জানাযায় মালয়েশিয়া বর্তমানে তার অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা নিয়ে খুব বেশী চিন্তিত। তাই মালয়েশিয়াতে অবস্থারনত বাংলাদেশী সহ বিদেশী শ্রমিকদের ডাটাবেজ তাদের সফটওয়াওে সংরক্ষিত করার উদ্যোগ আগে থেকেই নেয়া। এজন্য ২০১১সালের আগষ্টে ৬পি প্রোগ্রামের আওতাভুক্ত ফিঙ্গারপ্রিন্ট করে নাম রেজিষ্ট্রেশন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অনেকে নাম রেজিষ্ট্রেশন করলেও দালাল বা এজেন্টের পিছু ছাড়েনি যার ফলে তারা বার বার প্রতারিত হয়ে আসছে। এখন এই অভিবাসী শ্রমিকদের সামনে মহা বিপদ। এছাড়া স্থানীয় যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেওয়াও মালয়েশিয়া সরকারের অন্যতম উদ্দেশ্য। সরকার মনে করছে মালিকরা সস্তায় অবৈধ বিদেশী শ্রমিক পাবার ফলে স্থানীয়দের মধ্যে বেকারত্ব বাড়ছে এবং বঞ্চিত হচ্ছে বিভিন্ন কর্মসুযোগ থেকে। সরকার এই মুহুর্তে মালয়েশিয়া থেকে অবৈধ বিদেশী শ্রমিক ছাটাই করা ছাড়া আর কোন বিকল্প পথ দেখছে না।
এদিকে সাড়াঁশি অভিযান শুরু হওয়ার আগেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অবৈধ অভিবাসীরা। গত কয়েক বছরের মধ্যে মালয়েশিয়ায় এটিই সবচেয়ে বড় অবৈধ অভিবাসী বিরোধী অভিযান হতে পারে বলে ধারনা করছেন অনেকে। মালয়েশিয়ায় বসবাসরত শ্রমিকরা এই অভিযানে আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এ বিশেষ অভিযানের শিকার হয়ে লক্ষাধিক অবৈধ বাংলাদেশী কর্মীকে খালি হাতে দেশে ফিরতে হবে। এসব অবৈধ প্রবসী বাংলাদেশী কর্মীদের বৈধতা দিতে কুয়ালালামপুরস্থ’ বাংলাদেশ হাই কমিশন কর্তৃপক্ষ প্রাণপন চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ দিন পর জি টু জি’র মাধ্যমে সরকার হাতে গোনা কিছু কৃষি কর্মীকে মালয়েশিয়ায় পাঠালেও নিবন্ধনকৃত ১৪ লাখ ৫০ হাজার কর্মীর ভাগ্যে স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় গমনের সুযোগ হচ্ছে না।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী মালয়েশিয়ায় জি টু জি প্রক্রিয়া আশানুরূপ কর্মী পাঠাতে ব্যর্থ হয়ে নিবন্ধনকৃত ১৪ লাখ ৫০ হাজার কর্মীর ডাটাবেজ থেকে বিদেশে কর্মী পাঠাতে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর উপর আদেশ জারি করে। এদিকে গত বছরে মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণের জন্য তৈরি সরকারি ডাটাবেজ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মী প্রেরণ সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের আদেশ স্থগিত করে রুল নিশি জারি করেন মহামান্য হাইকোর্ট। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে সরকার মালয়েশিয়ায় কৃষি শ্রমিক প্রেরণের উদ্দেশ্যে সারা দেশ থেকে প্রায় ১৪ লাখ ৫০ হাজার কর্মীর নিবন্ধন নিয়ে ডাটাবেজ তৈরি করেছিল। পরবর্তীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও জনশক্তি রপ্তানিতে মালয়েশিয়ার জন্য তৈরি এই ডাটাবেজ থেকে কর্মী নির্বাচনের জন্য মন্ত্রণালয় দুটি আদেশ (সংযুক্তি) জারি করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর বায়রা এই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করলে বিশ্বের বিভিন্নদেশে জনশক্তি রপ্তানিতে ‘মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণের সরকারি ডাটাবেজ’ থেকে কর্মী গ্রহণের বাধ্যবাধকতা সংক্রান্ত প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এই আদেশসমুহ স্থগিত করে রুল নিশি জারি করে হাইকোর্ট। ২০০৮ সনের ১০ মার্চ থেকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশী কর্মী নিয়োগ বন্ধ ছিল। কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের তৎকালিন লেবার কাউন্সিলর তালাত মাহমুদ খানের একটি বির্তকিত বক্তব্যের কারণে মালয়েশিয়ার সরকার বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানীর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ওই সময়ে ৫৫ হাজার কলিং ভিসা বাতিল হয়ে যায়। এসব কলিং ভিসার জন্য ব্যয়কৃত কয়েক শত কোটি টাকা মালয়েশিয়ায় পড়ে রয়েছে যা আজও পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
সরকারের সর্বোচ্চ কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় ২০১২ সলে মালয়েশিয়ায় জি টু জি পদ্ধতিতে জনশক্তি রফতানি’র লক্ষ্যে উভয় দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। মালয়েশিয়ার তৎকালিন হিউম্যান রির্সোস মন্ত্রী দাতো সুব্রামানিয়াম ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন উভয় দেশের পক্ষে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন। বহু ডাকঢোল পিটিয়ে এ যাবৎ মালয়েশিয়ায় জি টু জি’র মাধ্যমে স্বল্প ব্যয়ে গত বছরের ২৫ এপ্রিল ১শ ৯৮ জন এবং সম্প্রতি আরো ১শ ৪৭ জন কর্মী কে মালয়েশিয়ায় পাঠানো সম্ভব হয়েছে। মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগে বেসরকারী রিক্রুটিং এজেন্সীগুলোকে বঞ্চিত করে সরকার এককভাবে মালয়েশিয়া কর্মী প্রেরণের লক্ষ্যে সারাদেশ থেকে প্রায় ১৪ লাখ ৫০ হাজার কর্মীকে নিবন্ধনের আওতায় আনে। মালয়েশিয়ায় জি টু জি’র মাধ্যমে কর্মী বাছাইসহ বিদেশে দফায় দফায় সফরের জন্য বিদেশগামী কর্মীদের কল্যাণ তহবিলের জমাকৃত প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এনিয়ে খোঁদ বিএমইটিতে চাপা অসন্তোষ বিরাজ করছে। ২০১১ সনের ১৫ জুন থেকে ৩১ আগষ্ট পর্যন্ত মালয়েশিয়া সরকারের কর্মসূচির আওতায় ২ লাখ ৬৮ হাজার ৮শ ৮৩জন অবৈধ বাংলাদেশী কর্মী বৈধতা লাভের সুযোগ পায়। মালয়েশিয়ায় তৎকালিন ৬-পি কর্মসূচি সম্পন্ন হবার পরেও ওই দেশে লক্ষাধিক বাংলাদেশী অবৈধ থেকে যায়। মালয়েশিয়ায় বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার অবৈধ শ্রমিক রয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ হাইকমিশন। ওই অবৈধ শ্রমিকদের বৈধতা দিতে ২১ জানুয়ারি ২০১৪ পর্যন্ত বৈধ হওয়ার সময় বেধে দিয়েছিল মালয় সরকার । নির্ধারিত সময় পার হওয়াতে এই সাড়াষি অবিযান শুরু করছে দেশের ইমিগ্রেশন বিভাগ।
এই অভিযানে শুধু শ্রমিকদের বিপদই নয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিপদের সংকেত দেওয়া হয়েছে মালিকদেরকেও। মন্ত্রণালয় থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে কোন কোম্পানী যেন অবৈধ শ্রমিক অথবা অন্য কোম্পানীর শ্রমিক ব্যবহার না করে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট কাগজের কার্যক্ষমতা শেষ হয়ে যাচ্ছে ২১জানুয়ারী। ফিঙ্গারপ্রিন্টের কাগজ দেখিয়ে অথবা প্রতারণার অজুহাতে আর গ্রেফতার এড়ানো যাবেনা। কোন মালিক অবৈধ শ্রমিক নিয়োগ দিলে স্থানীয় আইনে ১০হাজার মালয় রিঙ্গিত সর্বোচ্চ জরিমানা গুনতে হবে। এতে কপাল পুড়ছে বর্তমানে মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত প্রায় ৩লক্ষাধীক শ্রমিকের। যারা ইতিমধ্যে স্টুডেন্ট, ট্যুরিস্ট সহ বিভিন্ন অবৈধ পন্থায় মালয়েশিয়ায় এসে অবৈধ ভাবে কাজ করছে।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে মালয়েশিয়ার আইনে অনুপ্রবেশ কারীদের জন্য জেল, জরিমানা ও বেত্রাঘাত হাতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশ সহ অন্যান্য দেশ থেকে সগর পথে আসা যাদের কোন কাগজ পত্র ও পিঙ্গারপ্রিন্ট নেই এই বেত্রাঘাতের এই কঠিন শাস্তি তাদেরকেই গ্রহন করতে হবে। তবে যারা বৈধ ভাবে এসে বিভিন্ন কারণে অবৈধ হয়েছে তাদের জন্য এই বেত্রাঘাত প্রযোজ্য নয়।
মালয়েশিয়া বাংলাদেশী ব্যবসায়ি সমিতির সভাপতি মো: রাশেদ বাদল জানান, দ্বিপাক্কিক অলোচনার মাধ্যমে বাণিজ্যিক ও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশী শ্রমিকদের ব্যপারে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয় । মালয়েশিয়ার প্রধান মন্ত্রী নাজিব রাজাকের আশ্বাসের পরিপ্রেক্কিতে অসম্পূর্ণ ¤্রমিকদের বৈধ করে নিতে আগামি ২১ জানয়ারি পর্যন্ত সময় বেধে দেয়া হয়েছে। তারই ফলশ্রুতিতে কাজ অব্যাহত রয়েছে। কারণ আমরা চাইনা প্রবাসে একজন শ্রমিক অবৈধ থাকুক। এদিকে ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে মালয়েশিয়ার প্রধান মন্ত্রী বাংলাদেশ সফর কালে- প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশী শ্রমিকদের বৈধতা দিতে আলেচনা করেন । আলোচনার ফলশ্রুতিতে ২০১৪ সালের ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত বৈধ হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। তার পরেও যদি থেকে যায় সে দেশের সরকারের আর কিছু করার থাকবেনা। বৈধতার ব্যপারে হাই কমিশনে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ হাই কমিশনার এ কে এম আতিকুর রহমান বলেন, যারা ৬পি কর্মসূচীর আওতায় বৈধতা হয়নি তাদেরকে বৈধতা দেয়ার জন্য মালয় সরকারকে অনুরোধ করেছেন বাংলাদেশ সরকার। তবে যাদের বৈধ কাগজ পত্র আছে তাদেরকে হয়রানি না করার জন্যও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। অবৈধ বাংলাদেশীদের বৈধ করার জন্য আমরা ও প্রাণ পণ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। এদিকে ২১ জানুয়ারির পর যদি কেউ অবৈধ থেকে যায় তাদেরকে দেশে পাঠাতে ৩হাজার ১শ মালয় রিংঙ্গতি জরিমানা এবং ৪৫০ রিংঙ্গীত এয়ার টিকেট লাগে তা অনেকের পক্ষে সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্টদের মতে এসকল শ্রমিককে আরো সহজ উপায়ে দেশে পাঠানোর জন্য দু’দেশের মধ্যে সমজোতা পৌঁছানো প্রয়োজন