প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সংসার সামলানোর পাশাপাশি জাতির পিতার অনেক সময়োচিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বঙ্গমাতার পরামর্শ আন্দোলন-সংগ্রামে গতির সঞ্চার করেছিল। তিনি গতকাল রবিবার বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ৯১তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন এবং বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব পদক-২০২১ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত মূল অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার মা একদিকে সংসার সামলেছেন, অন্যদিকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো সঠিক সময়ে যাতে হয় তার ব্যবস্থা করেছেন। আন্দোলন-সংগ্রামে এই দলকে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগ যেন সব মসয় সঠিক পথে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে যাতে চলতে পারে, সেই নির্দেশনা দিয়েছেন।’
সব তথ্য বাবার কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং জেলখানায় থাকা বাবার কাছ থেকে সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে এসে দলের নেতাকর্মীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মতো কাজগুলো তিনি গোপনে করেছেন। এভাবেই তিনি তাঁর পুরো জীবনটাকে উৎসর্গ করেন আমার বাবা যে আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করেন সেই আদর্শের কাছে, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, কখনো রাজনৈতিক নেতা হতে হবে, রাজনীতি করে কিছু পেতে হবে, সে চিন্তা তাঁর (বঙ্গমাতার) ছিল না। কোনো সম্পদের প্রতিও তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। এভাবেই নিজের জীবনকে তিনি গড়ে তুলেছিলেন।
আর সব শেষে আপনারা দেখেছেন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার মা খুনিদের কাছে নিজের জীবন ভিক্ষা চাননি। তিনি নিজে জীবন দিয়ে গেছেন, বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার সিঁড়িতে পড়ে থাকা মৃতদেহ দেখে সোজা বলে দিয়েছেন, ‘তোমরা ওনাকে মেরেছ, আমাকেও মেরে ফেলো।’ খুনিরা বলেছিল আমাদের সঙ্গে চলেন, ‘তোমাদের সঙ্গে আমি যাব না তোমরা এখানেই আমাকে খুন করো,’ খুনিদের বলে দেন তিনি। ‘ঘাতকের বন্দুক গর্জে উঠেছিল, সেখানেই আমার মাকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে,’ যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘কতটা সাহস একটা মানুষের মনে থাকলে সে মানুষটা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবন ভিক্ষা না নিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারেন। আজকে আমাদের দেশের নারীসমাজ যে একটা জায়গা খুঁজে পেয়েছে, সেখানে আমি মনে করি আমার মায়ের এই কাহিনি শুনলে অনেকেই অনুপ্রেরণা পাবে। শক্তি ও সাহস পাবে দেশের জন্য, জাতির মঙ্গলে কাজ করতে।’
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেছা ইন্দিরার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব সায়েদুল ইসলাম স্বাগত ভাষণ দেন।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে পদক বিজয়ীদের হাতে ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব পদক-২০২১ তুলে দেন।
নারীদের আর্থিক সাহায্য ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বঙ্গমাতার ৯১তম জন্মবার্ষিকীতে দেশের সব জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত সুবিধাভোগীদের তালিকা অনুযায়ী ৬৪ জেলার চার হাজার অসচ্ছল নারীকে সেলাই মেশিন ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দুই হাজার নারীকে দুই হাজার টাকা করে মোট ৪০ লাখ টাকা ও সেলাই মেশিন বিতরণ কার্যক্রমও গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
বঙ্গমাতার জীবন ও কর্মের ওপর অনুষ্ঠানে একটি ভিডিও চিত্র পরিবেশিত হয়।
বঙ্গবন্ধু বাঙালির স্বাধীনতা-সংগ্রামের জন্য তাঁর জীবনটাকে উৎসর্গ করেছিলেন এবং নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা না ভেবে দেশের মানুষের কল্যাণের কথা ভেবেছেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা মায়ের স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, জাতির পিতার পাশে থেকে সব সময় প্রেরণা জুগিয়েছেন তাঁর মা।
তিনি বলেন, ‘আমার মা কখনো সামনে আসেননি, কখনো কোনো মিডিয়ার সামনে যাননি, কখনো নিজের নামটা ফলাতে চাননি। তিনি নীরবে পাশে থেকে প্রতিটি ক্ষেত্রে আমার বাবাকে সহযোগিতা করে গেছেন, সমর্থন দিয়ে গেছেন। এটাই সবচেয়ে বড় ত্যাগ স্বীকার বলে আমি মনে করি।’
প্রধানমন্ত্রী তাঁর মায়ের আন্দোলন-সংগ্রামের গোপন কার্যকর ভূমিকার জন্য তাঁকে একজন গেরিলার সঙ্গে তুলনা করেন এবং বলেন, ‘আমার মা ছিলেন সবচেয়ে বড় গেরিলা।’
তিনি বলেন, ‘একটা গেরিলাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীন হয়েছি। আমি সব সময় বলি, আমার মা ছিলেন সবচেয়ে বড় গেরিলা। অসাধারণ স্মরণশক্তি ছিল তাঁর। তিনি গোপনে গিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে দেখা করতেন, দিকনির্দেশনা দিয়ে আসতেন। আমাদের বাড়িতে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকও হয়েছে। ছয় দফা ছেড়ে অনেক নেতা চলেও গেছেন। আমার মা তখন খুব শক্ত ছিলেন ছয় দফার পক্ষে।’
ছয় দফা আন্দোলনেও বঙ্গমাতা বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে তিনি (বঙ্গমাতা) যে কতটা সচেতন ছিলেন, সেটা তাঁর দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। সেই সময় ছয় দফা থেকে একচুল এদিক-ওদিক যাবেন না তিনি, এটাই ছিল তাঁর (বঙ্গমাতা) সিদ্ধান্ত। আমার মা বুঝেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ছয় দফার একটি দাঁড়ি-কমাও বদলাবে না। আর সেটাই আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে পাস হয়েছিল।’
দল চালাতে এবং আন্দোলন গড়ে তুলতে বঙ্গমাতার সক্রিয় ভূমিকার কথা উল্লেখ করে তাঁর কন্যা বলেন, গোপনে দলের লোকজনের সঙ্গে দেখা করা, ছাত্রলীগের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, তাদের নির্দেশনা দেওয়া এবং পোশাক পরিবর্তন করে বোরকা পরে মিছিল-মিটিং করা—মায়ের এসব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা অন্ধকারেই ছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পাকিস্তানি গোয়েন্দারা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সব সময় রিপোর্ট দিত। ওই রিপোর্টগুলো নিয়ে বই প্রকাশ করার সময় তিনি (শেখ হাসিনা) খোঁজ করে দেখেছেন সেখানে তাঁর মায়ের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের রিপোর্ট নেই। যদিও তাঁর মা ছিলেন রাজনীতিতে অত্যন্ত সক্রিয় ও গোপনে দলের লোজনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য আজকে যাঁরা ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব পদক-২০১’ পেলেন তাঁদের সবাইকে অভিন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, বঙ্গমাতার জন্মবার্ষিকী এ বছরই প্রথমবারের মতো জাতীয় দিবস হিসেবে উদযাপন এবং ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব পদক’ প্রদান করা হচ্ছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য এই পদকপ্রাপ্ত পাঁচজন বিশিষ্ট নারীকে তিনি আন্তরিক অভিনন্দন জানান। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য—‘বঙ্গমাতা, সংকটে-সংগ্রামে নির্ভীক সহযাত্রী’ যথার্থ হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতিটি সংগ্রামে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের অসামান্য অবদান রয়েছে। আমার মা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব সারা জীবন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশের মানুষের জন্য চিন্তা করতে প্রেরণা জুগিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘স্বামীর কাছে মানুষের নানা ধরনের চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা থাকে। অনেক কিছু পাওয়ার থাকে। আমার মার, বাবার কাছে কোনো কিছুর চাহিদা ছিল না। তিনি সব সময় বলতেন, তুমি দেশের কথা চিন্তা করো। আমাদের কথা ভাবতে হবে না। প্রেরণাটাই দিয়ে গেছেন। আমার মায়ের যে অবদান রয়েছে, এ দেশের রাজনীতিতে, শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশের মানুষের অগ্রগতিতেও তাঁর অবদান আছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রতিটি মেয়ের শিক্ষা নেওয়া উচিত এবং আর্থিক সচ্ছলতা দরকার। খালি অধিকার অধিকার বলে চিৎকার করলেই হবে না। অধিকার আদায় করতে হবে। শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে আর্থিক সচ্ছলতা অর্জন করে প্রতিটি মেয়েকেই নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে—সেই উপলব্ধি তাঁর ছিল। মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনা এবং যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের পুনর্বাসনে বঙ্গমাতার নিজের গহনাগাটি সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েও তাদের পাশে দাঁড়ানোর কথাও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
এ সময় মায়ের বই কেনা এবং বই পড়ার অভ্যাসের কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার মায়ের অভ্যাস ছিল বই কেনা। নিউ মার্কেট থেকে তিনি বই কিনতেন। আমাদেরও নিয়ে যেতেন। আমার বাবা বার্ট্রান্ড রাসেলের বই পড়ে ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে মাকে শোনাতেন।’
১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের স্মৃতিচারণা করে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘শুধু একটাই প্রশ্ন সব সময়, কেন এই হত্যাকাণ্ড? আমার মা, ভাইয়েরা, যাঁরা নিজের জীবন উৎসর্গ করলেন, জীবনের সুখ-আহ্লাদ একটা জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য বিলিয়ে দিলেন, সেই বাঙালিই তাঁদের কেন হত্যা করল?’
সূত্র : বাসস।