স্টাফ রিপোটার ঃ
নবী করিম (দঃ)-এর গুণগান সম্বলিত পবিত্র মিলাদ মাহফিল এবং এই মিলাদ মাহফিলে ‘ইয়া নাবী সালামু আলাইকা’ বলে নবীজীকে সালাম দেয়ার সময় সম্মান প্রদর্শনার্থে দাঁড়িয়ে যাওয়া অর্থাৎ এক কথায় মিলাদ-কিয়াম জায়েজ। শুধু জায়েজই নয়, এই পুণ্যময় কাজটি নবী পাক (দঃ)-এর প্রতি প্রেম ভালোবাসার একটি নিদর্শন। কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস এবং ফোকাহায়ে কেরাম তথা মাজহাবের ইমামগণের মতে মিলাদ-কিয়াম জায়েজ এবং উত্তম একটি আমল। একইভাবে নবী করিম (দঃ) যে নূরের সৃষ্টি তাও ইসলামী দলিল সম্মত। এর সমাধান যেমনিভাবে কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াসে রয়েছে তেমনি ফোকাহায়ে কেরামের কিতাবাদিতেও রয়েছে। এটি মীমাংসিত বিষয়। এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা মানে মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করারই নামান্তর। কথাগুলো বলেছেন আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ওলামায়ে কেরাম। তাঁরা গতকাল ১৭ আগস্ট সোমবার চাঁদপুর প্রেসক্লাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত আয়োজিত এক প্রেসব্রিফিংয়ে এ কথাগুলো বলেন।
ওলামায়ে কেরাম জানান, প্রচলিত মিলাদ-কিয়াম যে জায়েজ এবং নবী পাক (দঃ) যে আল্লাহর নূরের সৃষ্টি এ বিষয়টি ওহাবী পন্থী আলেমরা মানতে চান না। তারা সবসময় এর বিরোধীতা করে মিলাদ-কিয়ামকে নাজায়েজ এবং হুজুর (দঃ) মাটির সৃষ্টি বলে মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে আসছেন। কিন্তু তাঁরা (ওহাবী পন্থী আলেমরা) কখনো এ সব বিষয়ে সুন্নী আলেমদের সাথে সঠিক সমাধানের লক্ষ্যে বাহাস-মোবাহাসায় বসতে চান না, এমনকি অতীতে দেশের কোথাও কোথাও বাহাসে বসলেও তারা (ওহাবী পন্থী) পরাজিত হয়েছেন। চাঁদপুরেও সমপ্রতি তারা সুন্নী আলেমদের সাথে উপরোক্ত দুটি বিষয়ে বাহাসে বসবেন বলে পরে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে দূরে সরে যান। ওলামায়ে কেরাম বলেন, সমপ্রতি চাঁদপুরে মিলাদ ও কিয়াম বিরোধীদের (ওহাবী পন্থী কওমী) সাথে সুন্নী আলেমদের বাহাসের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিলো। চাঁদপুর সদর উপজেলার ৭নং তরপুরচন্ডী ইউনিয়নস্থ আলহাজ্ব তাফাজ্জল কাজী হাফেজিয়া মাদ্রাসার (কওমী ধারার) মোহতামেম মৌলভী আবুল কাশেম উপরোক্ত দু’টি বিষয় নিয়ে সুন্নী আলেমদের সাথে বাহাসে বসবেন বললে একই এলাকার দক্ষিণ দাসদী বোরহানুল উলুম আলিম মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা হাফেজ রফিকুল ইসলামের বড় ছেলে ড. সাইফুল ইসলাম আজহারী এবং এ মাদ্রাসার আরবী প্রভাষক মাওঃ রবিউল হাছান সুন্নী আলেমদের পক্ষে বাহাসের ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করেন। এরই আলোকে গত ১৮ রমজান ৬ জুলাই বাহাসের জন্যে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রাথমিক পরামর্শের লক্ষ্যে তাদের (মিলাদ-কিয়াম বিরোধীদের) পছন্দ মতে চাঁদপুর শহরের ঐতিহ্যবাহী বেগম জামে মসজিদ মাদ্রাসার অফিস কক্ষে উভয় পক্ষের আলেমদের মধ্যে বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের পক্ষে ড. সাইফুল ইসলাম আজহারী, মুফতি আমির হোসাইন, মাওঃ হুজ্জাতুল্লাহ নক্শবন্দী মোজাদ্দেদী, মাওঃ রবিউল হাসান ও মাওঃ এ এইচ এম আহসান উল্লাহ উপস্থিত ছিলেন। আর ওহাবী পন্থী তথা মিলাদ-কিয়াম বিরোধী পক্ষে ছিলেন বেগম জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব মুফতি মাহবুবুর রহমান, তাফাজ্জল কাজী মাদ্রাসার মোহতামেম মাওঃ আবুল কাশেম, জেলা কওমী সংগঠনের সেক্রেটারী মাওঃ লেয়াকত হোসাইন, বরুড়া মাদ্রাসার জনৈক মোহাদ্দেস, জনৈক মৌলভী আঃ গাফ্ফার ও ওয়্যারলেস বাজারস্থ কওমী মাদ্রাসার মনির হোসেন গাজী। ওলামায়ে কেরাম বলেন, ওই বৈঠকে উভয় পক্ষের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনা হয়। আলোচনায় উভয় পক্ষ বাহাস হবে বলে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। বাহাসের বিষয়বস্তু হচ্ছে_ ‘বাংলাদেশে প্রচলিত মিলাদ-কিয়াম জায়েজ কি-না এবং রাসুল পাক (দঃ) নূরের না মাটির সৃষ্টি’। তখন বাহাসের নীতিমালা নিয়ে কথা উঠলে ওই বৈঠকেই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের পক্ষ থেকে মাওঃ এ এইচ এম আহসান উল্লাহ স্বাক্ষরিত নীতিমালা উপস্থাপন করা হয়। এই নীতিমালাটি মিলাদ-কিয়াম বিরোধীদের পক্ষ থেকে বেগম জামে মসজিদের ইমাম মুফতি মাহবুবুর রহমান স্বাক্ষর করে রাখেন। তখন তাদের (প্রতিপক্ষের) নীতিমালা চাওয়া হলে পরবর্তীতে দেয়া হবে বলে তারা জানান। এ কথার উপরই সেদিনকার বৈঠক শেষ হয়। অথচ তারা সেদিন তরপুরচণ্ডী এলাকায় গিয়ে ওই বৈঠকের ব্যাপারে মিথ্যা প্রপাগান্ডা ও অপপ্রচার চালায়। এরপর রমজানের মধ্যে বেগম মসজিদের ইমামকে তাদের পক্ষ থেকে নীতিমালার জন্য এবং বাহাসের অগ্রগতি বিষয়ে মোবাইলে একাধিকবার তাগিদ দেন মাওঃ আহসান উল্লাহ। কিন্তু বার বার মুফতি মাহবুব ‘ওই পক্ষ’র দোহাই দিয়ে নিজেকে এই প্রক্রিয়া থেকে আড়াল করতে চান এবং কালক্ষেপণ করতে থাকেন। অবশেষে ঈদুল ফিতরের পর মুফতি মাহবুবুর রহমানের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করে ২২ জুলাই সকালে তাঁর কাছ থেকে মিলাদ-কিয়াম বিরোধী পক্ষের একটি নীতিমালা মাওঃ আহসান উল্লাহ গ্রহণ করেন। কিন্তু এটি তাদের (মিলাদ-কিয়াম বিরোধীদের) একটি প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। কেননা, তাদের দেয়া নীতিমালাটিতে কোনো আলেমের স্বাক্ষর নেই। এটিতে ‘উত্তর তরপুরচন্ডী এলাকাবাসীর পক্ষে- জনৈক রাসেল কাজী’ নামে একজন সাধারণ লোকের স্বাক্ষর করা। যা রীতিমতো হাস্যকর এবং মহতী এই উদ্যোগের সাথে উপহাস করা ছাড়া আর কিছুই নয়। তখন মুফতি মাহবুবুর রহমানের কাছে মাওঃ আহসান উল্লাহ জানতে চান এই রাসেল কাজী কে? সে কী আলেম? উত্তর মিললো, না, আলেম নয়। এরপর তাকে বলা হলো একটি ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আপনাদের পক্ষ থেকে এমন এক লোকের স্বাক্ষরিত নীতিমালা দেয়া হলো যে ব্যক্তি আলেম তো ননই এমনকি এসব বিষয়ে তার নূ্যনতম জ্ঞানও নেই। তখন মুফতি মাহবুবুর রহমানকে বলা হলো, আপনাদের দেয়া নীতিমালাটিতেই আপনি অথবা আপনাদের পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল কোনো আলেম স্বাক্ষর করে দেন, তখন আমরা উভয় পক্ষ বসে একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন করবো যার আলোকে বাহাস সংঘটিত হবে। কিন্তু মুফতি মাহবুবুর রহমান কোনো মতেই তাতে রাজী নন। অর্থাৎ তিনি বা তাদের (মিলাদ-কিয়াম বিরোধী) পক্ষে কোনো আলেম তাদের দেয়া নীতিমালাতে স্বাক্ষর করবেন না। এতে আমরা বিস্মিত, ব্যথিত ও মর্মাহত হই। ওলামায়ে আহলে সুন্নাত বলেন, আমরা মনে করি এর দ্বারা প্রতিপক্ষ অর্থাৎ মিলাদ-কিয়াম বিরোধীরা প্রতারণার একটি সুক্ষ্ম কৌশল নিয়েছেন। আর তা হচ্ছে_ বাহাস সংক্রান্ত কোনো লিখিত পত্রাদিতে তারা জড়িত থাকবেন না। নিজেরা কাগজ-কলমে না থেকে সাধারণ মানুষকে জড়িয়ে দিয়ে তারা দূরে থাকবেন। যাতে ভবিষ্যতে অবস্থা বেগতিক দেখলে বা বাহাসের ফলাফল তাদের বিপক্ষে গেলে তখন কোনো কাগজপত্রে তাদের স্বাক্ষর নাই বিধায় এর দায়-দায়িত্ব তাদের না বলে নিরাপদ থাকতে পারেন। কিন্তু তাদের দুরভিসন্ধি বুঝতে সুন্নী আলেমদের কষ্ট হয় নি। ওলামায়ে আহলে সুন্নাত বলেন, তারপরও আমরা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছি ধর্মীয় এ বিষয়গুলো নিয়ে আর যাতে কোনো বিতর্ক না হয়, সরলমনা মুসলমানদের মধ্যে যেনো এসব বিষয় নিয়ে কোনো মতবিরোধ না থাকে, সেজন্যে উভয় পক্ষের আলেমরা একটি গ্রহণযোগ্য নীতিমালার আলোকে বসে একটি সমাধানে পেঁৗছুক, যা হবে সারাদেশের মধ্যে একটি দৃষ্টান্ত। এ উদ্দেশ্যে মুফতি মাহবুবুর রহমান সাহেবের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করেও কোনো সদুত্তর পাওয়া যায় নি। সবশেষে গত ৩০ জুলাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের পক্ষে মাওঃ এ এইচ এম আহসান উল্লাহ স্বাক্ষরিত একটি লিখিত জবাবস্বরূপ পত্র মুফতি মাহবুবুর রহমানকে হাতে হাতে দেয়া হয়। সেটিতেও গ্রহণযোগ্য পন্থায় বাহাসের জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের পক্ষ থেকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ পর্যন্ত তাদের কোনো সাড়া মিলেনি। এজন্য আমরা তাদের প্রতি ধিক্কার জানাই, নিন্দা জানাই। বুঝা গেলো তারা তাদের ভ্রান্ত আকীদার বিষয়ে শুধু গলাবাজি করে মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করে রাখবে। প্রেস ব্রিফিংয়ে ওলামায়ে কেরাম সর্বশেষ বলেন, তারপরও আমরা আপনাদের (সাংবাদিকদের) মাধ্যমে তাদের প্রতি আহ্বান জানাবো, আসুন, সাধারণ সরলমনা মুসলমানদেরকে এসবের মধ্যে না জড়িয়ে আমরা আলেম সমাজ বসে কোরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াসের আলোকে সকল কিছুতে সঠিক সমাধানে পেঁৗছি। যার দ্বারা মুসলিম উম্মাহ ধর্মীয় বিষয়গুলো নিয়ে বিদ্যমান কলহ থেকে মুক্তি পাবে।
প্রেস ব্রিফিংয়ে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত চাঁদপুর জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক মাওঃ এএইচএম আহসান উল্লাহ। বক্তব্য রাখেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের প্রেসিডিয়াম সদস্য মাওঃ আবু সুফিয়ান খান আবেদী আল কাদেরী, জেলা সভাপতি ড. একেএম মাহবুবুর রহমান, সিনিয়র সহ-সভাপতি অধ্যক্ষ মুফতি আব্দুর রব আল কাদেরী, মাওঃ হুজ্জাতুল্লাহ নকশবন্দী মোজাদ্দেদী ও ড. সাইফুল ইসলাম আজহারী। চাঁদপুরের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকগণের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাত, চাঁদপুর দর্পণের সম্পাদক ও প্রকাশক ইকরাম চৌধুরী, চাঁদপুর বার্তার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শহীদ পাটোয়ারী, চাঁদপুর প্রবাহের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রহিম বাদশা, ইলশেপাড়ের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বিএম হান্নান, দৈনিক মেঘনা বার্তার সম্পাদক ও প্রকাশক আবদুল আউয়াল রুবেলসহ সম্পাদকগণের প্রতিনিধিগণ। আর ওলামায়ে কেরামের মধ্যে আরো উপস্থিত ছিলেন অধ্যক্ষ মাওঃ মোস্তাফিজুর রহমান, অধ্যক্ষ মাওঃ আবু জাফর মোঃ মাঈনুদ্দিন, অধ্যক্ষ মাওঃ জসিম উদ্দিন, উপাধ্যক্ষ মাওঃ ছাঈদুর রহমান, মাওঃ রবিউল হাসান, মাওঃ আব্দুল হান্নান নিজামী, যুবনেতা মোঃ হুমায়ূন কবির, পীরজাদা মাওঃ খাজা মোঃ যোবায়ের, মাওঃ আবদুর রউফ খান করিম, মাওঃ আব্দুর রাজ্জাক, মাওঃ আলাউদ্দিন দেওয়ান, মাওঃ মামুনুর রশিদ, মাওঃ গাজী মোঃ আব্দুর রাহীম, মাওঃ মাহফুজুর রহমান, মাওঃ হাসানুজ্জামান, ছাত্রনেতা মোঃ হেলাল উদ্দিন, আব্দুল্লাহ আল আমিন সাকী প্রমুখ। সবশেষে মিলাদ ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। দোয়া ও মোনাজাত করেন নওগাঁও ফাযিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আল্লামা জাকারিয়া চৌধুরী মাদানী।