মিজান লিটন
এক মাসে চাঁদপুর শহরের আলোড়ন সৃষ্টিকারী ২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা যেনো অনেকটা ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে। মানুষও মনে হয় যেনো ভুলে যাচ্ছে চাঞ্চল্যকর ও লোমহর্ষক দু’টি হত্যাকাণ্ডের কথা। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা পুলিশ প্রশাসনের মধ্যেও এ দু’টি হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে অনেকটা ঢিলেঢালা ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পুলিশ অবশ্য এ ব্যাপারে অনেক দিন ধরে বলছে, আসামী চিহ্নিত হয়েছে, আসামী ধরার চেষ্টা চলছে। কিন্তু সচেতন জনগণের প্রশ্ন : মুক্তিযোদ্ধা নান্নু পাটওয়ারীর খুনিরা কি আদৌ ধরা পড়বে? স্কুল ছাত্র শাহেদ চৌধুরী হত্যার রহস্য কি উন্মোচন হবে? এই শিশুটির খুনিদের পরিচয় কি আদৌ চাঁদপুরবাসী জানতে পারবে? এসব প্রশ্নের উত্তর যদি না হয় তাহলে খুনিরা তথা অপরাধীরা আরো উৎসাহিত হবে, আরো খুনের ঘটনা হয়তো জেলাবাসীকে শোনার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আর এ সবের দায় গিয়ে পড়বে চাঁদপুরের পুলিশ প্রশাসনের উপর।
গত ১১ এপ্রিল চাঁদপুর শহরের হাজী মহসিন রোডে অবস্থিত একটি সুরক্ষিত বাড়িতে দিনের বেলা নিজ শয়ন কক্ষে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তের দ্বারা মারাত্মক রক্তাক্ত জখম হয় স্কুল ছাত্র শাহেদ চৌধুরী (১৫)। ওই দিন রাতেই মুমূর্ষ অবস্থায় তাকে ঢাকা নেয়ার পথে সে মারা যায়। পরদিন শাহেদের পরিবারের লোকজন থানা পুলিশকে না জানিয়ে অনেকটা নীরবে তার লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করে। কিন্তু ঘটনাটি কিছু সংবাদকর্মীর কানে আসলে স্থানীয় কয়েকটি পত্রিকায় ওই ঘটনার সংবাদ প্রকাশিত হয়। তখন শহরবাসী এবং প্রশাসন এমন একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবর জানতে পারে। এ ঘটনা নিয়ে স্থানীয় কয়েকটি পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়। এরপর ঘটনার ২৬ দিন পর ৬ মে রাতে শাহেদের মা মিতা রহমান বাদী হয়ে চাঁদপুর মডেল থানায় ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে মামলা করেন। তবে মামলায় তিনি কাউকে আসামী করেন নি। এ মামলার পর পুলিশ তদন্ত শুরু করে। ওই ভবনের সিসি ক্যামেরার মেশিনসহ নানা আলামত পুলিশ জব্দ করে। এরপর আদালতের নির্দেশে পুলিশ ঘটনার ৩৪ দিন পর ১৫ মে শাহেদের লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে। ওই দিনই পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে নিয়ে ৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এই ৮ জনের মধ্যে শাহেদের বোন হীরা চৌধুরী ও তার প্রেমিক কামরুল ইসলাম শিকদার মুনও ছিলো। জিজ্ঞাসাবাদের পর হীরা ও মুন ছাড়া অন্যদের ছেড়ে দেয়া হয়। পরে আদালতের মাধ্যমে হীরা ও মুনকে জেল হাজতে পাঠানো হয় এবং তাদের উভয়কে তিন দিনের রিমান্ডে আনা হয়। গত ২১ মে তাদের রিমান্ড শেষ হয়। মূলত এরপর থেকেই শাহেদ হত্যার ঘটনাটি ধামাচাপা পড়তে থাকে। পুলিশ প্রশাসনেরও এ ব্যাপারে কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেনো বিষয়টি হিমাগারে চলে যাচ্ছে। জনমনে প্রশ্ন : তাহলে কি রিমান্ডে হীরা ও মুন থেকে এমন কোনো চাঞ্চল্যকর এবং স্পর্শকাতর তথ্য বেরিয়ে এসেছে যে কারণে পুলিশ আর সামনে এগুতো পারছে না? তাহলে কি প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ এখানেও পড়েছে? সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে, এটি নাকি সমঝোতার চেষ্টা চলছে।
শাহেদ হত্যার ৪০ দিনের মাথায় ১৯ মে সোমবার দিবাগত রাতে চাঁদপুর শহরের কোড়ালিয়ায় নিজ বসতঘরের ভেতরে নৃশংসভাবে খুন হন মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মালেক ওরফে নান্নু পাটওয়ারী (৬০)। অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা ওই রাতে ঘরে ঢুকে নান্নু পাটওয়ারীকে উপর্যুপরি আঘাত করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। খুনিরা অমানবিকভাবে লাশের উপর অনেক নির্যাতন করেছে। এমন ভয়াবহ খুনের চিত্র দেখে মানুষ হতবাক হয়েছে। তবে সৌভাগ্যক্রমে ওই খুনের ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ঘরের কেয়ারটেকার উজ্জ্বল নামে ১২-১৩ বছরের শিশুকে বাঁচিয়ে রাখে খুনিরা। ঘটনার পরদিন এলাকাবাসীর সহায়তায় পুলিশ উজ্জ্বলকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। পুলিশ উজ্জ্বলের কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায়। উজ্জ্বলের জবানবন্দি আদালতে রেকর্ড করা হয়। খুনিদের নাম-পরিচয় পুলিশের কাছে অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যায়। ঘটনার পরদিন নান্নু পাটওয়ারীর ভাই মুক্তিযোদ্ধা হানিফ পাটওয়ারী বাদী হয়ে চাঁদপুর মডেল থানায় মামলা করেন। তবে তিনি নাম উল্লেখ করে কাউকে আসামী করেন নি। বাদীর সাফ কথা, তদন্ত করে আসামী তথা খুনি যে-ই চিহ্নিত হয় তাকে কোনো ছাড় দেয়া হবে না। সে যদি আমাদের পরিবারের কোনো লোকও হয় তবুও আপোষ নেই। এখনো বাদীর একই কথা। পুলিশের জন্য প্রশান্তির খবর হচ্ছে, হত্যাকাণ্ডের দু’দিনের মাথায় পুলিশ খুনিদের চিহ্নিত করতে পেরেছে। এজন্য তাদের তেমন কোনো কষ্ট বা বেগ পেতে হয়নি। অযথা সন্দেহভাজন কাউকে ধরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ বা রিমান্ডে নিতে হয়নি। মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ এবং মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ঘটনার দু’দিনের মাথায় আসামী চিহ্নিত করতে পেরেছেন বলে সাংবাদিকদের জানান। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে : আসামী চিহ্নিত হবার পরও এখনো আসামী কেনো ধরা হচ্ছে না। আসামী ধরতে পুলিশের এত গড়িমসি কেনো। এ মামলাটি নিয়ে পুলিশের মধ্যে কেমন যেনো ঢিলেঢালা ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মামলার আইওর কাছে এ ব্যাপারে সংবাদকর্মীরা এবং মামলায় বাদী জিজ্ঞেস করলে তার একই কথা, আসামী চিহ্নিত হয়েছে, আসামী ধরার চেষ্টা চলছে। গত সোমবার চাঁদপুর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ আবদুল কাইয়ুমের কাছে নান্নু পাটওয়ারী ও শাহেদ হত্যার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, উভয় মামলার আসামী চিহ্নিত হয়েছে, আসামী ধরার চেষ্টা চলছে। আশা করি আপনাদের ভালো খবর দিতে পারবো। এদিকে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা গেছে, নান্নু পাটওয়ারী হত্যা মামলার বাদী পুলিশের তৎপরতায় সন্তুষ্ট নন।
সবকিছু ছাপিয়ে জেলাবাসী চাঞ্চল্যকর মুক্তিযোদ্ধা নান্নু পাটওয়ারী ও শাহেদ চৌধুরী হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন দেখতে চায়, খুনিদের চিনতে চায়। শান্তিপ্রিয় মানুষ খুনিদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে দেখতে চায়। পুলিশ প্রশাসনের এখানে বলিষ্ঠ, নিরপেক্ষ, নিঃস্বার্থ ও আপোষহীন ভূমিকা দেখতে চায়।