ফরিদগঞ্জ: ফরিদগঞ্জ পৌর এলাকার নোয়াগাঁও গ্রামের প্রধান সড়কটির পাশেই যে কোনো পথিকের চোখে পড়ে সীমানা প্রাচীর মধ্যে একটি নতুন কবর। তাতে লেখা, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা আফাস উদ্দিনের কবর’। কবরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মুসুল্লিদের অনেকেই ‘আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহালাল কুবুর’ বলে সালাম জানায়। পথিকরা পরক্ষণে যখন জানতে পারেন এ কবরটি যার জন্য তৈরি তিনি এখনো বেঁচে আছেন তখন তারা চমকে ওঠেন।
আরও বিস্ময়কর বয়োবৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা আফাস উদ্দিন ১৩ হাজার টাকা ব্যয় করে কবরটি নিজের জন্য নির্মাণ করেছেন। শুধু কবরই নয়, সীমানা দেয়াল দিয়ে কবরের জায়গাটুকু পাকা করেছেন, স্থাপন করেছেন এফিটাপ। নিঃসঙ্গ এ বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধার কাছে নেই তার পরিবার-পরিজন।
এই মুক্তিযোদ্ধার একটাই আশঙ্কা মৃত্যুর পর তার স্বজন বা উত্তরাধিকাররা তার কবরটি সংরক্ষণ করবে তো?
এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা আফাস উদ্দিনে বলেন, ‘আমার এক ছেলে এক মেয়ে। তারা কেউই আমার কাছে থাকে না। মরার পর কে মাটি দেবে, তা জানি না। তাই নিজেই নিজের কবর বানাইয়া রাখলাম।’
মৃত্যুর পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হবে। রাষ্ট্রই দাফনের যাবতীয় ব্যবস্থা করবে। তারপরও কবর তৈরি করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মরার পরে রাষ্ট্র আমারে বড় জোর স্যালুট জানাইবো, কিন্তু আমার কবরটাতো সংরক্ষণ করবো না। এমন বহু মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছে জাগো এহন কবরও খুঁইজা পাওন যায় না। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, আমি চাই মরার পরে আমার কবরের দিকে তাকাইয়া মানুষ অন্তত সালামটুকু দিক। যার জন্যই রাস্তার পাশে নিজের কেনা জায়গায় স্থায়ী কবর তৈয়ার করছি।’
আফাস উদ্দিন স্ত্রী মারা গেছেন বছর তিনেক আগে। এক ছেলে রাঙ্গামাটিতে বসবাস করেন। মেয়ের বিয়ে হয়েছে ঢাকায়। আরেক ছেলে বিদেশে কাজ করতে গিয়ে সেখানেই মারা যান।
আফাস উদ্দিন ২নং সেক্টরের আওতায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কর্তৃক প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা কার্ডে তার নাম ‘আপাজ উদ্দিন (সেনাবাহিনী)’ মুক্তি নং ০২০৫০৫০২১৭। তিনি একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা।
জানা যায়, একাত্তরে পাকবাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে তার বাম হাতে ও ডান পায়ে গুলি লাগে। তারপর থেকে তার বাম হাতের একটি আঙ্গুল বাঁকা হয়ে যায়। যুদ্ধের সময় হানাদাররা একবার তাকে মাটিতে ফেলে জবাই করতে চেয়েছিল। ভাগ্যক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচে যান।
মৃত্যুর পর যে মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হবে, মনের ক্ষোভে সেই মুক্তিযোদ্ধা নিজের কবর নিজেই তৈরি করার বিষয়টি সাধারণ মানুষের কাছে হাস্যকর মনে হলেও আফাস উদ্দিনের মত অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তা কঠিন বাস্তবতা।