হরিণা থেকে ফিরে জিয়াউর রহমান বেলাল ॥
প্রমত্তা মেঘনার ভয়াবহ ভাঙ্গনে গত এক সপ্তাহে চাঁদপুর সদর উপজেলার হরিণা ফেরীঘাট এবং হরিণার আশপাশ এলাকার প্রায় অর্ধ কিলোমিটার এলাকা নদীর অতল গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। প্রকৃতির রুদ্র রোষে উত্তাল নদীর ব্যাপক করাল গ্রাসে এ পর্যন্ত এলাকার ৬টি বাড়ি, ১৫/১৬ টি বাগানের অসংখ্য গাছপালা এবং বেশকিছু দোকানপাট সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়। হরিণা গ্রামের অর্ধ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে মেঘনার ব্যাপক ও ভয়াবহ ভাঙ্গনে তলিয়ে যাওয়া বাড়িগুলো হচ্ছে-বেপারী বাড়ি, গাজী বাড়ি, সরকার বাড়ি, শেখ বাড়ি, ঢালী বাড়ি ও ছৈয়াল বাড়ি গর্ভে তলিয়ে যাওয়া এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২ কোটি টাকা হবে বলে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন ও এলাকাবাসী জানিয়েছেন। গত এক পক্ষকাল যাবত এই এলাকায় নদী ভাঙ্গন শুরু হলেও গত এক সপ্তাহ ধরে তা ভয়াবহ ভাঙ্গনের মাধ্যমে রূপ পরিগ্রহ করে মারাত্মক আকার ধারন করে। বর্তমানে ভয়াবহ নদী ভাঙ্গন অব্যাহত থাকায় এলাকাবাসী ব্যাপকভাবে আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ গত ২ দিন যাবত ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন এবং সার্ভে বা জরিপ ছাড়া ভাঙ্গন ঠেকানোর জন্য আর কোনো কার্যকর ব্যবস্থাই নেয়নি। ফলে এসব এলাকায় ভয়াবহ নদী ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে এবং তা দিন দিনই ক্রমান্বয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করছে। ভয়াবহ নদী ভাঙ্গন রোধে স্থানীয় পাউবো দীর্ঘ ১৫ দিনেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করার প্রতিবাদে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভূক্তভোগী কয়েকশ’ লোক গতকাল মঙ্গলবার (১৬ জুন, ২০১৫ খ্রি:) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যে দীর্ঘ সময় মেঘনাপাড়ের ভাঙ্গনস্থল এবং ক্ষতিগ্রস্ত হরিণা ফেরীঘাট এলাকায় দাঁড়িয়ে থেকে দীর্ঘ মানববন্ধন রচনা করে এবং মানববন্ধনশেষে এক প্রতিবাদ সভায় মিলিত হয়।
হরিণা ফেরীঘাট সংরক্ষণ সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক মো: হারুন খানের সভাপতিত্বে এবং যুগ্ম আহ্বায়ক মো: মোক্তার গাজীর সঞ্চালনায় প্রতিবাদ সভায় অন্যান্যের মাঝে বক্তব্য রাখেন আব্দুর রব ছৈয়াল, হরিণা ফেরীঘাট জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা কেফায়েত উল্লাহ, হরিণা ফেরীঘাট দারুল কোরআন ইসলামীয়া মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি মো: কালু হাওলাদার এবং দৈনিক চাঁদপুর সংবাদের প্রধান সম্পাদক জিয়াউর রহমান বেলাল, চাঁদপুর জেলা সম্মিলিত মানবাধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. শেখ মহসিন প্রমূখ। মানববন্ধনে অন্যান্যের মধ্যে অংশগ্রহণ করেন হরিণা ফেরীঘাট সংরক্ষণ সংগ্রাম কমিটির সদস্য সচিব মো: কাদির ছৈয়াল, সর্বযুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুর সাত্তার রাঢ়ী, আবুল কালাম ছৈয়াল ও মো: বিল্লাল গাজী, সর্বসদস্য ইউনুছ গাজী, হাফেজ ছৈয়াল, মিজান গাজী, শাহজালাল ঢালী এবং সর্বম্যস্য ব্যবসায়ী আহছান ছৈয়াল, মুনসুর গাজী, সেরাজল শেখ, রাশেদ খান, নেছার আহম্মেদ ছৈয়াল, ফারুক চৌকিদার, মহসিন চৌকিদার, ইট-বালু ব্যবসায়ী কাদির রাঢ়ী ও আবুল মাষ্টার প্রমূখ। প্রতিবাদ সভায় বক্তারা দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলেন, ‘নদী ভাঙ্গন নিয়ে আমরা আর কোনো রাজনীতি দেখতে চাই না এবং সেইসাথে অস্থায়ী ভাঙ্গনরোধের নামে কুমিরের ৭টি ছানার গল্পও আমরা আর শুনতে চাই না। আমরা চাই এই এলাকাসহ চাঁদপুরের বিভিন্ন ভাঙ্গন কবলিত এলাকা মেঘনার ভয়াবহ ভাঙ্গন থেকে স্থায়ীভাবে রক্ষা পাক।’ প্রতিবাদসভা থেকে বক্তারা এ ব্যাপারে স্থানীয় এমপি ডা. দীপু মনি’র ত্বরিত হস্তক্ষেপ কামনা করে অবিলম্বে এই এলাকাকে ভয়াবহ নদী ভাঙ্গনের হাত থেকে স্থায়ীভাবে রক্ষার জন্য দেশের বর্তমান সরকার প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পানি সম্পদ মন্ত্রীর কাছে জোর দাবি জানানো হয়।
আজ শেষ বিকেলে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যে হরিণা ফেরীঘাটের আশপাশে এবং হরিণা এলাকার দীর্ঘ মেঘনা নদীর পাড়ে কমপক্ষে ১০/১২টি বিশাল বিশাল ফাটল এবং বড় বড় গর্ত দেখা দেয়। এতে এলাকার লোকজন আবারো আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (রাত ৮টা) এসব স্থানে ভয়াবহ নদী ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে এ এলাকায় ভয়াবহ নদী ভাঙ্গনের কারণে হরিণা ফেরীঘাট ও ফেরীঘাট এলাকার ৫০/৬০টি দোকান, ১০/১২টি ম্যস্য আড়ত, ২টি ইট-বালুর খোলা, হরিণা ফেরীঘাট দোতলা জামে মসজিদ, হরিণা ফেরীঘাট দারুল কোরআন ইসলামিয়া মাদ্রাসা এবং বিআইডব্লিউটিএ’র বাস ষ্ট্যান্ড ও বিশাল মাঠ, হরিণা উচ্চ বিদ্যালয়সহ বিশাল এলাকা মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। এছাড়া হরিণা ফেরীঘাট মেঘনার ভাঙ্গনে তলিয়ে গেলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর সাথে পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোর স্বাভাবিক যোগাযোগ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। বর্তমানে মেঘনা নদীর পানি বৃদ্ধি ও তীব্র স্রোত অব্যাহত থাকায় এবং ভয়াবহ নদী ভাঙ্গনের কারণে এই ফেরীঘাট দিয়ে চলাচলকারী শত শত বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাসসহ বিভিন্ন যানবাহনের স্বাভাবিক গতি ও যোগাযোগ দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এর ফলে এ এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মারাত্মক ভোগান্তির সম্মুখীন হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট অনেকেই।
হরিণা ফেরীঘাট এবং হরিণার আশপাশ এলাকা জুড়ে মেঘনার ভয়াবহ ভাঙ্গনে অর্ধ কিলোমিটার এলাকা তলিয়ে যাওয়া এবং মেঘনা নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গন অব্যাহত থাকার বিষয়টি সম্পর্কে চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ অবগত আছেন বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ ব্যাপারে চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ এ প্রতিবেদকে গতকাল বিকেলে মুঠোফোনে জানায়, ‘গতকাল মঙ্গলবার এবং গতপরশু সোমবার চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: রফিক উল্লাহ্, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মাহমুদুল করিম, উপ-সহকারী প্রকৌশলী/শাখা কর্মকর্তা মো: ওয়াহেদুর রহমান ভূঁইয়া হরিণা ফেরীঘাট এবং হরিণা এলাকার আশপাশে মেঘনা নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গন কবলিত এলাকা সরজমিনে পরিদর্শন করেন। হরিণা ফেরীঘাট এবং হরিণা এলাকায় বর্তমানে মেঘনা নদীর গভীরতা হচ্ছে ১৬ থেকে ২০ মিটার অর্থ্যা গড়ে নদীর গভীরতা ৬০ ফুট রয়েছে। নদীর তীর দেশ থেকে মাত্র ১৫ ফুট দূরত্বে দোতলা হরিণা ফেরীঘাট জামে মসজিদটি রয়েছে। যে কোনো সময় মেঘনা নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গনে মসজিদটিসহ মাদ্রাসাটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে।’ স্থানীয় পাউবো কর্তৃপক্ষ আরো জানায়, ‘বর্তমান বর্ষা মৌসুমের এ মুহর্তে এই এলাকায় স্থায়ী ভাঙ্গনরোধ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই স্থায়ী ভাঙ্গনরোধের জন্য আসছে শুষ্ক মৌসুমে অর্থ্যা নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসের দিকে স্থায়ী ভাঙ্গন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালকের মাধ্যমে পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে গত সপ্তাহে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব জমা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া গতরাতেই ই-মেইল করে হরিণা ফেরীঘাট এবং হরিণা এলাকার মেঘনার ভাঙ্গন কবলিত বিস্তারিত ডিজিটাল তথ্য-উপাত্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক মো: ইসলামইল হোসেনের কাছে পাঠানো হয়েছে। জরুরীভাবে ভাঙ্গন ঠেকানোর কোনো ব্যবস্থা
আপাতত: আমাদের হাতে নেই। তবে আগামীকাল (আজ বুধবার) ২৫০ কেজি বালিভর্তি ওজনের জিও ফেব্রিক্স ব্যাগ প্রয়োজনীয় সংখ্যক হরিণা ফেরীঘাট এবং হরিণা এলাকার মেঘনার ভাঙ্গন কবলিত স্থানগুলোতে ফেলার পরিকল্পনা রয়েছে।