বিমল চৌধুরী ===
শিক্ষকরা জাতির বিবেক অথচ কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষকদের কাছেই জিম্মি হয়ে পড়ছেন ছাত্র-ছাত্রীরা। তেমনই চিত্র ফুটে উঠেছে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ফরম পূরণের ক্ষেত্রে।
অভিযোগ উঠেছে ফরম পূরণের ক্ষেত্রে অধিক টাকা আদায়ের যা অনেক পরীক্ষার্থী ছাত্র-ছাত্রীদের পরিবারের কাছে অসহনীয়। শিক্ষকদের এ ধরনের বাড়তি ফি যোগান দিতে না পারার কারণে অনেক পরীক্ষার্থীই উচ্চ মাধ্যমিক বোর্ডের নির্ধারিত সময় অনুযায়ী ফরম ফিলাপ করতে পারবেন না বলে জানা যায়। আর যারা নির্ধারিত সময় ফরম ফিলাপ করতে পারবে না তাদেরকে পরবর্তী সময়ে আরো বেশি করে অর্থ দণ্ড দিতে হবে। যাকে বলা যায় মরার উপর খাড়ার ঘা। নির্ধারিত সময় ফরম ফিলাপ যারা করতে পারবে না তাদেরকে বোর্ডের লেট ফি গুণতে হবে। আর এ লেট ফির সাথে আবার স্কুলের বাড়তি কিছু নজরানাও গুণতে হবে। সবকিছু ঠিকঠাক মত পরিশোধ করতে পারলেই সুযোগ পাওয়া যাবে এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার। প্রতি বছরই এসএসসি পরীক্ষার সময় এলেই অধিকাংশ বিদ্যালয় নানা অজুহাতে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে বোর্ডের নির্ধারিত ফির চেয়ে কয়েকগুণ বেশি অর্থ আদায়ে আদা জল খেয়ে নেমে পড়েন। তারা পরীক্ষার্থীদের বোর্ড ফি পরীক্ষা কেন্দ্রে সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দেয়া, কোচিং ফিসহ নানা খাত দেখিয়ে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে এ সকল অর্থ আদায়ে তৎপর হয়ে উঠেন। আবার যে সকল পরীক্ষার্থী বিদ্যালয়ের টেস্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় নি তারা যদি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন তাদেরকেও অর্থ দণ্ড দিতে হয় প্রতি বিষয়ের উপর। যে সকল বিষয়ে ফেল করেছে সে সকল বিষয়ের সংখ্যানুসারে বাড়তি অর্থ যোগান দিয়ে এ সকল অযোগ্য পরীক্ষার্থী যোগ্য হয়ে উঠে পরীক্ষার জন্য। ফলে দেখা দেয় ফলাফল বিপর্যয়। যার কারণে অনেক বিদ্যালয়েই অধিক সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিলেও ফলাফল প্রকাশের পর এ সকল বিদ্যালয় আশানুরূপ ফলাফল অর্জন করতে পারে না। অবশ্য এ ক্ষেত্রে অভিভাবকসহ বিদ্যালয় পরিচালনা মণ্ডলীও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনেকটাই দায়ী। কারণ, তাদের সহযোগিতা ও নীরবতার কারণেই অযোগ্য পরীক্ষার্থীগণ অর্থের বিনিময়ে এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পায়।
প্রতিবারের ন্যায় এবারও মাধ্যমিক পরীক্ষার (এসএসসি) ফরম পূরণে বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা করে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অথচ নির্ধারিত বোর্ড ফি হলো প্রতি বিষয়ে ৬৫ টাকা করে ১১ বিষয়ে মোট ৭১৫ টাকা, প্র্যাকটিক্যাল বাবদ ৩০টাকা করে ৪টি বিষয়ে মোট ১২০ টাকা, মার্কশীট বাবদ ৩৫ টাকা, সনদপত্র বাবদ ১০০টাকা, স্কাউট ফি বাবদ ১৫ টাকা, শিক্ষা সপ্তাহ বাবদ ৫ টাকা, কেন্দ্র ফি বাবদ ২৫০ টাকা ও ক্রীড়া অ্যাপিলিশান বাবদ বিদ্যালয় প্রতি ২০০টাকা (যা পরীক্ষার্থীর সংখ্যানুসারে ভাগ হবে)। ক্রীড়া অ্যাপিলিশান বাদ দিয়ে ১২৪০ টাকা। অন্যান্য আরো কিছু আনুষঙ্গিক খরচ ধরে মোট খরচ ধরা যেতে পারে ১ হাজার ৩০০ টাকা। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে সরকারি স্কুলগুলো ১ হাজার ৪০০ টাকা ফরম ফিলাপ ফি গ্রহণ করলেও বেসরকারি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো ক্ষেত্র বিশেষ ৩ হাজার টাকা থেকে ৪ হাজার টাকা গ্রহণ করে থাকছেন। যে সকল বিদ্যালয় ফরম ফিলাপের ক্ষেত্রে এ ধরনের বেশি অর্থ আদায় করছে তাদের যুক্তিও ভিন্ন ভিন্ন। কেউ বলছেন বেতন, কোচিং ফি, শিক্ষক কল্যাণ ফাণ্ড, বিদ্যালয় আনুতোষিক বাবদ, পূজা ও মিলাদ, খেলাধুলা। এ সকল অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হয়। এ সকল অতিরিক্ত টাকা আদায় কতটুকু যুক্তি সঙ্গত তা বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদসহ কিছু শিক্ষক মণ্ডলীই বলতে পারবেন। শহর ভিত্তিক দু একটি বিদ্যালয় ব্যতীত অধিকাংশ বিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রী অভিভাবকদের অবস্থা নাজুক। তারা অনেক ক্ষেত্রে সময় মত বিদ্যালয়ের নির্ধারিত বেতন দিতেও কষ্টবোধ করেন। তাদের ক্ষেত্রে একবারে এককালীন এত টাকা দেয়া অনেকটাই কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অনেক অভিভাবক অভিযোগ করে বলেন, ফরম ফিলাপের সময় যদি বোর্ড ফি নেয়া হতো এবং কোচিং ফি সহ বাকি টাকা পরীক্ষার পূর্বে নেয়ার বিধান বিদ্যালয়গুলো চালু করতো, তাহলে আমরা যারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল তারা অনেকাংশেই স্বস্তি পেতাম। এক্ষেত্রে অবশ্য বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভিন্নমত রয়েছে। তারা জানান, ফরম ফিলাপের সময় যদি এ সকল টাকা এককালীন না নেয়া হয়, তাহলে পরে আর তা পাওয়া যায় না। তবে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যাই বলুক অভিভাবক মহল মনে করেন এ সকল অনিয়ম দূর হওয়া প্রয়োজন।
এ ব্যাপারে অতিরিক্ত ফি গ্রহণের কারণ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় জেলা বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি চাঁদপুর গণি মডেল আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ আব্বাস উদ্দিনের কাছে। তিনি বলেন, আমরা শিক্ষক সমিতি ফরম ফিলাপের ক্ষেত্রে বোর্ডের বাইরে নির্ধারিত কোনো নির্দিষ্ট ফি গ্রহণের ৰেত্রে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি নি। এক্ষেত্রে বিভিন্ন স্কুল তাদের পরিচালনা পর্ষদের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে ফরম ফিলাপ ফি ধার্য করে থাকেন। তবে তিনি প্রয়োজনের বাইরে অতিরিক্ত টাকা আদায় সমর্থন করেন না বলেও জানান। অতিরিক্ত ফি আদায়ের কারণ সম্পর্কে জানার জন্য চাঁদপুর সদর উপজেলা বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি চাঁদপুর পুরাণবাজার নুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ আবু তাহের তপাদারের কাছে তার প্রতিষ্ঠানে যাওয়া হয় দুপুর ১২টায়। তখন তিনি বিদ্যালয়ে ছিলেন না। বিদ্যালয়ের কাজে বাইরে আছেন বলে তার সহকর্মীরা জানান। জানতে চাওয়া হয় আপনারা এসএসসি ফরম ফিলাপ করতে কত টাকা করে নেন। উত্তরে শিক্ষিকা শাহীনা ইয়াছমিন জানান, কত টাকা করে নেয়া হয় আমরা জানি না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য একজন বিদ্যালয়ের শিক্ষক জানেন না তার বিদ্যালয়ে ফরম ফিলাপ বাবদ কত টাকা করে নেয়া হচ্ছে। এই কথাটা কতটুকু গ্রহণযোগ্য তাই ভাববার বিষয়।
বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী গত ১৯ নভেম্বরই শেষ হয়েছে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ফরম ফিলাপের তারিখ। অবশ্য অতিরিক্ত বোর্ড লেট ফি ১০০টাকা বেশি দিয়ে আগামী ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত তা জমা দেয়া যাবে।