ভরা মৌসুমে যে যন্ত্র দিয়ে ফরমালিন পরীক্ষা করে টনকে টন আম, জাম, লিচু ধ্বংস করা হয়েছিল, সেই যন্ত্রটি আসলে ফল পরীক্ষার জন্য নয়। হাইকোর্টের নির্দেশে দুটি সরকারি সংস্থা ফরমালিন পরীক্ষায় প্রচলিত ফরমালডিহাইড মিটার (মডেল নং জেড-৩০০) পরীক্ষা করে দেখেছে, এটি খাদ্যে ফরমালিন বা ফরমালডিহাইডের উপস্থিতির সঠিক ফলাফল দেয় না। তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, যন্ত্রটি বাতাসে ফরমালডিহাইডের মাত্রা পরীক্ষার জন্য তৈরি করা হয়েছে; ফল বা মাছ পরীক্ষার জন্য নয়।
মাছে ফরমালিন পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশে ২০১২ সালে মৎস্য অধিদপ্তর সর্বপ্রথম ফরমালডিহাইড মিটারটি আমদানি করে। এরপর ভেজালবিরোধী অভিযানে নামা সরকারি প্রায় সব সংস্থা এর ব্যবহার শুরু করে। ফরমালডিহাইড মিটার দিয়ে পরীক্ষা করে বিভিন্ন সংস্থার ভ্রাম্যমাণ আদালত গত আড়াই বছরে প্রচুর পরিমাণ ফল, মাছ ও সবজি ধ্বংস করেছে। ওই সব অভিযানে ব্যবসায়ীদের লাখ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অনেককে কারাদণ্ডও দেওয়া হয়েছে।
ফল ব্যবসায়ীদের এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২১ জুলাই হাইকোর্ট যন্ত্রটি পরীক্ষার নির্দেশ দেন সরকারের তিনটি সংস্থাকে। এর মধ্যে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) গতকাল মঙ্গলবার তাদের প্রতিবেদন রিট আবেদনকারীর আইনজীবী মনজিল মোরশেদের কাছে জমা দিয়েছে। মহাখালীর জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি তাদের প্রতিবেদন প্রস্তুত করলেও এখনো তা জমা দেয়নি। অন্যদিকে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) যন্ত্রটি পরীক্ষা করছে।
এখন পর্যন্ত তৈরি হওয়া দুটি প্রতিবেদনের একটির অনুলিপি কালের কণ্ঠের কাছে এসেছে। ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির প্রতিবেদনটির বিষয়বস্তু জানা গেছে। দুটি প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, যন্ত্রটি বাতাসে ফরমালডিহাইডের মাত্রা পরীক্ষার জন্য ব্যবহার করা হয়; খাদ্য পরীক্ষার জন্য নয়।
ফরমালিন হলো ফরমালডিহাইডের একটি দ্রবীভূত অবস্থা। এটি মৃতদেহ সংরক্ষণ করার জন্য অথবা বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহার করা হয়। বাতাসে এর মাত্রা বেশি হলে বিভিন্ন ধরনের রোগ দেখা দিতে পারে। জেড-৩০০ যন্ত্রটি শিল্প-কারখানার বাতাসে ফরমালডিহাইডের পরিমাণ পরীক্ষার জন্য ব্যবহার করা হয় বলে উল্লেখ করা আছে ওই যন্ত্রের ব্যবহার নির্দেশিকায়। বাংলাদেশে ফলমূল ও মাছ তাজা রাখতে ফরমালিন ব্যবহার করা হয় বলে সন্দেহ করে ওই যন্ত্র দিয়ে বহু ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে।
ফরমালিনবিরোধী অভিযানের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অভিযান। ডিএমপি ঢাকার চারপাশে চেকপোস্ট বসিয়ে প্রথমবারের মতো ফরমালিনবিরোধী কঠোর অভিযান শুরু করে গত ১১ জুন রাত থেকে। ওই অভিযানে যন্ত্রটি ব্যবহার করে মাত্র চার দিনে ৯ হাজার ৩০৫ মণ আম, এক হাজার ২৩৯ মণ জাম ও আনুমানিক ২৫ লাখ ৫০ হাজার লিচু, প্রায় ছয় হাজার আনারস, ৩৮০ মণ লেবু, আপেল, নাশপাতি, পেঁপে, করমচা ও লটকন জব্দ করে ধ্বংস করা হয়।
শুধু সরকারিভাবে নয়, যন্ত্রটি ব্যবহার করা হয়েছিল বেসরকারি খাতেও। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ঢাকার ১১টিসহ সারা দেশের মোট ২২টি বাজারের সমিতিকে ওই যন্ত্র দিয়ে সংশ্লিষ্ট বাজারকে ফরমালিনমুক্ত বলে ঘোষণা করেছে। এ জন্য টাকা দিয়েছে বেশ কিছু বেসরকারি ব্যাংক। বাংলাদেশে যন্ত্রটি আমদানি করছে ট্রেসার ইলেকট্রোকম। তারা যন্ত্রটির দাম রাখে এক লাখ ৩৫ হাজার টাকা।
যন্ত্রটি তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের এনভায়রনমেন্টাল সেন্সর কম্পানি। ওই কম্পানির কাছে যন্ত্রটি দিয়ে ফল ও মাছ পরীক্ষা করা যায় কি না তা জানতে চেয়ে কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে ই-মেইল করা হয়েছিল। তবে প্রায় দুই মাসেও তার কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। পরে রাজধানীর বাদামতলীর ফল ব্যবসায়ীরা ২৫টি যন্ত্র কিনতে চেয়ে এনভায়রনমেন্টাল সেন্সর কম্পানির সরবরাহকারী যুক্তরাষ্ট্রেরই আরেক প্রতিষ্ঠান কলরাইট ইনস্ট্র–মেন্টসকে ই-মেইল করে। ফিরতি ই-মেইলে কলরাইট ইনস্ট্র–মেন্টস জানায়, যন্ত্রটি ফল বা মাছ পরীক্ষার জন্য ব্যবহার করা হয় না।
ফরমালডিহাইড ভেপর মিটারের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে গত ১১ জুন কালের কণ্ঠে সর্বপ্রথম ‘ফরমালিন ধরার যন্ত্রেই গলদ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর একাধিক জাতীয় দৈনিকে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনগুলো সংযুক্ত করে হাইকোর্টে রিট করেন বাংলাদেশ ফল আমদানিকারক সমিতির সভাপতি সাধন চন্দ্র দাস ও সিরাজুল ইসলাম। তাঁদের আইনজীবী হিসেবে নিযুক্ত হন বিশিষ্ট আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি হাবিবুল গণির বেঞ্চ গত ২১ জুলাই চার সপ্তাহের মধ্যে ফরমালিন শনাক্তকরণ যন্ত্রটি পরীক্ষার প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন।
ফল আমদানিকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছিলাম, যন্ত্রটি ফল পরীক্ষার জন্য নয়। তার পরও সেই যন্ত্র ব্যবহার করে প্রচুর ফল ধ্বংস করা হয়েছে, ব্যবসায়ীদের জরিমানা করা হয়েছে। আতঙ্কের কারণে মানুষ ফল খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা এখন হাইকোর্টের রায়ের অপেক্ষায় আছি। রায় আমাদের পক্ষে এলে যন্ত্রটি কোনো ধরনের পরীক্ষা ছাড়া ব্যবহারকারীদের বিচার ও ক্ষতিপূরণ চাইব।’
মৎস্য অধিদপ্তরের ফরমালিনের ব্যবহার ও গণসচেতনতা সৃষ্টি প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে প্রতি বিভাগ ও জেলায় একটি করে ৮০টি যন্ত্র বিরতণ করা হয়েছে। ২০১২ সালের জুন থেকে গত মার্চ পর্যন্ত মৎস্য অধিদপ্তর যন্ত্রটি দিয়ে সাত হাজার ৫২৫টি অভিযান পরিচালনা করেছে। এতে ধ্বংস করা হয়েছে প্রায় ৯ হাজার ৮৩০ কেজি মাছ। এসব অভিযানে ৫৬ লাখ ৭৭ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে এবং দুজন ব্যবসায়ীকে এক মাস করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের পরিচালক জি এম সামসুল কবির বলেন, ‘আমরা একটি আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে যন্ত্রগুলো কিনেছিলাম। দেখি এখন হাইকোর্টের কী রায় আসে।’
পরীক্ষায় যা বলা হয়েছে : বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ফরমালডিহাইড ভেপর মিটারের (মডেল নং জেড-৩০০) সঙ্গে সরবরাহ করা ব্যবহারবিধি ও ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, যন্ত্রটি পরিবেশ বা বাতাসের ফরমালডিহাইড ভেপর বা বাষ্পের পরিমাণ নির্ণয়ের জন্য ব্যবহƒত সংবেদনশীল যন্ত্র, যা সঠিকভাবে বাতাসে বিদ্যমান ফরমালডিহাইড গ্যাসের পরিমাণ নির্ণয় করে থাকে।
জেড-৩০০ যন্ত্রটি ব্যবহার করে খাদ্যে বিদ্যমান ফরমালডিহাইডের পরিমাণ নির্ণয় করার জন্য যন্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের কোনো অ্যাপ্লিকেশন নোট (ব্যবহার নির্দেশিকা) পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে জানানো হয়, এ জন্য বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ ভ্রাম্যমাণ আদালতের অনুসৃত পদ্ধতি অনুসরণ করে পরীক্ষা করে দেখেছে যে যন্ত্রটি সময়, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতাভেদে ভিন্ন ভিন্ন ফলাফল প্রদান করে।
বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ নমুনা হিসেবে বাজার থেকে একই সূত্রের বিভিন্ন ফলের নমুনা সংগ্রহ করে এক অংশে ৫ শতাংশ ফরমালডিহাইডের (৩৭ শতাংশ) দ্রবণে ৩০ মিনিট ভিজিয়ে রেখে কক্ষ তাপমাত্রায় শুকায়। পরে ফরমালডিহাইড ভেজানো ফল ও ফ্রেশ ফল ভ্রাম্যমাণ আদালতের ব্যবহার করা পদ্ধতি অনুসরণ করে পলিথিন ব্যাগে ভরে কিছুক্ষণ রেখে ব্যাগের ভেতরের ফরমালডিহাইড পরীক্ষা করা হয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নমুনা পরীক্ষায় দেখা যায়, জেড-৩০০ যন্ত্রটি ফরমালডিহাইডে ভেজানো ফল ও ফ্রেশ ফলে বিভিন্ন মাত্রায় ফরমালডিহাইডের পরিমাণ নির্দেশ করে, যা সময়, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার ওপর নির্ভরশীল। উষ্ণ তাপমাত্রায় ফ্রেশ ফলেও ক্রমান্বয়ে অধিক ফরমালডিহাইডের পরিমাণ নির্দেশ করে। তাই ফল উষ্ণ থাকলে যন্ত্রটি ফরমালডিহাইডের পরিমাণ সম্পর্কে ভুল তথ্য নির্দেশ করে।
অন্য কিছু রাসায়নিককেও ওই যন্ত্র ফরমালিন হিসেবে নির্দেশ করে বলে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, অ্যাসিটোন, ফরমিক এসিড, অ্যাসিটিক এসিড ও মিথানলের উপস্থিতিতেও জেড-৩০০ মিটার ফরমালডিহাইডের পরিমাণ নির্দেশ করে। এসব রাসায়নিক প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন হয়। এসব উদ্বায়ী রাসায়নিক উপাদানের উপস্থিতিতে যন্ত্রটি ফরমালডিহাইডের পরিমাণ সম্পর্কে ভুল তথ্য দিতে পারে।
জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির পরীক্ষায়ও একই ধরনের ফলাফল ধরা পড়েছে বলে জানা গেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) অর্থায়নে তৈরি করা অত্যাধুনিক ওই পরীক্ষাগারের ‘হাইপারফরম্যান্স লিকুইড ক্রোমোটোগ্রাফি’ বা এইচপিএলসি যন্ত্রে পরীক্ষা করে একই নমুনায় আলাদা ফলাফল পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন ওই সংস্থার একজন কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘জেড-৩০০ মিটার দিয়ে পরীক্ষা করার পর আমরা একই নমুনা এইচপিএলসি যন্ত্রে পরীক্ষা করেছি। তাতে দেখা গেছে, ওই মিটার সঠিক ফলাফল দেয় না।’ এইচপিএলসি খাদ্যে রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য উন্নত ও সারা বিশ্বে স্বীকৃত একটি যন্ত্র বলে উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের বলা হয়েছে ফল ও খাদ্য পরীক্ষা করতে। আমরা দুটি যন্ত্র দিয়ে ফল, মাছসহ অন্যান্য খাদ্য পরীক্ষা করে দেখেছি যে জেড-৩০০ মিটার দিয়ে সঠিক ফল পাওয়া সম্ভব নয়।’
কিছু রাসায়নিক খাদ্যে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন হয় বলে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, ওই সব রাসায়নিককেও যন্ত্রটি ফরমালিন হিসেবে দেখায়। প্রাকৃতিকভাবে ফল ও মাছে থাকা ফরমালিন যন্ত্রটি আলাদা করতে পারে না।
শিরোনাম:
শুক্রবার , ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ , ২ ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।