চাঁদপুর: চাঁদপুর-শরীয়তপুর ফেরিঘাটের নরসিংহপুর অংশে পন্টুন সমস্যায় যেকোনো সময় বন্ধ হতে পারে ফেরি চলাচল।
প্রতিদিনই জোয়ারের সময় নামতে বা উঠতে গিয়ে ২/৪টি গাড়ি নষ্ট হচ্ছে। ফলে গাড়ির চালক-মালিকরা ২/১ দিনের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানা গেছে। ঈদ মৌসুমের আগে এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ কোনো ব্যবস্থা না নিলে তারা এ ঘাট বর্জন করবে।
এরমধ্যে ‘মরার উপর খরার ঘা’র মতো গতরাতে ফেরি ‘কস্তুরি’ বিকল হয়ে গেছে। ফলে একটি ফেরি দিয়ে গাড়ি পারাপার করে কোনো রকমে সার্ভিস চালু রাখা হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএর উদাসীনতায় প্রায় ৯ মাস ধরে ওই ঘাটে পন্টুনের সমস্যার কারণে গাড়ি পারাপার অর্ধেক কমে গেছে। জোয়ারের সময় পন্টুন মাটি থেকে ৫/৬ ফুট উপরে উঠে যাওয়ায় ৬/৭ মাস ধরে এ সমস্যা দেখা দিয়েছে।
ফেরি পারাপারের জন্য দু’পাড়ে কমপক্ষে শতাধিক গাড়ি লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। জোয়ার শেষে ভাটা শুরু হলে ফেরি চলাচল শুরু হয়। এছাড়া এ ফেরিরুটে মার্কা, বিকন ও বাতি ঠিকমতো না থাকায় রাতের বেলা ফেরি চলাচলে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে মাস্টারদের। তারা অনুমান করে ফেরি চালানোয় ঝুঁকিতে থাকে যাত্রীরা।
এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জানায়, এগুলো সর্বক্ষণ মনিটরিং করার বাজেট নাই। তাই তারা সবসময়ই তা ঠিক রাখতে পারেনা।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের সহজ যোগাযোগের জন্য ২০০১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাঁদপুর-শরীয়তপুর ফেরিঘাটের উদ্বোধন করেন। দু’অঞ্চলের যোগাযোগের যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে সড়কের দূরত্ব অনেক কমে যায়।
উদ্বোধনের সময় এখানে দেয়া হয় দুটো ‘রো রো’ ফেরি। কয়েক মাস পর গাড়ি পারাপারের সংখ্যা কম হওয়ায় তা প্রত্যাহার করে দু’টি ছোট ফেরি দেয়া হয়। ২/৩ বছর ধরে এখানে ২টি ‘কে’ টাইপ ফেরি দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলোও মাঝে-মধ্যে বিকল হয়ে যায়। ফলে টেনে-হেঁচড়ে চালাতে হয় ফেরিঘাট।
এ ঘাট চালু হবার কারণে চট্টগ্রাম/কক্সবাজার থেকে খুলনায় চলাচলকারী গাড়ির দেড় থেকে দুইশ’ কিলোমিটার রাস্তা কমে যায়। অপরদিকে ঢাকার যানজট ও আরিচা বা মাওয়া ফেরিঘাটের ভোগান্তি থেকে রক্ষা পায় তারা।
কিন্তু উদ্বোধনের পর থেকে এ ঘাটের দিকে সরকারের বিশেষ নজর না থাকায় অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। প্রতি বছরই বিআইডব্লিউটিএ ডেজিংয়ের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। বছরের অধিকাংশ সময়ই নাব্যতা না থাকায় বিকল্প রুটে চলাচল করতে হয় ফেরিগুলোকে। এতে ১ ঘণ্টার পথ যেতে সময় লাগে ২ থেকে ৩ ঘণ্টায়।
এছাড়া লক্কর-ঝক্কর মার্কা ফেরি দেয়ায় সেগুলো প্রায়ই থাকে নষ্ট। চলাচলের অযোগ্য ফেরিগুলোতে প্রায়ই ভোগান্তিতে পড়তে হয় যাতায়াতকারীদের। যদিও চলতি বছর এ ঘাটে একটি নতুন ফেরি দেয়ার কথা রয়েছে।
চট্টগ্রাম-চাঁদপুর-শরীয়তপুর-খুলনা রুটের রাস্তা এবং শরীয়তপুরের আঙ্গারিয়া ব্রিজের জন্য প্রায়ই গাড়ি আসতে পারেনা। এ রুটের রাস্তাগুলো অধিকাংশই ভঙ্গুর এবং চলাচলের অযোগ্য। তারপরও যানজট এবং ভোগান্তি কমাতে অনেকে এ রুটে এসে আরও বেশি ভোগান্তিতে পড়েন।
এছাড়া রয়েছে চাঁদাবাজির সমস্যা। এ ঘাটের চাঁদপুর হরিণা অংশের ইজারাদারের লোকজন চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদকপাচারসহ যাত্রীদের হয়রানী করে প্রতিনিয়ত। ইজারাদার ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা হওয়ায় তাদের অত্যাচারের প্রতিবাদ করার কেউ সাহস পায়না। কেউ প্রতিবাদ করতে গেলে তাকে মারধরসহ বিভিন্ন হয়রানী করে তারা।
গত বছর নভেম্বরের শেষদিকে মাসখানেকের কথা বলে শরীয়তপুর নরসিংহপুর ঘাটের পন্টুনটি মেরামতের জন্য নেয়া হয়। বিআইডব্লিউটিএ নতুন সেখানে পন্টুন স্থাপন করে ২০ ফুট র্যামবিশিষ্ট। ফলে জোয়ার হলেই র্যাম মাটি থেকে ৪/৫ ফুট উপরে উঠে যায়। সে কারণে জোয়ারের সময় ফেরি থেকে গাড়ি নামতে বা উঠতে পারেনা।
কয়েক মাস ধরে জোয়ারের সময় এ সমস্যা নিয়ে ফেরি চলাচল করছে। দিনের ২৪ ঘণ্টায় যেখানে ৮ থেকে ১০ বার একটি ফেরি আসা-যাওয়া করতে পারতো, সেখানে এখন ৪ থেকে ৫ বার আসা-যাওয়া করছে।
এছাড়া নদীতে রয়েছে মাছ ধরা জাল নিয়ে সমস্যা। জেলেরা ফেরি চলাচলের রুটে ইচ্ছোমতো জাল ফেলে রাখে। ফেরির প্রপেলরে জাল আটকে চলাচল ব্যাহত হয়।
ঘাটের নিরাপত্তায় নেই কোনো নিরাপত্তা প্রহরী। উদ্বোধনের পর ঘাটের দু’টি অংশেই আনসার সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকলেও অদৃশ্য কারণে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে তা প্রত্যাহার করা হয়। এখন সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে কেউই নেই। ফলে যে যার ইচ্ছেমতো অপরাধ করে বেড়ায়। ছিনতাই, চাঁদাবাজি হলেও কারো কিছু করার থাকেনা।
চাঁদপুর ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক মো. ইমরানের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, ফেরি চলাচলে বিআইডব্লিউটিএ নির্ধারিত সময়ে ড্রেজিং না করায় দ্বিগুণেরও বেশি সময় নিয়ে চলাচল করছে। এছাড়া নরসিংহপুর ঘাটের পন্টুন সমস্যার কারণে ফেরি চলাচলও অর্ধেকে নেমে এসেছে।
নিরাপত্তার জন্য সেখানে আনসার ক্যাম্প স্থাপন জরুরি বলে তিনি জানান।
বিআইডব্লিউটিএর ঊর্ধ্বতন উপপরিচালক মো. শাহজাহান জানান, পন্টুনের ওয়ার্কঅর্ডার হয়ে গেছে। আশা করা যায় দু’মাসের মধ্যেই তা চলে আসবে। ফেরি রুটের সরাসরি চ্যানেলে পানি পর্যাপ্ত না থাকায় প্রায় ৫ কিলোমিটার বেশি পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। ড্রেজিং হলে ১০ কিলোমিটার পথ চলাচল করতে পারতো। এতে সময় এক ঘণ্টারও কম লাগতো। চলতি বছর ড্রেজিং না হওয়ায় বিকল্প পথে ফেরি চলতে হচ্ছে।
ফেরিঘাটের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান মো. মজিবুর রহমানের (অতিরিক্ত সচিব) সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, বিষয়টি যেহেতু বিআইডব্লিউটিএর তাই তিনি ওই সংস্থার চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।