এম.সাখাওয়াত হোসেন (মিথুন) : সে ষাটের দশকের সহপাঠী বান্ধবীদের কাছে পেয়ে আনন্দের কমতি ছিলো না। যেনো বাঁধভাঙ্গা আনন্দ। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ষাটোর্ধ্ব-সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধারাও যেনো সে শিশু বয়সে ফিরে গেছেন। প্রথম শিক্ষা জীবনের বন্ধুদের কাছে পেয়ে তারা এতোটাই আনন্দিত ও আবেগাপ্লুত হয়েছেন যে, অনেকে চোখের পানি আটকে রাখতে পারেননি। করেছেন পুরানো দিনের স্মৃতি রোমন্থন। যে স্মৃতিতে ছিলো শুধু দুষ্টুমি আর আনন্দ। এ মধুরেণ পরিবেশ ছিলো চাঁদপুরের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ লেডী প্রতিমা মিত্র বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭৫ বছর পূর্তি উৎসব উপলক্ষে প্রাক্তন ছাত্রীদের পুনর্মিলনীতে।
গতকাল ২১ ডিসেম্বর শুক্রবার বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে দিনব্যাপী ব্যাপক অনুষ্ঠানমালার মধ্য দিয়ে উদ্যাপিত হয় এ উৎসব। বর্ণাঢ্য র্যালী, সম্মাননা, স্মৃতিচারণ, খেলাধুলা, আড্ডা, মধ্যাহ্ন ভোজ, চা চক্র, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গজল সন্ধ্যা,র্যাফেল ড্র সব মিলিয়ে এক আনন্দঘন পরিবেশ ছিলো। প্রথমে সকাল পৌনে ৯টায় র্যালী উদ্বোধন ঘোষণা করেন বিদ্যালয়ের ১৯৫৬ সালের ছাত্রী মিসেস লজ্জাতুন নেছা। তিনি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রেখে ও পায়রা উড়িয়ে র্যালী উদ্বোধন করেন। সাথে ছিলেন বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও উৎসব উদযাপনব পরিষদের চেয়ারম্যান এমএ মাসুদ ভূঁইয়া। এর আগে বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী ও উৎসব উদযাপনব পরিষদের সদস্য সচিব কৃষ্ণা সাহাসহ তার দলের পরিবেশনায় জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন উৎসব অনুষ্ঠানের সভাপ্রধান নুরুল হক বাচ্চু মিয়াজী ও বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ফাতেমা ইয়াছমিন এবং উৎসবের পতাকা উত্তোলন করেন চাঁদপুর পৌরসভার মেয়র নাছির উদ্দিন আহমেদ। এরপর র্যালী বের হয়। র্যালী শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদৰিণ করে পুনরায় বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে শেষ হয়।
এরপর অনুষ্ঠিত হয় উদ্বোধনী পর্ব ও সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠান। এ পর্ব উপস্থাপনায় ছিলেন চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক রোটারিয়ান কাজী শাহাদাত। এ পর্বের শুরুতে কৃষ্ণা সাহা, রুমা সরকার, অনিতা কর্মকার ও নিপাসহ অন্যরা সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এরপর সমবেত কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ গানটি গাওয়া হয়। এ সময় অনেকে আবেগাপস্নুত হয়ে কেঁদে ফেলেন। এরপর এ বিদ্যালয়ের প্রয়াত শিক্ষক ও বিশিষ্ট জনদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। উদ্বোধনী পর্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিৰিকা ফাতেমা ইয়াছমিন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তাঁর বক্তব্যের পর শুরু হয় সম্মাননা প্রদান। প্রথমে বিদ্যালয়ের প্রয়াত শিৰিকাদের মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করা হয়। সাবেক প্রয়াত প্রধান শিৰিকা মোমেনা খাতুন, সহকারী শিৰিকা জাহানারা বেগম ও ক্রীড়া শিৰিকা ছমিরুন্নেছাকে মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করা হয়। প্রয়াত শিক্ষিকা জাহানারা বেগমের সম্মাননা ক্রেস্ট গ্রহণ করেন তাঁর তৃতীয় ছেলে জেলা আইনজীবী সমিতি ও চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি, চাঁদপুর কণ্ঠের প্রতিষ্ঠাতা, সম্পাদক ও প্রকাশক আলহাজ্ব অ্যাডঃ ইকবাল-বিন-বাশার। এ সময় তিনি আবেগাপস্নুত হয়ে যান।
এ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক, শিক্ষিকা ও সহকারী শিৰক-শিক্ষিকাদের সম্মাননা ও উত্তরীয় প্রদান করা হয়। এ সময় মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন অনুষ্ঠানের সভাপ্রধান চাঁদপুর পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল হক বাচ্চু মিয়াজী, উৎসব চেয়ারম্যান এমএ মাসুদ ভূঁইয়া, আলহাজ্ব ডাঃ এমএ গফুর, মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক নূর খান, হাসান আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ হোসেন, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকা ফাতেমা ইয়াছমিন ও উৎসব সদস্য সচিব কৃষ্ণা সাহা। সংৰিপ্ত প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বক্তব্য রাখেন অ্যাডঃ ইকবাল-বিন-বাশার, প্রাক্তন শিৰক পুলিন কৃষ্ণ ঘোষ ও নারায়ণ চন্দ্র মজুমদার।
স্মৃতিচারণ পর্বে বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী ও শিৰিকাদের মধ্যে স্মৃতিচারণ করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক পরিচালক রওশন আরা বেগম রুশু, বাংলাদেশ বেতারের সাবেক পরিচালক রওশনারা কবির, ঢাকা হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ তাহমিনা বেগম, ঢাকা বদরুন্নেছা সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক জিনুন নাহার, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডঃ নূরজাহান বেগম মুক্তা, অ্যাডঃ আলেয়া বেগম, ফয়জুন নাহার চৌধুরী, ফজিলাতুন নাহার (আবু আপা) ও প্রাক্তন শিৰিকা মনোয়ারা বেগম। এ স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় ছিলেন বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী ফারহানা পুষ্টি। এ স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানের ফাঁকে বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন ৰেত্রে যাঁরা অবদান রেখেছেন তাঁদের সম্মাননা প্রদান করা হয়। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন- বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী, উপ-সহকারী কমিশনার (কাস্টমস্) বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহসেনা বেগম, রওশনারা কবির, রওশনারা বেগম রুশু, ডাঃ তাহমিনা বেগম, সাবেক এএসপি রাশিদা সিদ্দিকী, বাংলাদেশ বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক সাংবাদিক দিলরুবা বেগম, বিশিষ্ট গাইনী বিশেষজ্ঞ ডাঃ ফাতেমা খাতুন, সাবেক এএসপি ডলি বেগম প্রমুখ।
এ ছাড়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গজল সন্ধ্যা, খেলাধুলা ও দিনব্যাপী আড্ডা হয়। সবশেষে র্যাফেল ড্র অনুষ্ঠিত হয়। দিনব্যাপী এসব অনুষ্ঠানে সে ষাটের দশক থেকে শুরু করে সদ্য বিদায়ী ছাত্রীরা নেচে গেয়ে মেতে উঠে। সব মিলিয়ে প্রাণবনত্দ ছিলো উৎসবটি। প্রাক্তন শিৰার্থীরা প্রতিক্রিয়া ও স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, এমন উৎসব ও পুনর্মিলনী মনের খোরাক। এ বয়সে এটা আমাদের দরকার ছিলো। আজ আমরা যেনো শৈশবে-কৈশোরে ফিরে গেছি। সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসক মোঃ ইসমাইল হোসেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন।