নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পরও সারা দেশে শতভাগ সরবরাহ করা হয়নি মাধ্যমিকের পাঠ্য বই। প্রাথমিকের বই সরবরাহে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হলেও সবচেয়ে পিছিয়ে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্য বই সরবরাহ। ঢাকার বাইরে বিভাগীয় পর্যায়ে এই সংকট তীব্র।
বিভিন্ন জেলা থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, প্রাথমিকের বই জেলাভেদে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পৌঁছেছে।
তবে বইয়ের সংকট হবে না জানিয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মাধ্যমিকের ৭৯ শতাংশ বই সারা দেশে পৌঁছে গেছে। প্রাথমিকের বই পাঠানো হয়েছে ৬৪ শতাংশ।
দুই দিন পর ১ জানুয়ারি সারা দেশে একযোগে উদযাপন হতে যাচ্ছে বই উৎসব। আগামীকাল ৩১ জানুয়ারি বই উৎসব উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সকাল ১০টায় সব শ্রেণির একজন করে শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেওয়া হবে এক সেট করে পাঠ্য বই। ১ জানুয়ারি সারা দেশে একযোগে বই উৎসব উদযাপন করা হবে। গাজীপুরের কাপাসিয়ায় শিক্ষামন্ত্রীর উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয়ভাবে উদযাপিত হবে মাধ্যমিকের বই উৎসব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে প্রাথমিকের বই উৎসব উদযাপন করবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
জেলা পর্যায়ে প্রাথমিকের বই সংকট : খুলনা বিভাগের ১০টি জেলা পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রাথমিকের মোট চাহিদার মাত্র ৪০ শতাংশ বই পৌঁছেছে। বিভাগটিতে প্রাথমিক স্তরের মোট ২০ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য প্রয়োজন ৮০ লাখ পাঠ্য বই, এর মধ্যে মাত্র ৩০ লাখ সরবরাহ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলায় চাহিদার মাত্র ২৬.৩ শতাংশ বই পৌঁছেছে।
জেলা পর্যায়ে মোট ৪৫ লাখ ২২ হাজার ১০৯টি বইয়ের চাহিদা থাকলেও এ পর্যন্ত ১১ লাখ ৮৯ হাজার ৮৫১টি সরবরাহ করা হয়েছে। ময়মনসিংহ জেলায় এ স্তরের পাঠ্য বই পৌঁছেছে মাত্র ৩০ শতাংশ। জেলায় মোট পাঠ্য বইয়ের চাহিদা ৩৭ লাখ ৭০ হাজার। নেত্রকোনায় প্রাথমিকের পাঠ্য বই পৌঁছেছে মাত্র ২০ শতাংশ। জেলায় মোট বইয়ের চাহিদা ১৬ লাখ ৬৩ হাজার ৮৪৮টি। এর মধ্যে সরবরাহ করা হয়েছে তিন লাখ ২৬ হাজার ২৭০টি পাঠ্য বই।
সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা বইয়ের সংখ্যা নিশ্চিত করে বলেন, আশা করা হচ্ছে, বই উৎসবের আগেই প্রয়োজনীয়সংখ্যক পাঠ্য বই পাওয়া যাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গতকাল পর্যন্ত মাধ্যমিক, দাখিল, ইবতেদায়ি, ভোকেশনাল ও কারিগরি স্তরের ৭২.৪৮ শতাংশ বই সারা দেশে পৌঁছেছে। এ স্তরে মোট ২৩ কোটি ৮২ লাখ ৭০ হাজার ৫৮৮টি বইয়ের মধ্যে সরবরাহ করা হয়েছে ১৭ কোটি ২৬ লাখ ৯৭ হাজার ৪৫টি। তবে প্রস্তুতকৃত বইয়ের সংখ্যা ১৮ কোটি চার লাখ ৯৬৮টি। একই সময়ে সারা দেশে প্রাথমিকে ৬০.৫১ শতাংশ পাঠ্য বই পাঠানো হয়েছে। এ বছর মোট ৯ কোটি ৬৬ লাখ আট হাজার ২৪৫টি বইয়ের মধ্যে সরবরাহ করা হয়েছে পাঁচ কোটি ৮৪ লাখ ৫৩ হাজার ৩৫৫টি পাঠ্য বই। তবে প্রস্তুতকৃত বইয়ের সংখ্যা ছয় কোটি ১৭ লাখ ৬৮ হাজার ৩১১টি।
মেয়াদ শেষেও মিলছে না শতভাগ বই : মাধ্যমিক (বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন) ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি, দাখিল স্তরের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি, ইবতেদায়ি (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি), শিক্ষক নির্দেশিকা এবং কারিগরি স্তরের বই ছাপার সময়সীমা শেষ হয়েছে গত ২২ ডিসেম্বর। নির্ধারিত সময়ে বই সরবরাহ করা হয়েছে ৬৬.৭৭ শতাংশ। এ স্তরে মোট ১১ কোটি ৩০ লাখ ৯৩ হাজার ১৮৮টি বইয়ের মধ্যে ছাপা হয়েছে মাত্র সাত কোটি ৫৫ লাখ ১১ হাজার ১৪৩টি বই। তবে মোট প্রস্তুতকৃত বইয়ের সংখ্যা আট কোটি ৬৮ হাজার ১৯৮টি। এ পর্যায়ে মোট ১৮২টি লটে ৫৬ প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল।
মাধ্যমিক (বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন) স্তরের অষ্টম ও নবম শ্রেণি, দাখিল স্তরের অষ্টম ও নবম শ্রেণি, ইবতেদায়ি স্তরের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি এবং এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনাল পর্যায়ের বই ছাপার সময়সীমা শেষ হয়েছে ২৫ ডিসেম্বর। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গতকাল পর্যন্ত বই সরবরাহ করা হয়েছে ৭৭.৬৪ শতাংশ। এ স্তরে মোট ১২ কোটি ৫১ লাখ ৭৭ হাজার ৪০০টি বইয়ের মধ্যে সরবরাহ করা হয়েছে ৯ কোটি ৭১ লাখ ৮৫ হাজার ৯০২টি। তবে প্রস্তুত করা হয়েছে ১০ কোটি তিন লাখ ৩২ হাজার ৭৭০টি পাঠ্য বই। এ বছর ৫৭টি প্রতিষ্ঠানকে ২৮০টি লটের মাধ্যমে এ কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে।
সংকট বেশি প্রাথমিকে : প্রাথমিকের (বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন) স্তরের তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্য বই সরবরাহের চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে ১ জানুয়ারি। আর মাত্র দুই দিন বাকি। গতকাল পর্যন্ত এ স্তরের পাঠ্য বই সরবরাহ করা হয়েছে মাত্র ৫৮.৩৮ শতাংশ, যা সরবরাহের দিক থেকে সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে। এসব শ্রেণির জন্য মোট ছয় কোটি ৬৪ লাখ ৩৩ হাজার ৪৫৮টি বইয়ের মধ্যে সরবরাহ করা হয়েছে তিন কোটি ৮৭ লাখ ৮২ হাজার ২৭০টি। প্রস্তুতকৃত বইয়ের সংখ্যা চার কোটি সাত লাখ ৫৬ হাজার ২১।
প্রাথমিকের (বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন) স্তরের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির মোট ৫৯.৫১ শতাংশ পাঠ্য বই সরবরাহ করা হয়েছে। এ বছর মোট দুই কোটি ৩৬ লাখ ৩৩ হাজার ৫২৬টি পাঠ্য বইয়ের মধ্যে সারা দেশে পাঠানো হয়েছে এক কোটি ৪০ লাখ ৬৩ হাজার ৯৯৫টি। তবে প্রস্তুতকৃত বইয়ের সংখ্যা এক কোটি ৫২ লাখ ৩৩ হাজার ৩২৪। ১৭ জানুয়ারির মধ্যে শতভাগ বই সরবরাহের চুক্তিতে ৯৮ লটে ২৪ প্রতিষ্ঠানকে এ কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে।
সংকটের কারণ সম্পর্কে অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, ‘দেশে কাগজ তৈরির ভার্জিন পাল্প না থাকা, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, টেন্ডারপ্রক্রিয়ায় ধীরগতি এবং বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটের কারণে এ বছর নির্ধারিত সময়ে বই পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়। টেন্ডারপ্রক্রিয়ার (আন্তর্জাতিক বা দেশীয়) কারণেও দুই মাস সময় পার হয়েছে।
প্রাথমিকের বই ছাপা নিয়ে এই সংকট ছিল আরো তীব্র। নির্ধারিত দরে বই ছাপা এবং সঠিক সময়ে অর্থ পাওয়া নিয়ে সংশয়ে ছিল মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো। ৩ ডিসেম্বর এক বৈঠকের মাধ্যমে এসব সমস্যা সমাধান করে প্রাথমিকের বই ছাপার কাজ শুরু করা হয়। নির্ধারিত সময়ে প্রাথমিকের বই পেতে আমরা মাধ্যমিকের বইয়ের কাজ কিছুটা কমিয়ে প্রাথমিকের বই ছাপায় গুরুত্ব দিয়েছি। ’