বাঙ্গালীর মহান বিজয় ৪৪ বছর পেরিয়ে ৪৫ বছরে পদার্পণ করেছে। এরই মাঝে উন্নতি-অবনতির সালতামামি পূর্ণ হয়েছে স্বাধীন দেশ জুড়ে। গড়েছে কীর্তিময় বহু ইতিহাস। সৃষ্টি হয়েছে নতুন-নতুন অধ্যায়। বাঙ্গালীরা চষে বেড়াচ্ছেন বিশ্বজুড়ে। এসবই বর্তমান। অতীত বড়ই নিষ্ঠুর। ১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধ। বাঙ্গালী নিধন। তাঁরা শহীদ। এই যা ফেলে আসা যতো অতীত। পেছনে তাকানোর কি সুযোগ আছে ? কোথায় শহীদদের কবর-কে নেবে তার খবর? অবহেলা আর অযতেœ মুছে যাচ্ছে গণ-কবরের চিহ্ন। আগামী প্রজন্ম হয়তো ওই স্থানে বাড়ি-ঘর নয়তো দোকান-পাট তৈরী করে নিজের স্বার্থ সাধন করবে। বুঝবে কি তারা স্বাধীনতার সাথে একই সুতোয় গাঁথা শহীদদের আত্মা। সে শহীদদের গণ-কবর চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার বর্তমান আহম্মদ নগরে অবহেলায় আর অযতেœ পড়ে রয়েছে।
সরজমিনে দেখা যায়, ওই গ্রামের পশ্চিম ভূঁইয়া বাড়ির সামনে পাকা রাস্তার পাশে ৭ জনের একটি গণ-কবর অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে। একই গ্রামের কাচারি বাড়ি ও পাটওয়ারী বাড়ির মাঝামাঝি পুকুর পাড়ে ১০ জনের একটি গণ-কবর রয়েছে। সেখানে নেই কোনো চিহ্ন-নেই কোনো যতœ। রয়েছে খড়ের গাদা আর ঁেবধে রাখা গরু।
কাচারি বাড়ির পাক-হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হাসান আহম্মদের পুত্র শামছুল আলম এ ব্যাপারে বলেন, ৭১ সালের ৯ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সকালে লাকসাম থেকে ৩শতাধিক পাক-বাহিনী শাহরাস্তির কাইথড়া (বর্তমান আহম্মদ নগর) গ্রামের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়ে নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও যুবকসহ ৩৯ জন নিরস্ত্র স্বাধীনতাকামীকে শহীদ ও ১০/১২ জনকে গুরুতর আহত করে। ওই শহীদদের সারিতে একই বাড়ির ৮/১০ জন আর একই পরিবারের ৫/৬ জন হতাহত রয়েছে। সেদিন আমার পিতা হাসান আহম্মদও (পুলিশের সাবেক আইজিপি মরহুম হোসেন আহম্মদের ভাই) তাদের গুলিতে শহীদ হন। পাক-বাহিনী চলে যাওয়ার পর আমরা শহীদদের গণ-কবরের মাধ্যমে সমাহিত করি। এ ঘটনার পরদিন মেহের ষ্টেশনে যৌথ বাহিনীর কাছে পাক-বাহিনীর সদস্যরা আতœসমর্পণ করে।
ভূঁইয়া বাড়ির সেকান্দর আলী বলেন, এলাকা শত্রুমুক্ত হওয়ার ১ দিন আগে পাক-হানাদারদের বর্বোরচিত হামলায় অসহায় মানুষগুলো প্রাণ হারায়। এর মধ্যে আমাদের বাড়ির ৭ জন শহীদ রয়েছে।
এলাকার বয়োজৈষ্ঠদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, ওই দিন পাক-হানাদার বাহিনীর সদস্যরা রাস্তায়, বাড়িতে যাকে যে ভাবে দেখেছে-সে ভাবেই নির্বিকারে গুলি করে হত্যা করেছে। নিহতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, আবদুল আজিজের পুত্র হাসান আহম্মদ, ছিয়া গাজীর পুত্র ওসমান আলী, তার পুত্র মোহাম্মদ আলী, আইয়ুব আলীর স্ত্রী আছমতের নেছা, তার পুত্র মোশারফ হোসেন, অজ্ঞাত-খায়রুল বাসার, আবদুল আজিজের পুত্র রঞ্জন আলী, তার পুত্র আবু তাহের, শিশু হাসান ও রৌশনআরা, মোহাম্মদ আলীর তিন কণ্যা-খুরশিদা, কুলসুম, ফাতেমা, ইয়াছিন গাজীর পুত্র আবদুল মজিদ-তার পুত্র, কালা গাজী, জয়নাল আবেদীনের স্ত্রী রঞ্জন বানু, শিশু কণ্যা সাফিয়া খাতুন, আলী আকবরের পুত্র নুরুল ইসলাম। এছাড়া সেদিন যাঁরা গুলিবিদ্ধ হয়ে জীবন-মরণের সাথে যুদ্ধ করে এখনো টিকে আছেন তাদের মধ্যে কালা গাজীর স্ত্রী আতরের নেছা, পুত্র কোরবান আলী, মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী জয়গন বানু-পুত্র আবুল হাসেম, ওসমান আলীর স্ত্রী চান বানু, আবদুল মজিদের পুত্র জয়নাল আবেদীন ও তার পুত্র মোবারক হোসেন এবং রঞ্জন আলীর পুত্র মোহাম্মদ হোসেন।
শহীদ মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী সত্তোরোর্ধ বৃদ্ধা জয়গুন বানু বলেন,সেদিন তারা হঠাৎ আমাদের বাড়িতে আক্রমন করে। কিছু না বলেই আমার স্বামী ও ৩ শিশু কণ্যাকে হত্যা করে তারা। সেই সাথে আমি ও আমার পুত্র আবুল হাসেম গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচে যাই। আমার শরীরের ৩ স্থানে গুলি লাগে এবং পুত্র হাসেমের মাথার খুলি ফেটে গুলি বের হওয়ায় সে বেঁচে যায়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও জানান, ওই সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাহায্য পেয়েছি নগদ টাকা আর এক বান্ডেল টিন। তারপর আর কোনো সহযোগিতা পাই নি।
শহীদ জাকিরের বৃদ্ধা মা রেজিয়া বেগম বলেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে, নতুন রুপে গড়েছে দেশ-ফিরেনি আমার পুত্র-ফিরেনি আমার ভাগ্য। আজও পড়ে আছি এই কুড়ে ঘরে-কেউ নেয়না খবর। গণ-কবরে শহীদদের সাথে গুমিয়ে আছে আমার বাছা। আজ আপনারা এতো বছর পর আমার ছেলের খবর নিতে এসেছেন, জানতে এসেছেন শহীদ জাকিরের মা কেমন আছেন-এ কথা বলতেই তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
শাহরাস্তি উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আঃ মান্নান বিএসসি বলেন, দেশ স্বাধীন হলেও ঘটেনি মনুষত্বের বিকাশ। সব বিভাগে উন্নতি হলেও নজরদারিতার অভাবে অযতেœ অরক্ষিত হয়ে পড়ে আছে শহীদদের গণ-কবরটি। সম্মান ও শ্রদ্ধা সহকারে তাঁদেরকে স্মরণ রাখতে চাঁদপুর জেলা কমান্ডার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এম এ ওয়াদুদ ও উপজেলা কমান্ডার রুহুল আমিন সাহেবের সহযোগিতায় সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের নজরদারিতা অত্যন্ত প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
শাহরাস্তি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোঃ রুহুল আমিন বলেন, গণ-কবরের বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত রয়েছেন। শারিরীক অসুস্থতার কারণে তিনি আর কোনো কথা বলেন নি।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মোঃ রাসেদুজ্জামান চৌধুরী বলেন, বিষয়টি আমি অবগত হয়েছি। তবে সমাজসেবা কার্যালয়ে এমন তথ্য নেই। শহীদদের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে সব ধরণের ব্যবস্থা নেয়া হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ সামিউল মাসুদ জানান, বিষয়টি অনাকাঙ্খিত। খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
চাঁদপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এমএ ওয়াদুদ জানান, ৯ ডিসেম্বর শাহরাস্তির আহম্মদ নগরে গণহত্যা হয়েছে। এটি চাঁদপুরের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে। গণ-কবরটির ব্যাপারে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সরকার গণ-কবর সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসন তথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রতিবেদন পাঠালে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
শিরোনাম:
রবিবার , ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ , ৯ আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।