আর ক’দিন পরই ঈদুল আজহা। শেষ মুহূর্তে এসে নিষিদ্ধ ডাইক্লোফেন ও স্টেরয়েড হরমোন জাতীয় ইনজেকশন প্রয়োগ করে দেশে গরু মোটাতাজা শুরু হয়েছে। এবার খামারিরা এসব ইনজেকশন দিচ্ছে ভারত ও মিয়ানমার থেকে আসা গরুগুলোকে।
সুস্থ ও রোগমুক্ত রাখার দোহাই দিয়ে পাইকারিভাবে বিক্রির জন্য আসা এসব গরু মোটাতাজা হচ্ছে সীমান্ত সংলগ্ন খামারগুলোতে। তারপর তা চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। দেশে এ ধরনের খামারের সঠিক পরিসংখ্যান ও নিবন্ধন এবং সীমান্ত এলাকাগুলোয় যথাযথ দেখভাল না থাকায় কার্যকর কোনো আইনি পদক্ষেপও নিতে পারছে না প্রাণিসম্পদ অধিদফতর।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক অজয় কুমার রায় বলেন, সাধারণত সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতেই কৃত্রিম উপায়ে গরু মোটাতাজা করা ও এসব নিষিদ্ধ ওষুধের বাজারজাতকরণ হয়। এজন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের সতর্ক রাখা হয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহে বেশকিছু ওষুধ জব্দও করা হয়েছে। তারপরও চোরাইপথে এসব ওষুধ ঢুকছে ও প্রয়োগ হচ্ছে। এক্ষেত্রে সবাইকে সচেতন হতে হবে। অধিদফতরের উত্পাদন শাখার পরিচালক লিয়াকত আলী বলেন, গরুর খামারের কোনো নিবন্ধন না থাকায় দেশে কতটি খামার রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ফলে খামারগুলো যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারছি না আমরা।
ঢাকা কেন্দ্রীয় পশু হাসপাতালের প্রধান প্রাণী রোগ চিকিত্সক এবিএম শহীদুল্লাহ বলেন, ডাইক্লোফেন ও স্টেরয়েড হরমোন জাতীয় ইনজেকশন ‘পশুসম্পদ আইন-২০১০’-এ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু তা কেউ মানছে না। এ নিয়ে সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে প্রাণী রোগ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ইনজেকশন প্রয়োগ করা গরুর মাংস একদিকে যেমন
মানবদেহের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনি এসব মৃত প্রাণীর মাংস খাওয়ার ফলে বিলুপ্ত হচ্ছে খাদ্যশৃঙ্খল রক্ষাকারী নানা প্রাণী। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে গরু দেশে প্রবেশের পরপরই সীমান্ত সংলগ্ন বিভিন্ন খামারে রাখছেন পাইকাররা। পরে অল্প সময়ের মধ্যে গরু মোটাতাজা করতে এসব নিষিদ্ধ ইনজেকশন প্রয়োগ করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে সীমান্তবর্তী জেলা যশোর, সাতক্ষীরা, সৈয়দপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, নাটোর, নওগাঁ, ময়মনসিংহ, লাকসাম ও মেহেরপুরে। এসব সীমান্ত দিয়ে নিষিদ্ধ সব ইনজেকশনও দেশে ঢুকছে।
কেন এই ইনজেকশন : ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের প্যাথলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. আবু হাদী নূর আলী খান বলেন, খুব অল্প সময়ে মোটাতাজা করতে শেষ মুহূর্তে এসে এসব ক্ষতিকর নিষিদ্ধ ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়। এতে গরুর ওজন ও দৈহিক সৌন্দর্য বাড়ে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা এসব পশুর ব্যথাও নিরাময় হয়। এসব ইনজেকশন প্রয়োগের ফলে মাত্র এক সপ্তাহেই একটি পশুর ওজন বেড়ে দাঁড়ায় ১৫-২০ কেজি বেশি। আকর্ষণীয় হয় দৈহিক গড়ন। ফলে আকৃষ্ট হয়ে চড়া দামে হুমড়ি খেয়ে কেনেন ক্রেতারা।
এসব ইনজেকশন ব্যবহার প্রাণী ও মানবদেহের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ-বললেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিওলজি ও ফার্মাকোলজি বিভাগের প্রধান ড. একেএম সাইফুদ্দিন।
তিনি জানান, এসব ইনজেকশন প্রয়োগ করা প্রাণীর মাংস খেয়ে একদিকে যেমন কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ, তেমনি বিলুপ্ত হচ্ছে খাদ্যশৃঙ্খল রক্ষার উচ্চস্তরের প্রাণী শকুন। শকুনের অ্যানথ্রাক্স, ক্ষুরাসহ প্রাণী দেহে দেখা দেওয়া বিভিন্ন রোগের জীবাণু সহজেই হজম করার ক্ষমতা রয়েছে। প্রাণীটি মৃত পশুকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত রাখে। কিন্তু ডাইক্লোফেন ইনজেকশন পুশ করা পশুর মৃতদেহ খাওয়ার পর কিডনি নষ্ট হয়ে মারা যায় শকুন। ফলে শকুন বিলুপ্ত হয়ে খাদ্যশৃঙ্খল রক্ষায় বিঘ্ন ঘটছে।
মাত্রাতিরিক্ত ডাইক্লোফেনাক ইনজেকশন পুশ করা গরুর মাংস খেলে কিডনির রোগসহ বিভিন্ন মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হতে পারে মানুষও-বললেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) ক্লিনিক্যাল সায়েন্স বিভাগের বিজ্ঞানী ও পুষ্টি কর্মসূচির প্রধান ডা. তাহমীদ আহমেদ।
স্টেরয়েড হরমোন ইনজেকশন প্রসঙ্গে ডা. তাহমীদ আহমেদ বলেন, এ ধরনের ইনজেকশন প্রয়োগ করা মাংস নারীর বন্ধ্যত্ব এবং নারী ও শিশুর অল্প বয়সে মুটিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ হিসেবে ব্যবহূত এ ধরনের ইনজেকশন মিশ্রিত মাংস খেলে মানুষের মৃত্যু ঝুঁকিও থাকে।